somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাল্যবিবাহ এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থা

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মাদারীপুর উপজেলার খালিয়ার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের আব্বাস আলীর কন্যা চাঁদনী আক্তার সামিরার বয়স (১২) বছর। গত কিছুদিন পূর্বে পারিবারিকভাবে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল গোবিন্দপুর গ্রামের বিদেশ ফেরত আহিদুলের (২৭) সাথে। কিন্তু এ বিয়েতে সামিরা অসম্মতি জানালেও অভিবাকরা তার মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে জোরপূর্বক তার বিয়ের আয়োজন করেন। কিশোরী সামিরা তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি, জোরপূর্বক আয়োজিত এই বিয়েকে ঠেকানোর জন্য কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সহপাঠিদের সহযোহিতায় সে স্থানীয় সাংবাদিকদের ঘটনাটি জানায়, পরে এস আই কামালের নেতৃত্বে পুলিশ বিয়ে বাড়িতে এসে সামিরার বিয়ে ভেঙ্গে দেয় এবং ঐ সময় সামিরার বাবা ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে সামিরাকে কোথাও বিয়ে দিবে না বলে পুলিশের নিকট অঙ্গীকার করেন।

গণমাধ্যেমে খবরটি প্রকাশিত হবার পর মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম সামিরাকে । মাত্র বার বছর বয়সে সে তার মূল্যবান ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে সাহস সঞ্চয় করে যে ভাবে অভিভাবকেদের অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে কঠোরভাবে মোকাবেলা করছে, সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন দিন দিন,যেন বেড়েই চলছে। আমাদের সমাজে প্রতিটি নারীদের উচিত শুধুমাত্র বাল্যবিবাহ নয়,যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা,এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকসহ যত ধরণের ঘৃন্যতম মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড রয়েছে তার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসা। বর্তমান বিশ্বে নারীরা এখন পিছিয়ে নেই, পুরুষের সাথে সমানভাবে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন বিভিন্ন পেশায় এবং অবদান রাখছেন নানা রকম সামাজিক কর্মকান্ডে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, এমন এক ধূসর সময় ছিল পৃথিবীতে, যখন নারীদের শুধু ভোগের বস্তুই মনে করা হতো। পরিবার বা সমাজে তাদের চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য দিত না, অনেকের ধারণা ছিল, নারী মানেই যৌনক্ষুধা মোটানোর আশ্রম আর সন্তান উৎপাদনের মেশিন। বিশেষ করে আমাদের পুরুষশাষিত সমাজে নারীরা ছিলেন বারাবরই অবহেলিত এবং প্রতারিত। এমনও সময় পেরিয়ে এসেছি, যে সময়টাতে অধিকাংশ পরিবারে কন্যা সন্তান জন্মলে সদ্য প্রসুতি মায়ের উপর নেমে আসতো পারিবারিক, সামাজিক এবং বিভিন্ন মানসিক নির্যাতন, যেটা শুধুমাত্র ভুক্তভোগিরা ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে আদি বর্বরতার যুগ পেরিয়ে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ নারীরা এখন অন্য কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এবং অনেকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যথাযোগ্য ভ’মিকা পালন করে সফল নারী হিসাবে সমাজে প্রতিষ্টিত হচ্ছেন। বিশ্বের অধিকাংশ নারীরা যখন সোনালি স্বপ্ন চোখে নিয়ে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন আগামীর পথে, ঠিক তখনই গণমাধ্যেমের কিছু কিছু খবরাখবর সত্যিই ভাবনায় ফেলে দেয়। প্রশ্ন জাগে আমরা কি আসলেই আদি যুগের ধ্যান ধারণা থেকে সম্পূর্ন বেরিয়ে আসতে পেরেছি? এখনো কেন জানি মনে হয় সমাজের অধিকাংশ অভিবাবকরা তাদের সনাতন ধ্যান ও ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। তাদের অনেকেরই ধারণা, মেয়েদের লেখাপড়া করে কি হবে? তাদের তো ঘরেই থাকতে হবে। যে পুরুষ দু’বেলা দু’মুটো ভাত এবং বছরে এক জোড়া কাপড় দিতে পারবে, সে পুরুষই তাদের মেয়ের জন্য উপযুক্ত । যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা নিজ মেয়েকে উক্ত পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাচঁবেন। কিন্তু যে পুরুষটির সাথে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন, সে পুরুষটা যদি মেয়ের বয়সের চেয়ে দ্বিগুণ বয়স এবং অ-শিক্ষিত হয় সেটাকে তারা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখেন না। তারা ভাবেন, বিয়ের জন্য শুধু একটি পুরুষ খুবই প্রয়োজন, তার শিক্ষা, বয়স এবং আচার আচরণ, অতীত কোন কিছুই নিয়ে তারা মোটেই তোয়াক্কা করেন না । এমনও দেখেছি বিয়ের বয়স হয়নি, লেখাপড়া বন্ধ করে দাদার বয়সী লোকের কাছে পনের, ষোল বছরের মেয়েদের বিয়ে দিতে। কিন্তু বিয়ে দেবার সময় একটি বারও অভিবাকরা ভাবেন না যে, মেয়ের নিজস্ব কোন মাতমত থাকতে পারে, বা বয়সের দ্বিগুন পুরুষের সাথে অল্প বয়সী একটি মেয়ে কি ভাবে বাকীটা জীবন কাটাবে? তা ছাড়া অনেকাংশে দেখা যায় অল্প বয়সে বিয়ের পর ঘন ঘন বাচ্চা প্রসবের দরুণ অনেক মেয়েরা পুষ্টিহীনতায় ভুগেন এবং যথাসময়ে উপযুক্ত সু- চিকিৎসার অভাবে অনেক নারীরা মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ এক জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধের দাবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে এবং তা বন্ধের লক্ষে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের আওতায় বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এ আইনে শিশুর বিয়েও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ সমস্যা প্রতিরোধে যথাযত আইন থাকলে ও বাস্তবে এ আইনের কতোটুকু ব্যবহার হচ্ছে? দ্য মেজরিটি এ্যক্ট অনুসারে ১৮ বছরের নীচে কোন ব্যক্তি ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন না এবং তারা কোন দেওয়ানী চুক্তিও করতে পারবেন না। মুসলিম বিয়ে যেহেতু একটি দেওয়ানি চুক্তি, কাজেই একজন নাবালক বা নাবালিকা তারা নিজে কোন চুক্তি করতে পারবেন না। তা ছাড়াও ১৯৭৪ সালের শিশু আইনটি সংশোধন করে ১৯৮৪ সালের সংশোধন অনুসারে বিয়েতে বর ও কনের বয়স পরিবর্তন করে বরের ক্ষেত্রে ২১ এবং কনের ক্ষেত্রে ১৮ নীচে বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারী শিশু আইন ও অন্যান্য আইনে ১৬ থেকে আটারো বছর, এমন কি ২১ বছর বয়সী ব্যক্তিকে শিশু হিসাবে গণ্য করা না হলেও ১৯৮৪ সালের সংশোধনে ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং ১৮ বছরের কম বয়সী নারীকে বৈবাহিক ব্যাপারে শিশু ও নাবালক বা নাবালিকা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। ফলে যারা নিজের ইচ্ছায় অনুপযুক্ত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন অথবা যাদের অভিবাবক কর্তৃক অনুপযুক্ত বয়সে বিবাহ সম্পন্ন হবে, তাদের উক্ত আইনের ৪, ৫, ও ৬ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তাদের সর্বোচ্চ এক মাসের জেল অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।

আমরা যারা বিলেতে বসবাস করি সবাই জানি, বিলেতে কোন ছেলে বা মেয়েকে ১৮ বছরের নীচে বিয়ে দেওয়া যায় না এবং জোড়পূর্বক কোন ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলে অভিবাকদের কঠোর আইনের কাঠগড়ায় দ্বাঁড়াতে হয়। আর এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রায় সব অভিবাকরা তাদের সন্তানকে ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে দিতে বিরত থাকেন। এ ছাড়াও আগের তুলনায় বিলেতে অধিকাংশ অভিবাকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে এখন খুবই সচেতন, সন্তানদের লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দ্বাড়ানোর জন্য যা যা প্রয়োজন নিজ সাধ্য অনুযায়ী তারা সব ধরণের সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে চিত্র একটু অন্য রকম। বিগত দিন এবং বর্তমানে অনেকাংশে দেখা যাচ্ছে অনেক পরিবারের মেয়েদের বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স হবার পূর্বেই অভিবাকরা চিন্তায় পড়ে যান। তবে এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে দারিদ্রতা, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, লিঙ্গবৈষম্যসহ নানা ধরণের একাডেমিক চাপ। কিন্তু তাই বলে, নিজ সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা না করে তাদের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে অভিবাকরা যখন মানবতা বিরোধি কঠোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন খুবই খারাপ লাগে। আমাদের সমাজে প্রতিটি অভিবাবকদেরই উচিত, এ সব কুসংস্কার পরিত্যাগ করে নিজ সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে তাদেরকে সহযোগিতা করা এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া। বাল্য বিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে সমাজে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও সাহসী হতে হবে এবং জাতীয় এই সমস্যার বিরুদ্ধে সামাজিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রিয়ভাবে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করি।



রচনাকাল ১০/১২/২০১০
লন্ডন-


সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ২:৩০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×