মাইল খানেক দূরে খাল পাড়েই বকতিয়ারের ছোট ঘর। ছনের ছাউনি। খড়ির বেড়ার অনেক জায়গাই ফাঁকা। ছেঁড়া কাগজ দিয়ে আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা। খাল পাড়ের বাতাসে অনেক জায়গার কাগজও উড়ে গেছে। দিনের আলোয় চোখ রাখতে হয় না। হঠাৎ তাকালেই দেখা যায় ভেতরের খানিকটা। এতদিন খেয়াল করেনি বকতিয়ার।
আজ মনের মানুষটিকে ঘরে এনে সব কিছুই বড় বেশি চোখে লাগছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাতাস যেন ঢুকছে পাল্লাপাল্লি করে। ফিসফিসানি শব্দে মনে হয়, কারা বুঝি উঁকি দিয়ে দেখছে তাদের। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেয় পা রাখতে পারে না মেয়েটা। আবার তেল চিটচিটে বিছানায় ভালো করে পা তুলে বসতেও কেমন ঘেন্না হয়।
কি করবে ভেবে পায় না বকতিয়ার। তার জীবনটা কেন এমন অগোছালো! ঘরদোরের এমন শ্রী! লজ্জায় আয়েশার দিকে ভালো করে তাকাতেও পারে না। একটা খাটও নেই যে তার। নৌকার পাটাতন চুরি করে এনেছিলো। তার উপরই দুইটা কাঁথা বিছানো। শেষ কবে ধুয়েছিলো মনে করতে পারে না মানুষটা।
- পিয়াস লাগছে।
আয়েশার কথায় সম্বিত ফেরে বকতিয়ারের। তাড়াহুড়োয় উল্টে ফেলে পানির ঘড়া। গড়িয়ে যায় সব পানি। একটা কাষ্ঠ হাসি দিয়ে এদিক ওদিক কি যেন খোঁজে বকতিয়ার। দরজার পাশেই পড়ে আছে টিনের পাত্রটা। খুঁজে পেতে হাতে নিয়ে খালের দিকে দৌড় দেয়। সেলিম চেয়ারম্যানের বাড়ির আগুন আর দেখা যায় না। খালের পানিতে নেমে একবার সেদিকে তাকায় বকতিয়ার। বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে।
- পানি আনছি। খায়া লও।
সেদিকে ভ্র“ক্ষেপ নেই আয়েশার। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। বকতিয়ারের মনে হয়, এই বুঝি পালানোর চেষ্টা করে মেয়েটা। কিন্তু না! এক টানে তক্তার ওপর থেকে তেল চিটচিটে কাঁথা দুটো টেনে ফেলে দেয়।
-ক্যাথা দুইটা নিয়া বাইরে যান। ভেতরে আসনের দরকার নাই।
কন্ঠের ঝাঁঝটা ঠিকই টের পায় বকতিয়ার। কিন্তু মেয়েটার শীতল চোখের দিকে চেয়ে কথা বলার সাহস হয় না। ইতস্তত পায়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। কুপির আবছা আলোর খানিকটা এসে পড়েছে বাইরে। তাতে অন্ধকার যেন আরো গাঢ় হয়েছে। ঘরের পাশেই খানিকটা দুবলা জন্মেছে। কাঁথা দুটো বিছিয়ে বসে পড়ে বকতিয়ার। বসা থেকে শোয়া।
ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে কান্নার চিকন সুর। মাথার ওপর উড়ে যায় দু-একটা বাদুড়। দূরে কোথাও ডেকে ওঠে রাত জাগা পাখি। বকতিয়ারের মন কেমন করে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরের ম্যাড়ম্যাড়ে আলোটাকে ভৌতিক লাগে। এক মনে সেদিকেই চেয়ে থাকে বকতিয়ার। চেয়ে থাকতে থাকতে শরীরের সেই জ্বালাটা আবারো ফিরে আসে। খাল পাড়ের হিম মাখানো হাওয়ায় সে জ্বালা জুড়োয় না।
অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে থেকে খানিক এপাশ-ওপাশ করে বকতিয়ার। কান্নার শব্দ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা? তড়াক করে উঠে বসে বইক্যা চোরা। যেন শিকারের গন্ধ পেয়েছে কোনো নেকড়ে।
খড়ির আলগা দরজাটা এক পাশে সরিয়ে রাখে বকতিয়ার। উঁকি মেরে দেখে খালি তক্তার উপর শুয়ে আছে তার মনের মানুষ। পায়ের কাছে শাড়িটা কি একটু উঠে গেছে? ফর্সা একটা ভাব তাইতো বলে। ঘরে ঢুকতে গিয়েও ঢোকে না লোকটা। কিসের একটা ভয় ভর করে তার জ্বালা ধরা শরীরে। আশপাশে কেউ নেই। তারপরও এদিকে-ওদিক তাকায় বকতিয়ার। অন্ধকারেই দেখার চেষ্টা করে কোনো ছায়া চোখে পড়ে কি না।
(চলবে........)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



