রাস্তা থেকে ভেসে আসছে টুং টাং শব্দ। ভোরের প্রথম খদ্দেরের আশায় বেরিয়েছে দু-একজন রিক্সাওয়ালা। এই সময়টাতে একেবারে বিপদে না পড়লে কারোরই ঘর থেকে বেরোনোর কথা না। বকতিয়ার ভাবে, কি হইলো দ্যাশটার! দিনে রাতে মানুষ কখনোই নিশ্চিন্তে বাইর হইতে পারে না। তাইলে অ্যাতো হ্যাপা করোনের কি দরকার আছিলো? ভয়ে যদি গত্ত্বের মইধ্যেই হাইন্দায় থাকতে অয়, তাইলে দ্যাশটারে ভাগ করতে গেছিলি ক্যান?
ঠোঁটের কোণে আলতো হাসে বকতিয়ার। সেই হাসি দেখা যায় কি যায় না। তবে মনের ভেতরে অট্টহাসিটা ঠিকই উপভোগ করে সে।
-দ্যাশ, স্বাধীন দ্যাশ! কিছুই পাস নাই তোরা। তোগো পাইতে দেই না।
মনে মনে ভাবে বকতিয়ার।
-খালি এক টুকরা মাটি পাইছোস। আর পাইছোস দুই রঙ্গা একটা কাপড়। আর কি পাইছোস?
আবারো শরীরের সব রক্ত ভর করে বকতিয়ারের দুই চোখে।
-তোগো চোউখ্যের ঘুম, মনের শান্তি সবতো কাইড়া নিছি। স্বাধীন দ্যাশে স্বাধীনভাবে চলতে পারোস না। নিকুচি করি তোগো স্বাধীনতার। তোগো সব, সব কিছু ছিনাইয়া নিছি। য্যামনে নিছিলাম ........
ফর্সা একটা আভা। লোলুপ চোখে তাকায় বকতিয়ার। চেয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে যায়। কতক্ষণ মনে নেই। কিভাবে তাও ঠিক নেই। কখন যেন মেয়েটার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মানুষটা। বুকের ধুকপুকানিটা এখন আর টের পায় না। শুধু খানিকটা কাঁপুনি কালো লোমশ হাতটায়।
তড়াক করে উঠে বসতে চায় আয়েশা। পারে না। লোহার মতো শক্ত দুটো হাত তাকে চেপে ধরে পাটাতনের ওপর। তবুও জোর খাটায় মেয়েটা। ফোঁস ফোঁস শব্দ ওঠে ঘরের মধ্যে। কিন্তু খাল পাড়ের বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে হারিয়ে যায় তা। হারিয়ে যায় আয়েশা। রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায় তার সমস্ত পৃথিবী।
খালপাড়ের ছোট্ট ঘরটিতে বয়ে যাওয়া ঝড়ে অনেক আগেই নিভে গেছে কুপির আলো। অন্ধকারে কিছুই ঠাওর করা যায় না। শুধু পড়ে থাকা এক তাল মাংসপিন্ডের ওপর চকচক করে ঘামে ভেজা একটা মুখ। সেই মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। যেন জমি চষে বীজ বুনে ক্লান্ত কোনো আদিম চাষী।
সেই রাতের কথা মনে পড়ায় শরীরের মধ্যে কিসের যেন ডাক পায় বকতিয়ার। জ্বরে পুড়ে যেতে চায় গোটা দেহ। নাক দিয়ে বের হয় গরম হাওয়া। তবে বকতিয়ার এখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে। চোখ বন্ধ করে ধ্যানি ঋষির মতো বসে থাকে খানিকক্ষণ। প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি শিরায়। ঠান্ডা হয়ে আসে ধমনী।
আয়েশার মুখে-পিঠে আলতো হাত বুলায় বকতিয়ার। এক ঝটকায় সে হাত সরিয়ে দেয় মেয়েটা। তবু হাল ছাড়ে না মানুষটা। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস হয় না। আয়েশার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা পানি। আর দুই উরুর মাঝখানে ভীষণ জ্বালা।
উঠে বসে বকতিয়ার। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে বাইরে কোনো শব্দ পাওয়া যায় কি না। বড় করে শ্বাস নেয়। বুকে সাহস ফেরে তার।
- কান্দো ক্যান? আমি তো তুমারে সেই কবে থিইক্যা ভালোবাসি। খালি মুখ ফুইট্যা কইতে পারি নাই।
রক্তে ভেসে যায় খালপাড়ের ছোট্ট ঘরটা। সেই রক্তে ভেসে যায় আয়েশার স্বপ্ন, শখ, আহ্লাদ। মাত্র কয়েকটা ঘন্টা! ওলট পালট করে দিয়ে গেলো তার গোটা দুনিয়া। কাটা পাখির মতো কাঠের পাটাতনে পড়ে পড়ে ভাবে আর ক্ষরণ চলে তার মনে। ক্ষরণ চলে দুই ইঞ্চি জমিতে।
(চলবে.......)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



