
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিলিয়ন বিলিয়ন গালাক্সি আছে। একটা মাঝারি আকৃতির গালাক্সিতে আবার গড়ে ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। এই কল্পনাতীত বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মোট ভর এবং শক্তির মাত্র ৫% হল আমাদের চেনা জানা ম্যাটার এবং শক্তি। এই ৫% এর মধ্যে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন গালাক্সি সহ আরও কত কিছু। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মহাবিশ্বের মোট ভর এবং শক্তির ৬৮% হোল ডার্ক এনার্জি। আর ২৭% হোল ডার্ক ম্যাটার। বাকি মাত্র ৫% হোল আমাদের পরিচিত ম্যাটার এবং এনার্জি। এই দুই রহস্যময় এনার্জি এবং ম্যাটার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা খুবই কম জানেন। এগুলির গতি প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়। এগুলি আমাদের পরিচিত শক্তি বা ম্যাটারের মত না। অথচ এই ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জিই মহাবিশ্বের ৯৫% দখল করে আছে।
কিভাবে এবং কোথা থেকে ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটার তৈরি হয় এটা আমরা এখনও জানি না। এগুলি কি শুন্য থেকে তৈরি হয় নাকি রুপান্তরের মাধ্যমে তৈরি হয় এটা নিয়ে গবেষণা চলমান। বিগ ব্যাঙের সময় ডার্ক এনার্জি ছিল না। পরে উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই ডার্ক এনার্জির কারণে মহাবিশ্ব আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। এই প্রসারিত হওয়ার গতিও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পোস্টে ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে বলব না। এই পোস্টের ফোকাস হল ডার্ক ম্যাটার।
ডার্ক ম্যাটার তার মহাকর্ষ বলের সাহায্যে গ্যালাক্সিগুলিকে বেশী দূরে সরে যাওয়া থেকে রক্ষা করছে। অর্থাৎ ডার্ক এনার্জির বিপরীতে ডার্ক ম্যাটারের মহাকর্ষ শক্তি কাজ করছে। ফলে উভয় শক্তির মধ্যে একটা সমন্বয় আছে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া গ্যালাক্সিগুলির অনেক কর্মকাণ্ডের পিছনে ডার্ক ম্যাটারের ভরের ভুমিকা আছে। ডার্ক ম্যাটারের এই অদৃশ্য ভরকে গণনায় না ধরলে বিজ্ঞানের থিউরিসমূহ দ্বারা গ্যালাক্সিগুলির গতি, প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ডার্ক ম্যাটারের 'ডার্ক' বলতে এখানে অজানা ম্যাটার বুঝাচ্ছে। এই ম্যাটার সম্পর্কে আমাদের খুব সামান্য ধারণা আছে তাই এটাকে ডার্ক ম্যাটার বলা হয়। এই ম্যাটার কিন্তু বাতাসের মত কোন গ্যাসিয় পদার্থ না। কোন মেশিন, যন্ত্রপাতি,সরঞ্জাম দিয়ে এই অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারকে নির্ণয় করা, ধরা বা ছোঁয়া যায়নি। তারপরও বিজ্ঞানীরা ধরে নেন যে এই ম্যাটার মহাবিশ্বে আছে। কারণ মহাকাশের গ্যালাক্সি, গ্রহ, নক্ষত্র সমুহের অনেক আচরণ আছে যেগুলির ব্যাখ্যা করতে গেলে এই ধরণের ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের কথা চলে আসে। ডার্ক ম্যাটারের বৈশিষ্ট্য হল এটার ভর আছে কিন্তু সাধারণ ম্যাটারের মত ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড দ্বারা প্রভাবিত হয় না। ফলে ডার্ক ম্যাটার চিহ্নিত করা কঠিন।
মহাকর্ষ সুত্র সংক্রান্ত কিছু পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন। ডার্ক ম্যাটারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মহাকর্ষ শক্তির কারণে মহাশূন্যে আলোক রশ্মির গতি পথ বক্র হয়। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে ডার্ক ম্যাটার সম্ভবত কোন সাব-এটমিক কণা দ্বারা তৈরি। ১৮৮৪ সালে বিজ্ঞানী লর্ড কেল্ভিন প্রথম অনুমান করেন যে মহাবিশ্বে সম্ভবত কিছু অদৃশ্য নক্ষত্র আছে। গালাক্সির ভর নির্ণয় করতে গিয়ে তিনি দেখেন যে ঐ গালাক্সির অন্তর্গত নক্ষত্রগুলির ভরের সমষ্টি গালাক্সির ভরের অনেক কম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভরের সমষ্টি সমান হওয়া উচিত ছিল। তখন ওনার মাথায় আসে যে নিশ্চয় আরও কিছু অদৃশ্য নক্ষত্র আছে যেগুলির ভরের কারণে গালাক্সির ভর বেশী হচ্ছে। এরপরে আরও অনেক বিজ্ঞানী ডার্ক ম্যাটার নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ ধীরে ধীরে কমে এসেছে। ১৯৮০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত হন যে মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটার আছে।
স্পাইরাল গালাক্সির ‘গ্যালাক্সি রোটেশন কার্ভ’ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাওয়া সত্ত্বেও নক্ষত্রগুলির অরবিটাল গতি আগের মতই আছে অথবা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কেপলারের তৃতীয় সুত্র অনুসারে বিজ্ঞানীরা জানেন যে, কেন্দ্র থেকে দূরে সরে গেলে গ্রহ বা নক্ষত্রগুলির অরবিটাল গতি কমে যায়। এই গড়মিল মিলাতে গিয়ে তারা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বকে ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, নক্ষত্রের আশেপাশে অবস্থিত অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের ভরজনিত মহাকর্ষের কারণে নক্ষত্রগুলির গতিতে কোন পরিবর্তন আসে না বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে যায়। তবে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে নিউটনের ‘সার্বজনীন মহাকর্ষ ল’ যদি কিছুটা পরিবর্তন করা যায় তাহলেও এই গড়মিলের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব।
ভাইরিয়াল থিউরেম প্রয়োগ করেও ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। বিজ্ঞানীরা প্রথমে 'ভাইরিয়াল থিউরেম' প্রয়োগ করে একটা গ্যালাক্সির ভর নির্ণয় করেন। তারপর আবার ঐ গ্যালাক্সির ভর নির্ণয় করেন আলোর বিকিরন পরিমাপের মাধ্যমে (luminosity)। এই দুই পদ্ধতিতে পাওয়া ফলাফলের মধ্যে গড়মিল পাওয়া যায়। একমাত্র ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতির দ্বারা এই দুই পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয় করা যায়।
ডার্ক ম্যাটারের ভর আছে তাই ভরের কারণে পাওয়া মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবে মহাকাশে আলোর গতি বক্র হয়ে যায় বলে প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই পদ্ধতিকে gravitational lensing বলা হয়।
ডার্ক ম্যাটার নিয়ে সামান্য কিছু বললাম। ডার্ক এনার্জি নিয়ে পরে কখনও বলার চেষ্টা করবো।
সুত্রঃ
pweb.cfa.harvard.edu/research/topic/dark-energy-and-dark-matter#:~:text=Dark matter makes up most,accelerated expansion of the universe.
scienceline.org/2016/12/physicists-are-in-the-dark-on-dark-matter/
science.nasa.gov/astrophysics/focus-areas/what-is-dark-energy
space.com/20930-dark-matter.html
en.wikipedia.org/wiki/Dark_matter
ছবিঃ cnet.com
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




