এ দেশের গ্রামবাংলার নানা প্রজাতির শালিক পাখিরাও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। পাখিদের মধ্যে শালিকরা জনবসতির আশপাশে থাকতেই বেশি ভালবাসে। সেই শালিক পাখির অনেক প্রজাতি এখন আর গ্রামগঞ্জে সহজে নজরে পড়ে না। তবে ভাত শালিক এবং গোবরে শালিকের দেখা মিললেও এই দুটি প্রজাতির সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। বিরল প্রজাতির শালিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বামন শালিক, চিতা শালিক, ঝুঁটি শালিক, গাঙ শালিক, ভাত শালিক, গোবরে শালিক, ময়না আর কাঠ শালিক।
বামন শালিক : এই প্রজাতির শালিককে কোথাও কোথাও শক্সখ শালিক নামেও ডাকা হয়। এরা সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের চোখ দুটো গোলাকার। ঠোঁট থেকে শুরু করে বুকের পালকের রং উজ্জ্বল গোলাপি এবং হলুদ মিশেল। ঠোঁট, পা হলুদ এবং লেজের নিচের অংশের পালক ধূসর। মাথার ওপর ডানা ও লেজের অংশের পালকের রং তেল চিকচিকে নীল। এদের প্রধান খাদ্য ফল, ফুলের মধু এবং গাছগাছলির পোকামাকড়। এদের ইংরেজি নাম হচ্ছে Brahminy Starling আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Temnuchus Pagodarum.
চিত্রা শালিক : অতি বিরল প্রজাতির শালিক গোত্রের চিত্রা শালিক পরিযায়ী পাখি। শীতকালে দেশের পাহারি বনাঞ্চল ও সুন্দরবনে এদের দেখা যায়। সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা আকৃতির এই পাখির পালকের রং সাদা গোলাকার ফুটকিযুক্ত খয়েরি। ঠোঁট লম্বা এবং ধারাল। এরা গাছের পোকামাকড় আর ফুল খেয়ে থাকে। গাছে দলবদ্ধ হয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসে। এদের ইংরেজি নাম হচ্ছে Common Starling, আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Sturmus Vulgaris Linnaeus.
ঝুঁটি শালিক : স্থানীয় প্রজাতির এই শালিক এখনও গ্রামেগঞ্জে দেখতে পাওয়া যায়, তবে খুব বেশি নয়। এরা লম্বায় সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার হয়। এদের ইংরেজি নাম হচ্ছে Jungle Myna, আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Acridotheres Fuscus. এদের ঠোঁট লাল টকটকে। চোখ দুটো গোলাকার উজ্জ্বল এবং চোখের পাশে গাঙ শালিক বা ভাত শালিকের মতো লাল-হলুদ আভা নেই। পাগুলো লালচে এবং পিঠ ও মুখের পালক কিছুটা কালচে। এছাড়া বুকের পালক ধূসর ও পাটকিলে মিশেল রংয়ের। ঠোঁটের ওপর এদের ছোট ঝুঁটি থাকে গাঙ শালিকের মতো। এরা ফল, ফুলের মধু, পোকামাকড় খেয়ে থাকে।
গাঙ শালিক : স্থিতু প্রজাতির এই শালিক মূলত বড় নদী, বিলের উঁচু পাড়ে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এরা সর্বভুক। প্রয়োজনে ছোট মাছও এদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ভাত শালিক আর ঝুঁটি শালিকের মতো দেখতে হলেও কিছুটা ঠোঁট মোটা উজ্জ্বল হলুদ রংয়ের। ঠোঁটের ওপর উঁচু পালকের ঝুঁটি এবং দুচোখের পাশে লম্বা লাল আভায় এদের আলাদা করে চেনা যায়। এদের বুকের পালক ধূসর এবং পিঠ ও মাথার পালক পাটকিলে রংয়ের। সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা। গাং শালিকের ইংরেজি নাম Bank Myna আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Acridotheres Ginginianus.
ভাত শালিক : এই প্রজাতির শালিক এখনো সর্বত্রই দেখা যায়। তবে সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে বলে বিরূপ অবস্থাতেও টিকে আছে। ভাত শালিক সবকিছুই খায়। এরা মানুষের বসতবাড়ির আশপাশে থাকতেই ভালবাসে। মানুষের আহার্য ভাত, তরকারি, চাল, চিড়া, মুড়ি খেতে এরা অভ্যস্ত। এমনকি সুযোগ পেলে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে খাবার খেয়ে পালিয়ে যায়। ২৩ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে ভাত শালিকের সঙ্গে গাঙ শালিকের যথেষ্ট মিল থাকলেও এদের ঝুঁটি নেই আর ঠোঁট ছোট এবং দুচোখের পাশে লম্বা টানা হলুদ রং। লেজের নিচের অংশের পালক সাদা আর ওপরে কালচে। এছাড়া গায়ের পালক উজ্জ্বল পাটকিলে এবং ঠোঁট থেকে গলা পর্যন্ত পালকের রং কালো। পায়ের রং হালকা হলুদ। এরা যত্রতত্র চিকন ডালপালা ও আঁশ দিয়ে গোলাকার বাসা বানায়। এদের ইংরেজি নাম Common Myna আর বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres Tristis.
গোবরে শালিক : এই প্রজাতির শালিক সর্বত্র দেখা যায়। এদের গোশালিক নামেও ডাকা হয় কোথাও কোথাও। সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা এই প্রজাতির ইংরেজি নাম হচ্ছে Asian Pied Starling এবং বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Gracupica Contra Linnaeus. এদের ঠোঁট লম্বা এবং হলুদ। কালো পুঁতির মতো দুটো চোখ এবং চোখের দুপাশে, দুডানার পাশে লম্বা রেখার মতো সাদা পালক এদের আকর্ষণীয় করে তোলে। এদের বুকের পালক সাদা, লেজটা কালো রংয়ের। পিঠ, মাথা, গলার পালকের রং কালো। যে কোনো গাছে খড় দিয়ে বানানো এদের অগোছাল বাসা সবার চোখেই পড়বে। এরা মূলত পোকামাকড় খেতেই বেশি ভালবাসে। এদের গোবরে শালিক নামকরণের অন্যতম কারণ এদের গরু, ঘোড়াসহ অন্যান্য পশুর গোবর খুঁটে খুঁটে পোকামাকড় খেতেই দেখা যায় বেশি।
ময়না : পাখিদের মধ্যে শেখানো কথা বলতে পারদর্শিতার কারণে শালিক প্রজাতির ময়না অতি মূল্যবান একটি পাখি, যা এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে। এদের মূলত পাহাড়ি বনাঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। তবে এখন সংখ্যায় অনেক কম। ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা এই পাখির ইংরেজি নাম Hill Myna আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Gracula Religiosa Linnaeus. এদের লম্বা হলুদ ঠোঁট এবং দুচোখের পাশে হলুদ দাগ ছাড়া শরীরের পালক চকচকে নীল রংয়ের। এরা ফুল, ফল, মধু এবং পোকামাকড় খেতে অভ্যস্ত। গাছের কোটরে বাসা বানায়। এক বাসায় জুটি বেঁধে থাকে অনেক দিন।
কাঠ শালিক : এ দেশের গ্রামগঞ্জের শালিক গোত্রের অতিচেনা পাখিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কাঠ শালিক। অবাধে বৃক্ষ নিধন এবং জমিতে বিষাক্ত কীটনাশকের প্রয়োগ সুন্দর এই পাখিটির সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস করেছে। আগে সর্বত্র এদের দেখা গেলেও এখন দুর্গম বনাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় এদের বেশি দেখা যায়। ইদানীং গাইবান্ধাসহ মফস্বল শহরগুলোতেও বিচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। লালচে, ধূসর, খয়েরি ও পিঙ্গল রংয়ের মিশেল এই পাখিটি আমাদের চেনা শালিকের চেয়ে কিছুটা ছোট। এরা ১৯ থেকে ২১ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। ইংরেজি নাম Grey headed Myna এবং এদের বৈজ্ঞানিক নাম Sturnia Malabarica. কাঠ শালিকের শরীরের নিচের অংশের বুক, পেট আর লম্বা লেজের পালকের রং উজ্জ্বল বাদামি, পা লালচে এবং উজ্জ্বল বড় চোখ। গলায় রয়েছে মালার মতো অতিরিক্ত ধূসর পালক।
এরা গাছের কোটরে গর্ত করে বাসা বানায় এবং বসন্ত থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত এদের প্রজনন মওসুম। এ সময় বাসায় তিন থেকে চারটে ছোট লম্বাটে নীলচে রংয়ের ডিম পাড়ে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে সব রকম পোকামাকড় আর ফল। পরিবেশবান্ধব সুন্দর এই শালিক প্রজাতির পাখিদের সংরক্ষণ অতি জরুরি। নইলে এরা চিরতরে বিলুপ্ত হবে বলে পাখিবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।
উৎস: ইনটারনেট

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


