সুলতানাকে তার সন্তান জন্মদানের সময় লন্ডনের একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হবে তাই ৪ মাস আগেই সব ব্যবস্থা করে রাখা হোল। কিন্তু কয়েকটি ঘটনার কারণে ওদের যাত্রার তারিখ পেছাতে হোল। প্রথম কারণ সুলতানার শাশুড়ি নুরাহর পা মচকে যাওয়া। দ্বিতীয় কারণ কারিমের এক নিকট আত্মীয় একটা গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য কারিমকে থাকতে বললো। তৃতীয় কারণ ছিল সুলতানার বড় বোন নুরার এপেন্ডিসাইটিস ব্যথা। এই সমস্যাগুলির সমাধান হলেও হঠাৎ সুলতানার নকল ব্যথা শুরু হলে ডাক্তার তাকে বিদেশ ভ্রমণ করতে নিষেধ করলেন। কিং ফয়সাল হাসপাতাল তখনও উদ্বোধন হয় নাই তাই সিদ্ধান্ত হোল যে যথাসময়ে অন্য একটা হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হবে। প্রস্তুতি হিসাবে ঐ হাসপাতালের তিনটা রুমকে আগে থেকেই রাজকীয় সুইটে রুপান্তরিত করা হোল। লন্ডন থেকে ইনটেরিওর ডেকোরেটর আনা হোল সাজানোর জন্য। লন্ডন থেকে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ ও পাঁচ জন সেবিকা ৩ সপ্তাহ আগে চলে আসবে বাচ্চা জন্মদানে সহায়তা করার জন্য।
সুলতানাকে সেবা করা ও সঙ্গ দেয়ার জন্য তার বোন ‘সারা’ সুলতানার শ্বশুরবাড়িতে থাকা শুরু করলো। একদিন সুলতানার দেবর আসাদ যখন নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো তখন পরিবারের বাগানে সুলতানার সাথে তার দেখা হয়। সুলতানার পাশেই সুন্দরী সারাকে দেখে আসাদের রিদস্পন্দন বেড়ে যায়। সে মুহূর্তের মধ্যে এতটা মন্ত্রমুগ্ধ ও চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে যে সুলতানা তাকে একটা চেয়ারে বসাতে বাধ্য হয় এবং কাউকে উচ্চস্বরে পানি আনতে বলে। কাছে কেউ না থাকাতে সারা পানি আনতে দৌড়ে যায়। আসাদ বিব্রতবোধ করে ও চলে যেতে চায়। কিন্তু সুলতানার কাছে মনে হয় সে জ্ঞান হারাতে পারে তাই তাকে বসে থাকতে বলে। আসাদ বলে যে সে কোনও ব্যথা অনুভব করছে না কিন্তু সে কেন চলৎশক্তি হারিয়েছে তা সে নিজেও জানে না। সারা এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি ও একটা পানির বোতল নিয়ে ফিরে আসে। সে আসাদের দিকে না তাকিয়ে গ্লাসটা আসাদের মুখ বরাবর এগিয়ে দেয়। আসাদ হাত দিয়ে সারার আঙ্গুল স্পর্শ করে। দুইজনের চোখাচোখি হয় এবং কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির থাকে। সারার হাত থেকে গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে যায়। সারা দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। পাশের রুমে থাকা আসাদের বন্ধুরা আসাদের দেরী দেখে বাগানে চলে আসে। সুলতানাকে দেখে ওরা বিব্রত হয়। ওদের মাঝে আসাদকে রেখে সুলতানা নিজের রুমে চলে যায়।
গভীর রাতে কারিম সুলতানার ঘুম ভাঙ্গায়। সে জানতে চায় আসাদের সাথে বাগানে কি ঘটেছিল। সুলতানা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ঘটনা বর্ণনা করে এবং আসাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেয়। কারিম যখন বলে যে আসাদ সারাকে বিয়ে করতে চায় তখন সুলতানা ধড়মড় করে উঠে বসে। আসাদ কারিমকে বলেছে যে সারাকে না পেলে সে জীবনেও সুখী হবে না। আসাদের মত প্লেবয়দেরও গুরুর এই ধরণের কথা শুনে সুলতানা বিস্মিত হয়। অথচ কয়েকদিন আগেই আসাদ তার মাকে বলেছে যে সে জীবনেও বিয়ে করবে না। সুলতানা বলে আসাদ যে সারাকে দেখে আকৃষ্ট হয়েছে সেটা বাগানে তার আচরণ দেখে সহজেই বোঝা যায় কিন্তু এই বিয়ের প্রস্তাব তার কাছে অবিশ্বাস মনে হচ্ছে। সারাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেই এমন সিদ্ধান্তকে সুলতানা নাকচ করে দেয় এবং আবার শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষন পর কারিম গোসলখানায় গেলে সুলতানা সারার রুমের কড়া নাড়ে। কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে সে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে যে সারা বারান্দায় বসে আকাশের তারা দেখছে। সুলতানাও সারার পাশে বসে পড়ে। সারাই কথা শুরু করে।
সারা বলে - “সে আমাকে বিয়ে করতে চায়”।
সুলতানা – “হ্যাঁ”
সারা – “আমি তার অন্তরে দৃষ্টি দিয়ে আমার ভবিষ্যত জীবনকে দেখেছি। এই লোকটার কথাই হুদা বলেছিল ( হুদা ওদের পরিবারের একজন বয়স্ক আত্মীয়া যে প্রায়ই ওদের হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলতো) যখন সে বলেছিল যে আমার জীবনে ভালোবাসা আসবে। সে আরও বলেছিল যে আমি ৬ টি সন্তানের মা হবো। সুলতানা তুমি ঘুমাতে যাও। তোমার বাচ্চার বিশ্রাম প্রয়োজন। আমার নিয়তি আমার কাছে আসবে। কারিমকে বলো যে আসাদের উচিত বাবার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলা”।
পরের দিন সকালে সুলতানা সিঁড়ি দিয়ে নামার পরে তার শাশুড়িকে দেখার আগেই তার কথা শুনতে পাচ্ছিল। সে তার ছেলে আসাদকে বলছে “আসাদ, মেয়েটার আগে একবার বিয়ে হয়েছে। অল্প সময়ে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। কি কারণে বিচ্ছেদ হয়েছে, কে জানে? বাবা তুমি আবার ভেবে দেখ, তুমি তোমার খুশি মত বিয়ে করতে পারবে। ব্যবহারের কারণে সতেজভাব হারানো মেয়ের চেয়ে একটা কুমারী মেয়েকে বিয়ে করা তোমার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাছাড়া, বাবা তুমি আগুনের গোলা সুলতানাকে দেখ। তার বোন কি ভিন্ন কিছু হতে পারে?” আসাদের ভাবনাহীন ও বেপরোয়া জীবনের কারণে সুলতানা এই বিয়ের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল । কিন্তু তার শাশুড়ির এই কু পরামর্শের কারণে তৎক্ষণাৎ সে এই প্রস্তাবের জোরালো সমর্থক হয়ে গেলো। সে বুঝতে পেরেছিল যে আসাদ এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অটল থাকবে। আসাদ তার মাকে বলল “ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমাকে যদি সারা ও তার পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় তাহলে কেউ এই বিয়ে বিলম্বিত করতে পারবে না।“ সুলতানার শাশুড়ি ছেলেকে তার ঔদ্ধত্যের জন্য উচ্চস্বরে বকাবকি করলো আর তার হার্টের দুর্বলতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলল যে পৃথিবীতে তার দিন ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু আসাদ তার মায়ের কথায় কর্ণপাত না করে স্থান ত্যাগ করলো।
এই ঘটনার কিছুক্ষন পরেই সুলতানার প্রসব বেদনা শুরু হোল। সুলতানার শাশুড়ি এক নিঃশ্বাসে কারিম, সারা, লন্ডনের সেবিকাদের এবং কাজের লোকদের উচ্চস্বরে ডাকাডাকি শুরু করলেন। মুহূর্তের মধ্যে কারিম সুলতানাকে কোলে তুলে এই কাজের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করা বিশেষভাবে রুপান্তরিত লিমজিনের পিছনের শোয়ার জায়গায় নিয়ে শুইয়ে দিল। এই গাড়িতে সারা, কারিম আর একজন সেবিকা উঠলো। আরেকটা গাড়িতে লন্ডনের ডাক্তার ও বাকি চারজন সেবিকা সুলতানাদের গাড়িকে অনুসরণ করলো। কারিম চিৎকার করে চালককে জোরে চালাতে বলল। কিছুক্ষন পর ড্রাইভারকে বকা দিয়ে বলল যে তুমি আমাদের মেরে ফেলবে, আস্তে চালাও। সে রাগতভাবে ড্রাইভারের মাথায় আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিল যখন দেখলো যে আরেকটা গাড়ি তাদের অতিক্রম করে গেছে। কারিম নিজেকে দোষ দিতে লাগলো কেন সে আগে থেকেই পুলিশ এস্করট চায়নি। সারা কারিমকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কারিম ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায় ছিল। এসব দেখে ব্রিটিশ সেবিকা আর চুপ থাকতে পারলো না। সে কারিমকে বলল যে আপনার এই ধরণের আচরণ মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। সে এক পর্যায়ে কারিমকে বলল যে এভাবে করলে সে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে বাধ্য হবে। রাজপুত্র কারিম, যে কি না জীবনে কোনও মেয়ের কাছ থেকে সমালোচনা শোনেনি, সেবিকার এই হুমকিতে আঘাত পেয়ে একেবারে চুপ হয়ে গেলো।
হাসপাতালে সুলতানার ছেলে জন্মগ্রহণ করলো। এনাম হিসাবে ডাক্তারকে কারিম একটি জাগুয়ার গাড়ি আর ৫০,০০০ পাউনড দিলো। ৫ জন সেবিকার প্রত্যেককে ৫০০০ পাউনড ও স্বর্ণালঙ্কার দেয়া হোল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মাতৃসেবা বিভাগের উন্নয়নের জন্য দেয়া হোল মোটা অঙ্কের অর্থ। হাসপাতালের প্রশাসককে দেয়া হোল ৩ মাসের বেতনের সমপরিমাণ বোনাস। পুত্রসন্তান পেয়ে কারিম আর সুলতানার জীবন আনন্দে ভাসতে লাগলো।
মার্কিন লেখিকা জিয়ান সেসন (Jean Sasson) এর বই Princess: A True Story of Life Behind the Veil in Saudi Arabia তে বর্ণিত রাজকন্যা সুলতানার জীবন কাহিনীর সারসংক্ষেপ।
ছবি – ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৩