খুব ছোট বেলা থেকে দেখতাম গাছের কাটা ডাল খাসীর মাংসে দেওয়া হচ্ছে । এটা বাড়ির গাছের ডাল নয় বাজার থেকে আনা । মা বললেন এতে ঝাল আছে খাসনে । কিছুদিন গেল , এক কুরবানিতে মুখে নিয়ে চাবিয়ে দেখলাম বেশ ঝাল । লাফ দিয়ে উঠে পানি খেলাম । একসাথে বসা বড়রা হেসে দিল । আমাকে বলল মাতব্বর হয়ে গেছিস । কিছুক্ষনের মধ্যে ঝাল কমলো কিন্তু মুখে অদ্ভুত একটা স্বাদ লেগে রইল । এরপর থেকে চুইঝাল ভেঙ্গে ছোট টুকরো চাবিয়ে আমি স্মার্ট হয়ে গেলাম । মুরগিতেও চুই দেওয়া হত তাতে ঝোলের স্বাদ বাড়ত । বড় বাজারে মন্দিরের সাথে চুইঝাল বিক্রেতা বসত । চুই চাইলেই সে দেখিয়ে বলত কোনটা দেব । চিকন ডালপালা থেকে মাঝারি ও মোটা সবি আছে । বাবার পছন্দ মাঝারি । একবার বড় কিনল । ওটা গরুর মাংসে চিবিয়ে মনে হল এটাই বেস্ট কারন শাঁস আছে মোটা অংশে । দামও খাসা । খাসীর মাংসে চুই এর সাথে আস্ত রসুন দেওয়া হত । রসুন মুখে ধরে টান দিলেই ফুড়ুৎ করে মুখে ঢুকে যেত । মোটা চুই এর শাঁস মাংসে মিশে যায় তাতে মাংসের একটা লোভনীয় গন্ধ স্বাদ দুটোই বাড়ে । ৫/৬ বছর আগে শেষ চুই খেয়েছিলাম ঢাকাতে । দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের শহর গ্রাম ছাড়া চুইএর ব্যাবহার নেই বা সবাই চেনেওনা । তো চুই বা চই এর কিছু পুস্তক বা পুথিগত বিবরন না দিলেই নয় । মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে একটা রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে চুইঝাল দেওয়া মাংস খাওয়া যায় ।
চুই ঝাল, বা চই ঝাল (বৈজ্ঞানিক নাম: Piper chaba) হচ্ছে পিপারাসি পরিবারের সপুষ্পক লতা। পান ও চুই ঝাল একই পরিবারের। চুই ঝাল গাছ দেখতে পানের লতার মতো। পাতা কিছুটা লম্বা ও পুরু। পাতায় ঝাল নেই। এর কাণ্ড বা লতা কেটে ছোট টুকরো করে মাছ-মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর এই টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। ঝাল স্বাদের হলেও চুইয়ের নিজস্ব স্বাদ ও ঘ্রাণ আছে। চই ঝাল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় প্রজাতি। এটি গোটা ভারত এবং এশিয়ার অন্যান্য উষ্ণ এলাকাসহ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিংগাপুর ও শ্রীলংকায় ও বাংলাদেশে জন্মে। উঁচু জায়গায় চুইঝালগাছ ভালো হয়। গোড়ায় পানি জমলে গাছ পচে যায়। গাছে ফুল-ফল হয়। বীজ থেকে চারাও হয়। তবে শিকড়সহ গিঁট কেটে লাগালে সহজে চারা হয়। গাছটির কাণ্ড বা লতা মসলা হিসেবে ব্যবহার হয়। খুলনা অঞ্চলে চুইঝালকে মসলা হিসেবে ব্যবহার করে চুইঝালের মাংস রান্না করা হয়। রান্নায় এর ঝাল খাবারের স্বাদ বাড়ায় আবার শরীরেরও কোনো ক্ষতি করে না। ঝোল জাতীয় মাছ-মাংস সব কিছুতেই স্বাদ তৈরি করে। এদের কাণ্ড, শিকড়, পাতা, ফুল, ফলের ঔষধি গুণ আছে। বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের জেলা খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং নড়াইল এলাকায় এই চুইঝাল মসলা হিসেবে খুব জনপ্রিয়। চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল, ৫ শতাংশ অ্যালকালয়েড ও পিপালারটিন আছে ৫ শতাংশ ও ৪ থেকে ৫ শতাংশ পোপিরন থাকে। এছাড়া পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সিজামিন, পিপলাসটেরল থাকে। এর কাণ্ড, শিকড়, পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি ভেষজগুণ সম্পন্ন। শিকড়ে থাকে দশমিক ১৩ থেকে দশমিক ১৫ শতাংশ পিপারিন।
চুইঝালের ঔষধিগুণ
• গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
• খাবারের রুচি বাড়াতে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে
• পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ সারাতে চুইঝাল অনেক উপকারী;
• স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে;
• ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করে এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে এবং শরীরের ব্যথা সারায়;
• সদ্য প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দ্রুত কমাতে ম্যাজিকের মতো সাহায্য করে;
• কাশি, কফ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও রক্তস্বল্পতা দূর করে;
• এক ইঞ্চি পরিমাণ চুই লতার সাথে আদা পিষে খেলে সর্দি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১৬