somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বেচ্ছায় ইতিহাস পুনঃলিখনকারীরা....যুগে যুগে

২৭ শে জুন, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইতিহাস।ইতিহাস হল সমাজ, সভ্যতা ও মানুষের রেখে যাওয়া নিদর্শনের উপর গবেষণা ও সেখান থেকে অতীত সম্পর্কের সিদ্ধান্ত ও শিক্ষা নেবার শাস্ত্র।
সব দেশের ইতিহাস এক হয়না। কারো আছে বিজয়ের ইতিহাস আর কারো আছে পরাজয়ের। এর থেকে শিক্ষা নিতে হয়। যার যা ইতিহাস-ই থাকুক মুল ব্যাপার হল ইতিহাস মোছা যায়না। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের এই ধারনাই ছিল।কিন্তু কালক্রমে মানুষ তাদের ইতিহাসের উপর হাত দেয়া শুরু করে এবং এরপর বিভিন্ন দেশের সরকার ইতিহাসের উপর নিয়ন্ত্রন নেয়ার চেষ্টা করে,এর ফল স্বরূপ তারা ইতিহাস পুনঃলিখন করে।
শুধু তাই নয়,এরপর সরকার এটি তাদের পাঠ্য-পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে। যার ফলে একটা প্রজন্মের পর রুপান্তরিত ইতিহাসটাকেই সবাই সত্য বলে ধরে নেয়।
আসুন জানি সে রকম কিছু দেশ যারা তাদের স্বার্থে ইতিহাস পরিবর্তন করেছিল।

দক্ষিন কোরিয়া



২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় ইনস্টিটিউট দেশের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকগুলিতে বিতর্কিত সম্পাদনা করার পরে জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। পরিবর্তনগুলি দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কে অতিরিক্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাপান ও উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেছিল।বিশেষ করে, juche নামের একটা শব্দ যার মানে হচ্ছে স্বনির্ভরতা, এই আন্দোলনকে আরও উস্কে দিয়েছিল। সমালোচকদের মতে,এই শব্দটি দক্ষিন কোরিয়ার যুব সমাজ মেনে নিবে যে তারা স্বনির্ভর হয়ে বড় হচ্ছে যদিও আদৌ তারা স্বনির্ভর না। তাছাড়া, উত্তর ও দক্ষিন কোরিয়াযুদ্ধ সম্পর্কে পাঠ্য পুস্তকে লিখেছিল, উক্ত যুদ্ধে উভয়ে সমান ভাবে দায়ী যদিও যুদ্ধে উত্তর কোরিয়া প্রথম আক্রমন করেছিল।
সমালোচকরা পাঠ্যপুস্তক সন্মন্ধে আরও বলেছিলেন যে,উক্ত বইগুলো উগ্রপন্থীদের দ্বারা লেখা হয়েছে যারা Park Geun-hye নেতৃতে ১৯৬১ সালে অভুয়থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলো।বইগুলোতে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার কৃতিত্বকে কমিয়ে দিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে, পার্ক চুং-হেইয়ের কন্যা পার্ক জুন-হেই, ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনা প্রস্তাবের সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন।তারা ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে বইগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন সেই সাথে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দেশের অন্যান্য সমস্ত ইতিহাসের বই নিষিদ্ধ করা হবে যাতে সবাই এই বই এর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
যদিও পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে বই নিষিদ্ধ করণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।অন্যান্য বই এর সাথে এই বইটিও তথা রুপান্তরিত ইতিহাস সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ইরাক



১৯৭৩ সালে, সাদ্দাম হোসেন নিজের ইতিহাস এবং তার Ba'ath পার্টির ইতিবাচক মতাদর্শ প্রচারের জন্য ইরাকের পাঠ্যপুস্তক তথা ইতিহাস সংশোধন করেন। সংশোধন অনুসারে, হুসেন আরবদেরকে ইহুদীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন, যাদেরকে তিনি লোভী মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
কয়েক বছর পর, হুসেনের সংস্করণে যোগ করা হয়েছে যে,ইরাক ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে এবং ১৯৯১ সালে গালফ যুদ্ধে US এর বিপক্ষে যুদ্ধে জিতেছিলেন।যদিও বাক্য দুটি ছিল মিথ্যা। ২০০৩ সালে সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটার পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের জন্য এই পাঠ্যপুস্তক উদ্বেগের উৎস হয়ে ওঠে।
পরবর্তীতে, মার্কিনীরা ইরাকের শিক্ষাবিদদের একটা অংশের সাথে কাজ করেন এবং সাদ্দাম হোসেন আর বাথ পার্টির সব তথ্য মুছে ফেলেন। সেই সাথে তারা ইরান,কুয়েত,ইয়াহুদি,কুর্দি,সুন্নি, শিয়া সংক্রান্ত অনেক তথ্য মুছে ফেলেন।আর ১৯৯১ সালের গালফ যুদ্ধ কে কম বিতর্কিত করার জন্য সম্পাদনা করেন এবং তা জাতীয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেন।

ভারত আর পাকিস্তান।



১৯৪৭ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবসময় একটা মার-মার, কাটকাট অবস্থা বিরাজ করতো, যে অবস্থার কারনে পরবর্তীতে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রের সূচনা হয়।
আজকাল প্রতিটা দেশ বা জাতি শুধুমাত্র স্বার্থের কারনে আরেকজনের পিছে লেগে থাকে। এইসব কারনে দেখা যায় তারা তাদের যুদ্ধের ইতিহাস গুলোকে স্কুল লেভেলে নিয়ে যায় যেখানে তারা ইতিহাস গুলো রুপান্তর বা সংশোধন করে তাদের মতো করে জাতির কাছে তুলে ধরে।
ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে ১৯৪৭ সালের বিভাজনের জন্য উভয় দেশই তাদের নিজেদের পক্ষে যুক্তি দাড় করিয়েছে। পাকিস্তানী পাঠ্যপুস্তক দাবি করে যে,ভারতীয় হিন্দুরা স্বাধীনতার পরেই তাদেরকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে ছেয়েছিল যার কারনে পাকিস্তানী মুসলমানরা ভারত থেকে সরে এসেছিল।
এদিকে, ভারতীয় পাঠ্যপুস্তক দাবি করে যে পাকিস্তানীরা কখনোও চায়নি এক রাষ্ট্রে থাকতে্।তারা শুধু আলাদা দেশ গঠন করতে চেয়েছিল।
ভারত-পাকিস্তানের এই তর্ক শেষ হয়েছিলো বিরাট একটা দাঙ্গার মাধ্যমে যেখানে আনুমানিক ২০০০০০-৫০০০০০ জন নিহত হয়েছিলো। পাকিস্তানী পাঠ্যপুস্তক দাঙ্গার জন্য ভারতকে দোষারোপ করেছিল ।তারা দাবি করেছিল যে হিন্দুরা প্রথমে আক্রমণ করেছিল, আর ভারতীয় পাঠ্যপুস্তক দাবি করেছিল যে উভয় পক্ষই দোষী ছিল।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ নিয়েও দুই দেশের ইতিহাস বইয়ে মতবিরোধ আছে। পাকিস্তান পাঠ্যপুস্তক দাবি করে যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক আক্রমনের মুখে “ভারত তাদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিল” আর "জাতিসংঘের কাছে দৌড়ে গিয়েছিল"। অপরদিকে ভারতীয় পাঠ্যপুস্তক দাবি করে যে তারা পাকিস্তানের লাহোর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো যদি না জাতিসংঘ তাদের যুদ্ধবিরতির আহবান না জানাত।
একই সুত্রে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিভাজনের সময়, পাকিস্তানী পাঠ্যপুস্তক দাবি করে যে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করার কারনে বাংলাদেশের জন্ম হয়।অপরদিকে, ভারতীয় পাঠ্যপুস্তকগুলি দাবি করে যে ভারত শুধুমাত্র স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত এক গোষ্ঠীকে সাহায্য করেছে।

জাপান।


শুরু থেকেই চীন আর উত্তর কোরিয়ার সাথে জাপানের সম্পর্ক তেমন আন্তরিক না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীন আর উঃ কোরিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধপরাধের কারনে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক বিরোধের কারনে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই জাপান বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠে।
২০১৭ সালের শুরুর দিকে জাপান সরকার উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনের কাজ শুরু করে।এ সংক্রান্ত তারা একটি কমিটি গঠন করেন যার নাম দেন,”Society for the Dissemination of Historical Fact.”।
তারা পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখিত ১৯৩৭ সালের নানজিং হত্যাকাণ্ডের ৩০০০০০ চীনা নাগরিককে হত্যার কথা সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে দেয়।সেই সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৪০০০০০ কোরিয়ান ও চীনা নারীকে জোরপূর্বক পতিতাবৃতিতে নিয়োগ করার কথাও সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে দেন।
নতুন পাঠ্যপুস্তকে তারা পার্ল হারবারে বোমা হামলার জন্য সম্পূর্ণরূপে ইউ,এস কে দায়ী করেন। তারা লেখেন যে, ইউ,এস তাদের প্রধান দপ্তর গুলোতে হামলা শুরু করে যা যুদ্ধের ডাক দেয়ারই নামান্তর।
সমালোচকরা বলেছেন যে, পাঠ্যপুস্তকে যে সংশোধন চলছে তা জাপানের বিংশ শতাব্দীর সমস্ত যুদ্ধপরাধ ঢেকে ফেলারই অপচেষ্টা।মজার ব্যাপার হচ্ছে, এইসব বিতর্ক চলাকালীন সময়েই ”Society for the Dissemination of Historical Fact.” তাদের চতুর্থ সংস্করণে হাত দেয় যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা জাপানের সমস্ত অপরাধ তথা অতীত ইতিহাস পরিবর্তন করতে বদ্ধপরিকর।

আগামি পর্বে সমাপ্য। পাশে থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×