ঐতিহাসিকভাবে, ৭০০০ বছর ধরে বাঘ চৈনিক সংস্কৃতির প্রতীক যা সে দেশের গল্প-কথক, গায়ক, কবি, শিল্পী আর কারিগরদের অনুপ্রাণিত করে আসছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, এখন পর্যন্ত চীনে সবচেয়ে পুরোনো যে বাঘের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ সালের, নিওথিলিক যুগের। সেই দিন থেকে আজ অবধি বাঘ এশিয়ার দেশগুলোতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
এশিয়ার পৌরাণিক শ্রুতিগুলোতে বাঘের গুরুত্বঃ
বাঘ এশিয়ার সকল ধর্মীয় বা জাতীয় বিশ্বাসগুলোর একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। বাঘ ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় পশু, মালয় বাঘ মালয়েশিয়ার জাতীয় পশু, কোরিয়ার জাতীয় বিশ্বাসের সাথেও বাঘ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় এই দেশগুলোর আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে বাঘ এমন ভাবে মিশে গিয়েছে যে সেসব দেশের পৌরাণিক কাহিনী, মহাজাগতিক বিষয়, ধর্ম এবং গুপ্ত দর্শনের মূল উপাদানে পরিণত হয়েছে এই প্রাণী।
প্রাচীন চীনে বাঘ ছিলো চৈনিক রাশিচক্রের ১২টি পশুর একটি। সেই সময়ের চীনের অধিবাসীরা বিশ্বাস করতেন বাঘ রাশির জাতকরা প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন, আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী হয়। একই সাথে 'বাঘ বছর'-এ জন্ম নেওয়া শিশুরা ইচ্ছাশক্তিতে বলিয়ান থাকে, খুব বড় বীর হয় এবং শারীরিক ও অভ্যন্তরীণ শক্তিতে থাকে ভরপুর। সেই সাথে এই প্রাণীর দেহ সৌষ্ঠবের মাঝে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতা আর উগ্রতা চরিত্রের উল্টো দিক হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। এগুলোর সাথে সাথে আরো অনেক বিষয় আছে যা বাঘের গুণে গুণান্বিত মানুষের জীবনকে এই জড়জগতে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।
অনেক দিন ধরেই এই প্রাচীন চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলো রাজনৈতিক ও সামরিক এজেন্ডার অভিস্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে পূণঃব্যাখ্যিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোরিয়ার চোজন রাজবংশের (১৩৯২ - ১৯১০) সেনা অফিসাররা সম্মান পেতে ও ভয় পেতে বাঘের সাজে সাজানো হতো। ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল সাল পর্যন্ত কোরিয়া যখন জাপা্নের উপনিবেশ ছিলো, কোরিয়ার জাতীয়তাবাদীরা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রতীক হিসেবে বাঘের চরিত্রকে পুনরায় ব্যবহার করে।
ছবিঃ চীনের পৌরাণিক কাহিনী'র 'সাদা বাঘের সাথে হাত্তারা সঞ্জা'
এশিয়ার পৌরাণিক শ্রুতি আর উপকথাগুলোতে বাঘ সম্পর্কে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং মহাজাগতিক ধারণাঃ
চীনে ‘অতি-বুদ্ধিমান’ চার প্রাণী’র একটি হচ্ছে বাঘ। অন্য তিন প্রাণী হচ্ছে- ড্রাগন, ফিনিক্স এবং কচ্ছপ। চীনের অত্যন্ত সম্মানীয় এই চারটি প্রাণীই সে দেশের শিল্পবিদ্যা এবং কারুশিল্পের ডিজাইনগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে। সৃষ্টির পর থেকে, ‘তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মে’ রাগকে জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টিতে পরিণত করার প্রতীক হিসেবে বাঘের চামড়াকে ব্যবহার করে আসছে। বিশেষতঃ এই ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, বাঘের ছাল পরে ধ্যানে বসলে ক্ষতিকর আত্মা থেকে নিজেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সেই সাথে, নাক্ষত্রিক ডাইমেনশন বিশ্লেষণ করার সময়ও এটা কাজে লাগে।
এই বিশ্বাস থেকেই তাও ধর্মের নেতা বংশানুক্রিক ভাবে জিয়াংজি প্রদেশের রাজধানী নেনচ্যাং-এ অবস্থিত ড্রাগন-বাঘ পর্বতে বাস করে আসছেন। সেই শহরের বাড়ি আর বৌদ্ধ মন্দিরগুলোর দেয়ালে বাঘের ছবি আঁকা থাকে। ‘বাঘ গর্জন করছে আর ড্রাগন গান গাইছে – পৃথিবীটা শান্তিময়’-এর মতো স্থানীয় কবিতা বাঘ ও ড্রাগনকে একই পটভূমিতে নিয়ে আসে। এই দুই প্রাণী চৈনিক শক্তিবলয় য়িন এবং ইয়ান-এর দুই পরস্পর বিপরীত মেরুকে বর্ণনা করে। সেই সাথে এই প্রাণী দুটো নারী ও নর শক্তির প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ।
চীনে বিশ্বাস করা হয় যে, য়িন এবং ইয়ান-এর মিথস্ক্রিয়া থেকেই সকল সৃষ্টির আকৃতি গঠিত হয়েছে। এই দুই শক্তির সঠিক মিশ্রনে জগতের সকল শুভ’র সৃষ্টি আর অসাম্য সংমিশ্রণে অশুভ উৎপন্ন হয়েছে। বাঘকে ইয়েং শক্তির শক্তিশালী প্রকাশ আর প্রতীকী প্রতিরূপ হিসেবে ধরা হয়। বাঘ প্রকৃতির পৌরষিক রুপ। এই কারণেই বাঘকে সূর্য, গ্রীষ্ম ঋতু এবং আগুনের প্রতিনিধি। প্রাচীন কালে বাঘকে সকল প্রাণীর রাজা হিসেবে মনে করা হতো। বাঘের কপালে যে চারটি ডোরা কাটা দাগ দেখা যায়, সেটাই বাঘের রাজা হওয়ার প্রমাণ। চৈনিক ভাষার ‘ওয়েং’ (王) বা ‘রাজা’ চিহ্নটি বাঘের কপালের ঐ চার ডোরা কাটা দাগ থেকে এসেছে বলে অনেক চৈনিক পন্ডিত মনে করেন।
ছবিঃ ১৫৯৩ সালে অংকিত তাও ধর্ম অনুসারীদের অনুশীলণঃ বাঘ ও ড্রাগনের মিলন
প্রাচীন চীনা পুরাণের প্রাথমিক স্তরে এটা মানা হয় যে, মহাজাগতিক শক্তিগুলো যখন বিশৃঙ্খলাবস্থায় ছিলো, পাঁচটি বাঘের কারণেই পুরো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ভেঙ্গে পড়েনি। পূরাণগুলোর কোথাও কোথাও কিছুটা অন্য রকম হলেও, এশিয়ার এই পাঁচটি বাঘের অর্থ করলে যা দাঁড়ায়, তা নিম্নরূপঃ
হলুদ বাঘঃ সকল বাঘের সর্বোচ্চ শাসক, সূর্যের প্রতীক
লাল বাঘঃ গ্রীষ্মের শাসক, আগুনের অধিকর্তা
কালো বাঘঃ শীতের শাসক, পানি’র অধিকর্তা
নীল বাঘঃ বসন্তের শাসক, মাটি’র অধিকর্তা
সাদা বাঘঃ শরতের শাসক, ধাতব পদার্থের অধিকর্তা
উপরের পাঁচটি বাঘের প্রত্যেকটিই জটিল মহাজাগতিক, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পৃথিবীর আকৃতি ও আয়তনের পরিমাপ-সংক্রান্ত গণিতের সাথে সংযুক্ত জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন, ‘সাদা বাঘ’ শুধু শরতের শাসক নয়, পশ্চিম ও সেই দিকে অবস্থিত সকল ঘটনারও শাসনকর্তা। এই প্রাণীটিকে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘ওরিয়ন’ নক্ষত্রমণ্ডলে রুপায়িত করা হয়। শরতের আকাশে এই নক্ষত্রমন্ডলীই সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখা যায়। প্রাচীন চীনের অধিবাসীরা মনে করতেন, ৫০০ বছর বাঁচার পর একটি সাধারণ বাঘ ‘সাদা বাঘ’-এ পরিণত হয়। এরপর সেটা ১০০০ বছর ধরে বেঁচে থাকে। তাঁরা এটাও মনে করতেন যে, একটি বাঘের মৃত্যুর পরে সেটার আত্মা মাটির নিচে চলে গিয়ে ‘অম্বর’-এর রুপ ধরে। এই প্রাচীন বিশ্বাস থেকেই আধুনিক চীনে ‘অম্বর’-এর অর্থ ধরা হয় ‘বাঘের আত্মা’ হিসেবে।
===================
দুই পর্বের সিরিজের ১ম পোস্ট
===================
তত্থ্যসূত্রঃ
CNArtGallery. 2013. "Chinese Tiger in Painting and Its Symbolic Meaning". Artisoo Paintings – Bring Chinese culture to the world. Available at: Click This Link
Meyer, A. 2013. "Tigers In Culture And Folklore". Tigers – The most majestic cats in the world. Available at: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১২:১১