সুলতানার বোন তাহানি’র এক বাল্যকালের বান্ধবীর নাম ছিল সামিরা। সামিরার বয়স ছিল ২২ বছর। সামিরাকে তার পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা একটা নির্জন, অন্ধকার, জানালাবিহীন কক্ষে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। তার খাবারের ব্যবস্থা যদিও আছে কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত তাকে ঐ ঘরে থাকতে হবে। অনাথ এই মেয়েটির বিরুদ্ধে ব্যভিচারের এবং পরিবারের সম্মানহানির অভিযোগ আনা হয়েছে তার চাচা ও অন্যান্য পুরুষ আত্মীয়ের পক্ষ থেকে। মেয়েটিকে তার বাবা মা লন্ডনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠিয়েছিল যখন তারা জীবিত ছিল। সেখানে ল্যারি নামের একটা অ্যামেরিকান ক্যাথোলিক ছেলের সাথে তার প্রেম হয়।
সামিরার আর কোনও ভাই-বোন ছিল না কারণ তার মার গর্ভাশয়ে ক্যানসার হয়েছিল। ক্যানসার চিকিৎসার পর ডাক্তাররা বলেছিল যে তার পক্ষে আর মা হওয়া সম্ভব হবে না। সামিরার বাবা গড়পড়তা সৌদি পুরুষদের মত ছিল না। সে চাইলেই আরেকটি বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু আমৃত্যু সে সামিরার মাকে নিয়েই সংসার করেছে। সুলতানা আর সারাও তাহানির মত সেই ছোটবেলা থেকেই সামিরার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে সামিরাকে তার বাবা অনেক ভালবাসত। সামিরার বাবা সামিরাকে বলেছিল যে সামিরাকে সে সৌদি আরবের মেয়েদের প্রতি প্রয়োগ করা অন্যায় নিয়ম কানুন থেকে মুক্ত রাখবে।
ল্যারি আর সামিরার ভালবাসার বাধা হয়ে গেল ধর্ম। ল্যারি গোঁড়া ক্যাথোলিক, তাই সে মুসলমান হতে চায়নি। সামিরার বাবা মা হয়তো এই সমস্যার একটা সমাধান করতে পারতো। কিন্তু মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় উভয়েই মারা যান। আরবের নিয়ম অনুযায়ী সামিরার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার পেয়ে যায় তার চাচা। তিনি সামিরাকে তখনই দেশে ফিরতে আদেশ করলেন। সামিরা এই আদেশ না মেনে ল্যারিকে নিয়ে অ্যামেরিকা চলে গেল। সামিরার চাচা একটা প্রাইভেট এজেন্সিকে দায়িত্ব দিলো তাকে খুঁজে বের করার জন্য। চাচা ভাতিজির এই টানাপড়েনের কথা ল্যারিও কিছু কিছু জানতে পারলো। সামিরা আর ল্যারির ভালবাসাও ধীরে ধীরে এইসব কারণে ফিকে হতে থাকে।
সামিরা অর্থ সঙ্কটে পরে গেলো। সে তাহানির (সুলতানার বোন) কাছে টাকা ধার চায়। তাহানি তার স্বামীকে ব্যাপারটা খুলে বলে। কিন্তু তাহানির স্বামী টাকা পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করে। এরপর সামিরা তার ছোট ফুফুকে ফোন করে। ফুফু সামিরার সমস্যার কথাগুলি সামিরার চাচাকে বলে। সামিরার চাচা ও ফুফুরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সামিরার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে। সামিরা মিশরে পৌছলে তার দুই ফুফু আর দুই কাজিন তাকে আনতে যায়। তাকে বলা হয় যে সে আবার লন্ডন যেতে পারবে। সামিরা তাদের মিথ্যা আশ্বাস বিশ্বাস করে।
রিয়াদে পৌছলে সামিরাকে প্রথমে একটা কক্ষে আটকে রাখা হয়। তার চাচা তার জন্য বিয়ে ঠিক করে ফেলে। বরের বয়স ৫৫ বছরের মত এবং এটা তার তৃতীয় বিয়ে। সে ছিল লম্বায় খাটো ও মোটা। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সামিরাকে নজরবন্দি করে রাখা হয়। পরে সুলতানারা জানতে পারে যে বিয়ের রাতে সামিরা তার স্বামীর সাথে এমনভাবে হাতাহাতি, মারামারি করে যে তার স্বামী আহত ও রক্তাত্ত হয়। পরে সামিরা তার ফুফুদের বলে যে সে এই খাটো আর মোটা লোককে কখনও স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারবে না এবং সে তার অ্যামেরিকান প্রেমিক ল্যারির সাথে এই লোকের তুলনা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তালাকের মাধ্যমে এই বিয়ের অবসান হয়। তালাকের সময় সামিরার বর সামিরার চাচাকে বলে বলে যে আপনাদের পরিবারের কোনও সম্মান নেই এবং আপনারা জেনে শুনে একটি অসতী মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছেন। বাসর রাতে সামিরা হাতাহাতি, মারামারি করেছে এবং তার প্রেমিকের সাথে আমাকে তুলনা করেছে। সে বিছানায় আসতে রাজি হয়নি।
সামিরার চাচা শাস্তি হিসাবে সামিরাকে একটা অন্ধকার ঘরে চিরদিনের মত বন্দি করে। তাকে শুধু খাবার দেয়া হতো। কারও সাথে কথা বলা তার নিষেধ ছিল। মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত এভাবে তাকে থাকতে হয়েছিল। ঘরটিতে কোনও জানালা ছিল না। তার কান্নার আওয়াজ যেন বাইরে না যায় তার জন্য রুমটাকে সেইভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এভাবেই সামিরাকে হত্যা করা হোল পরিবারের সদস্যদের দ্বারা যার খবর বাইরের মানুষ জানলেও কেউ কোনও প্রতিবাদ করলো না কারণ সৌদি সমাজে এই কুপ্রথা প্রচলিত ছিল।
মার্কিন লেখিকা জিয়ান সেসন (Jean Sasson) এর বই Princess: A True Story of Life Behind the Veil in Saudi Arabia তে বর্ণিত রাজকন্যা সুলতানার জীবন কাহিনীর সারসংক্ষেপ।
ছবি – ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৫৭