আকাশে খানিকটা আলোর আভা। তবুও ঘরের আঁধার কাটে না। নাকি মনের আঁধার! ভেবে কুল পায় না বকতিয়ার। মনের ভেতরের কু-ডাকটা ডেকেই যাচ্ছে। আজকাল কি এক হুজুগ উঠেছে। ‘বিচার চাই।’
- আরে কিয়ের বিচার! তোগো ন্যাতাইতো মাফ কইরা দিয়া গ্যাছে।
মনে মনে খড়কুটো ধরার চেষ্টা করে বকতিয়ার। কিন্তু থই খুঁজে পায় না। শেখ সাহেবের খুনীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা মনে পড়লে কিছুই ভালো লাগে না। তবে কি তাদের বিচারও হবে? চোখ বুজে আসে তার। সেই সোনাডাঙ্গার খাল। খালপাড়ের মিলিটারি ক্যাম্প। এখনো কিছুই ঝাপসা হয়নি। মনে পড়ে আয়েশার ডাগর দু’টি চোখ। অল্প বয়সের বাড়ন্ত শরীরে যেন নেশা লাগানো।
একটা ঘোরের মধ্যেই খালপাড় দিয়ে হেঁটে যায় বইক্যা চোরা। দূরে ক্যাম্পের হল্লা। একটা মেয়ের করুন আর্তি। শরীরের জ্বালা নেভে না। খালের পানিতে নেমে পড়ে বকতিয়ার। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে মিনিট দশেক। সাঁতরে ওপারে ওঠে। সোজা হাঁটা দেয় ক্যাম্প বরাবর।
- হুজুর আপকো মুক্তি চাহতা হ্যায়? রাতকো মেরে সাথ চলিয়ে।
কি এক প্রত্যাশায় চকচক করে অফিসারের চোখ। কিন্তু বকতিয়ারের শরীরের জ্বালা তাতে মেটে না। সেই জ্বালায় ছাই হয়ে যায় সেলিম চেয়ারম্যানের ঘরদোর। অফিসারের হাতের মধ্যে মোচড় খায় আয়েশার বাড়ন্ত শরীর। কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে রক্ত গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা- দু’ ফোঁটা। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বকতিয়ার। সটান পড়ে যায় অফিসারের পায়ের ওপর।
- ছোড় দিজিয়ে হুজুর। ইয়ে মেরা পরিবার হ্যায়।
ফট ফট শব্দে কাঠ পোড়ে সেলিম চেয়ারম্যানের ঘরের। চকচক করে মিলিটারিদের হেলমেট। তারচেয়েও চকচকে ঘামে ভেজা মুখগুলো। সেই মুখের কুৎসিত হাসিতে হিম হয়ে আসে আয়েশার গোটা শরীর। অফিসারের হাসি ছাপিয়ে যায় কাঠ ফাটার শব্দকেও।
তবু অফিসারের পা ছাড়ে না বকতিয়ার। একটু একটু করে আয়েশার মুখের দিকে এগিয়ে যায় ঘামে ভেজা চকচকে আরেকটি মুখ। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় কচি মেয়েটার। নাকে ঝাপটা মারে উৎকট গন্ধ। ভয়ে চিৎকার করতেও ভুলে গেছে। গোঙ্গানির মতো আওয়াজ বের হয় খানিকটা। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় আগুন আরো বেড়ে যায়। রাতের আকাশের ছোট একটি অংশ তখন লালচে হয়ে আছে। মড়মড় শব্দে ভেঙ্গে পড়ে কোনো একটি ঘরের আড়া। হঠাৎই থেমে যায় চকচকে মুখটি। একবার পায়ের কাছে পড়ে থাকা বকতিয়ারকে দেখে, একবার মেয়েটির বাড়ন্ত শরীরের দিকে তাকায়। যেন চোখ দিয়েই চেটে খেতে চায় শরীরটাকে। কি মনে হতে ছেড়ে দেয় মেয়েটির হাত। ধপ করে মাটির ওপর পড়ে যায় আয়েশা।
- বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা। বিবিকো ঘর লে যাও।
অট্টহাসিতে পুরো গ্রাম কাঁপিয়ে ক্যাম্পের দিকে রওনা হয় অফিসার। পিছু নেয় সঙ্গী জওয়ানগুলো। আগুন তখন অনেকটাই নিভে এসেছে। পোড়া বাড়ির উঠানে পড়ে আছে বকতিয়ার- আয়েশা। কিছুক্ষণ যেন হুঁশ থাকে না কারোরই। সম্বিত ফিরতেই বকতিয়ারের চওড়া বুকে ঠাঁই খুঁজে নেয় আয়েশা। পিঠে অনুভব করে ভরসার একটি হাত। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় দু’জন। রাতের অন্ধকারে খালপাড়ের দিকে হেঁটে যায় দু’টি নারী-পুরুষ। পেছনে পড়ে থাকে পোড়া বাড়ি। উঠানে সেলিম চেয়ারম্যানের রক্তাক্ত নিথর দেহ। পোড়া ঘরের ভেতর কয়লা হয়ে থাকে চেয়ারম্যানের পোয়াতি বউটা। সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পোড়া ঘরের খুঁটিগুলো।
(চলবে.....................)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



