আর মাত্র কয়েক টা দিন পর বই মেলা । লেখক, প্রকাশক আর পাঠক এর যে সম্মীলন ঘটবে –তার অপেক্ষায় থাকব আমরা সবাই । রঙিন কভারের মাঝে সাদা পাতায় কালো অক্ষর গুলো অপেক্ষা থাকবে তার পাঠকের জন্য । এমন অবস্থা লেখক তার নিজের হাতে লেখা ছাপা বই দেখতে সবচেয়ে আনন্দিত বোধ করবেন । এটা একজন লেখকের কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় । এই বই মেলায় সবচেয়ে বেশী যার অভাব বোধ করব, সবচেয়ে বেশী । এদেশের ক্ষণজন্মা লেখক হুমায়ূন আহমেদ কে । হাঁ, ভিড়ে মধ্যে ঠেলা ঠেলি করে, আর তার বই কোন দিন কেনা হবে না । এটা ভাবতে খুব খারাপ লাগে ।
যাই হোক , আমি অন্য একটা বিষয় আলোকপাত করতে চাই । আমাদের দেশে ২য় হুমায়ূন আহমেদ তৈরি করা হয়নি । যার উপর উপর ভর করে আমাদের প্রকাশনা শিল্প চলতে পারে । এদেশের প্রকশানা শিল্প কিছু টা হলেও হুমায়ূন আহমেদ নির্ভর ছিল । যে কোন প্রকাশকের সুন্দর মননশীল বই প্রকাশের সাথে সাথে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ারও একটা বিষয় আছে । যে কোন প্রকাশক হুমায়ূন আহমেদের একটা বইয়ের সাথে কিছু টা কম পরিচিত এক বা একাধিক বই প্রকাশ করার মত সাহস দেখাতে পারতেন । অন্যদিকে দেখা যেত, মোট পাঠকদের কিছু অংশ শুধু আসত হুমায়ূন আহমেদের বই কিনতে । এবং পুরা মেলা ঘুরে অন্য কিছু লেখকের বই কিনত । কিন্তু এইবার আমরা পাঠকদের এই অংশ টা কে মিস করব ।
এরপর অন্য আর একটা দিক তুলে ধরব । বইয়ের দাম । সুন্দর অফসেট পেজে ২.০ লাইন সেপেসিং দিয়ে সব আইনকানুন মেনে, প্রকাশক যখন বইয়ের দাম আকাশচুম্বী রাখেন ; তখন সবচেয়ে বেশী সমস্যা পড়েন মধ্যবিত্ত পাঠক । এদেশে কয়েক শ্রেণীর পাঠক রয়েছে ।
১। বই কিনে বই পড়া পাঠক
২। অন্যের কাছ থেকে ধার করে বই পড়া বা চুরি করে বই পড়া পাঠক
৩। ডিজিটাল পাঠক (যারা পিডিফ ভার্সনে বই পড়ে)
প্রথম শ্রেণীর পাঠকের পরিমাণ সবচেয়ে কম । এর কারন সবার জানা । আমাদের অন্ন-বস্ত্র আর ক্লাসের বই আর স্কুল কলেজের বেতন দেওয়ার পর বই মেলা থেকে বই কেনার মত তেমন টাকা আমাদের হাতে থাকেনা । আর ২য় আর ৩য় শ্রেণীর পাঠক দিয়ে মূলত লেখক আর প্রকাশক তেমন কোন লাভবান হন না । এদের পরিমাণ সবচেয়ে বেশী আমাদের দেশে । আর বই দাম গত বছরের মত যদি এই বছরেও থাকে, তবে ২য় আর ৩য় শ্রেণীর পাঠকের পরিমাণ আরও বাড়বে । কারন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে আমাদের মানে মধ্যবিত্তর অর্থনীতিক অবস্থা বেশী ভাল না । যে নবীন লেখক ফেব্রুয়ারী শুরুতে তার প্রকাশিত নতুন বই হাতে নিয়ে যে আনন্দময় শুরু করবে, আমি অন্তত এটা আশা করতে চাই না যে মার্চের শুরুতে তার প্রথম মুদ্রণের অবিক্রিত বই নিয়ে হতাশা উড়াবে । কারন দিন শেষে আর্থিক ব্যপার টা সবচেয়ে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে । যদি পাণ্ডুলিপি প্রাকাশকের হাতে যাওয়ার পর লেখকের বিশেষ কিছু করার থাকে না । একটু কম মুনাফা করে, যদি বই বিক্রি না করা হয় ; তবে আমার এটা বলতে দ্বিধা নেই যে , একদিন আমাদের প্রকাশনা শিল্প হুমকির মুখে পড়বে । ঠিক যেমন টা এখন অডিও industry । শিল্পীরা তাও স্টেজ শো বা চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে কিছু টাকা আয় করতে পারে । কিন্তু লেখকরা তো তাও পারবেনা । তাই প্রকশনা শিল্প সাথে সাথে লেখকরাও যে ধ্বংসের মুখে পড়বে না; তাতে কোন দ্বিধা নেই । তাই সার্বিক বিষয় টা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিৎ এখনই । না হলেও আস্তে আস্তে কখন যে বিলিন হয়ে যাবে সব কিছু; তা কেউ বুঝতে পারবেনা । এভাবে একটু একটু করেই কিন্তু অডিও industry শেষ হয়েছে ।
আমার লেখা টা শেষ করব গত বছরের একটা ঘটনা দিয়ে । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ছিলেন । তিনি তার পেশা সাথে সাথে কলাম লিখতেন একটা দৈনিকে । যেহেতু একটা খুব ভাল দৈনিকে তার লেখা প্রকাশিত হয়, সেহেতু তার লেখার মাণ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না । তার কলাম সঙ্কলন যখন বই আকারে প্রকাশিত হল এবং স্যার পুরা ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে ক্লাসে তার বইয়ের প্রচারণা চালালেন ; তখন আমার সন্দেহ থাকলনা যে স্যার এর বই টা বেশ ভাল বিক্রি হচ্ছে ।
যাই হোক, আমার নজর নতুন বইয়ের দোকান থেকে পুরান বইয়ের দোকানে থাকে বেশী । মার্চ মাসের কোন এক বিকালে, আরও অনেক নতুন বইয়ের সাথে, আমি স্যারের অবিক্রিত বই গুলো দেখতে পেলাম । এবং জানতে পারলাম বই মেলার কম বিক্রীত বই গুলো এক রকম পানির দরে তারা কিনে নিয়ে আসে । এর মত হতাশা জনক কিছু হতে পারে বলে আমার মনে হয় না । এমন অনেক সুন্দর সৃজনশীল লেখকের বই হয়ত কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে । আর আমরা বঞ্চিত হচ্ছি সুন্দর সুন্দর লেখা থেকে ।
আর একটা কথা । আমি কোন লেখককে আঘাত করে এই মত প্রকাশ করছিনা । শুধু আমি তাদের বিপদের দিক টা, একজন পাঠক হিসাবে চিন্তা করেছি মাত্র ।