কথাই বলতে পারি না। কথা বলি অথচ আমার শ্রোতাগণ তা বুঝতে পারে না। এমন কতবার হয়েছে যে, শ্রোতাদেরকে বোধগম্য করার জন্য আমার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত কথা, শব্দ, বাক্য, অনুভূতিকে বারবার উচ্চারিত করতে হয়েছে। বিরক্তিত হয়েছি আমি, বিরক্তিত হয়েছে আমার শ্রোতাগণ। সকাল থেকে রাত অবধি কত মানুষের সাথে কথা হয়। কথা বলি বন্ধুদের সাথে, সহপাঠী, কলিগ, শিক্ষকদের সাথে। সবারই একই অনুরোধ-কি বললে?শুনিনি আবার বল, বুঝিনি আবার বল। কেউ কেউ ধমকের স্বরে বলেছে- এই ছেলে! ভাল করে কথা বল, আস্তে আস্তে বল, এই ছেলে তুমি কথাই বলতে পার না তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কথা বলি মোবাইলে। মোবাইলের অপর প্রান্তের ব্যক্তি বলে- বুঝিনি আবার স্পস্ট করে বলেন।প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচচ্ মাধ্যমিকের ক্লাসগুলোতে শিক্ষক যখন বলতেন এ বিষয়টি কে জান? হাত তুলো, অথবা বলত তোমাদের মধ্যে কে পড়াটি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে পারব? তখন আমিই হাত তুলতাম এই বলে “স্যার! আমি পারব”। সবার সামনে গিয়ে পড়াটি বলতাম। স্যার ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞেস করতো। তোমরা কেউ কি কিছু বুঝলে? সবাই বলত “`না স্যার বুঝিনি!” মনের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠত। কি ব্যাপার আমি তো ঠিকই বললাম। পরে স্যার বলতেন-এই ছেলে তুমি এতক্ষণ কি বললে- আমরা তোমার কোন কথাই বুঝতে পারিনি। ভাল করে বল (ধমকের স্বরে)। আবার বলতাম। আবারও একই অবস্থা। এতদ্রুত বলতাম যে একাধিকবার কেন, একশবার বললেও কেউ কিছু বুঝবে না। স্যার আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে দিতেন। আরেকজনকে ডাকতেন পড়াটি বুঝিয়ে বলার জন্য। আমি মাথা নিচু করে বসে পরতাম। কতজন কত কথা বলেছে আজঅবধি বলছে-ভাল করে কথা বলো, আস্তে আস্তে বল। না। এখনও ঠিক হয়নি। আমার কথা হয় দ্রুত উচ্চারিত। একটি শব্দ উচ্চারণ শেষ হতে না হতেই আরেকটি শব্দে চলে যাই। একটি বাক্য যখন অনুসৃত হয় তখন বাক্যস্থিত সকল শব্দ এক নিশ্বাসে বলে ফেলি। বাক্য শেষ হলে আরেকটি বাক্যে চলে যাই। প্রতিটি শব্দকে তার যথাযথ সময় দেই না। আগে কথা বলতাম তার একটা নিদির্ষ্ট পরিধি ছিল। এখন কথা বলি-বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, ছাত্রউপদেষ্টা, বিভাগীয় সভাপতি, প্রশাসনের উচচ্পদস্থ কর্মকর্তা, থানার ওসি, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, ছাত্রদলের আহবায়ক, ক্যাম্পাসের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতিসহ আরো অনেকের সাথে কথা বলতে হয়। আমার নিজ অফিসের সাথে প্রায় প্রতিদিনই মোবাইলে কথা বলতে হয়। কথা বলি আরো অনেকের সাথে। কথা বলব আরো অনেকের সাথে। কিন্তু আমার কথা বলার পদ্ধতি তো পরিবতর্ন হচেছ না। যখন দেখি কেউ সুন্দর করে কথা বলে- তারা এতো ধীরে ধীরে কথা বলে যে তাদের কথায় প্রতিটি শব্দ গণনা করা যায়। তখন নিজেকে অসহায় মনে করি। আহা!! এমন করে যদি কথা বলতে পারতাম। ধীরে ধীরে কথা বলার জন্য চেষ্টা করিনি- এটা বলা যাবে না। অনেকে বলেছে শক্ত কোন খাবার চিবিয়ে খেতে। যেমন –পেয়ারা, সিমের বিচিসহ আরো অনেক কিছু। যারা সুন্দর করে কথা বলে –তাদের কথাও শুনি। টিভিতে উপাস্থকদের কথা শুনি, কথা শুনি-হানিফ সংকেতের, মোবাইলে কাউকে ডায়াল দিলে যদি নাম্বারটি বন্ধ পায় তাহলে মোবাইল অপারেটর থেকে ভেসে আসা রেকর্ড গুলো বার বার শুনি। মিথ্যে নম্বর বানিয়ে ডায়াল দিই-আর তাদের কথা শুনি। দ্রুত কথা বলার জন্য আমি অনেক অপমানিত হয়েছি। বাসার বড় ভাই, বোন, আম্মুসহ সবার কাছে প্রতিদিন ধমক খেতে হয়। ধমক খাচ্ছি। না আর তা হতে পারে না। এখন ৫ম সেমিষ্টারে পড়ি। আর কয়দিন পর ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যাবো। সিদ্ধান্ত নিলাম। কথা আস্তে বলা ও শুদ্ধ করে বলার জন্য যুদ্ধে নামব। আমাদের ক্যাম্পাসে একটি সংগঠন আছে । নাম তার স্বনন। এটি আবৃত্তি সংগঠন। এটিই দেশের প্রথম আবৃত্তি সংগঠন। ক্যা্ম্পাসের ইবলিশ চত্ত্বরে-তারা বর্ষাকে বরণ উপলক্ষে একটি কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার কুদরাত-ই – খোদা বাবু ভাই আমাকে পাঠালেন অনুষ্ঠানটি নিউজ কভার করার জন্য। সেখানে তাদের কবিতা আবৃত্তি শুনে আমি অবিভূত হলাম। দেখি তারা এতো সুন্দর ও ঝরঝর করে কবিতা পাঠ করে যে- তাদের উচ্চারিত কথা গুলো আমি স্পষ্ট শুনতে পারি, গুণতে পারি। আমার এখানেই আসা উচিত। এখানে আমি কবিতা আবৃত্তি শিক্ষার মধ্য দিয়ে নিজের কথা কে আয়ত্তে আনব। আমার কথাকে বোধগম্য করে তুলব শ্রোতাদের নিকট। স্বনন বসে শহীদ মমতাজউদ্দিন কলা ভবনের ১৩০ নং কক্ষে। একদিন ওই কক্ষে গিয়ে উপস্তিত হই। জানাই আমার আগ্রহের কথা। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়- স্বননে আসতে হলে একটি অডিশন দিতে হয়। অডিশনে বাছাই করা শিক্ষার্থীদেরকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের আডিশন কয়েক মাস পরে হবে। তবে আপনি এ কয়দিন আসতে পারেন-এসে বসে বসে দেখবেন আমরা কিভাবে পড়ি। কিভাবে আবৃত্তি করি। আমি বললাম-হ্যা আমি তাই করব। এখন থেকে নিয়মিত আসব। এভাবে তিনমাস আমি নিয়মিত সংগঠনে গেলাম। আমরা কি কি ভুল উচ্চারণ করি তা জানলাম। সেই সাথে অনেক শু্দ্ধ উচ্চারণও শিখলাম। ইতোমধ্যে সংগঠনের সবার সাথে একটু ভালো সম্পর্ক হয়েছে। তাদের নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। তাদের পিকনিনিকেও অংশগ্রহণ করেছি। আমি কিন্ত তাদের সংগঠনের সদস্য এখনও হইনি!!! তাই আমাকে অডিশনে অংশগ্রহণ করতে হল। অডিশনে অনেক শিক্ষার্থী এসেছে। আমার ভয় লাগছিল। আমি টিকব কিনা? আমার অডিশন ভালো হয়নি। ওখানে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল –স্বননে তো প্রতিদিন আসতে হয় আপনি কি পারবেন আসতে? আসি বললাম-হ্যাঁ পারব। প্রতিশ্রুতি দিলাম-ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই আসব। তারপর তারা আমাকে বাছাই করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করল। শুধু শেখার প্রতি অদম্য আগ্রহ আছে বলে তারা আমাকে গ্রহণ করল। অডিশনে যারা টিকেছে তারা আমার থেকে অনেক সুন্দর করে কখা বলতে পারে। তাদের তুলনায় আমি কিছুই না।
আজকে (৯ অক্টোবর-১১) স্বননে বাছাইকৃত কর্মীদেরকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বরণ করে নিবে। সেই জন্য ছোট্ট একটি আয়োজনেরও ব্যবস্থা করেছিল।
এরই মধ্যদিয়ে আামি কথা বলতে পারার যুদ্ধে শামিল হলাম। আমার কেন যেন দৃঢ় বিশ্বাস আমি পারব। হ্যা সুন্দর করে কথা বলতে পারব। ধীরে ধীরে কথা বলতে পারব। কারণ এটি স্বনন। তাঁরা কথা উচ্চারণ শিখায়, কথা বলা শিখায়, কোন শব্দে কতটুকু সময় দিয়ে বলতে হবে তা শিখায়, শিখায় শু্দ্ধ উচ্চারণ।
শাকির ইকরাম
সময়: সকাল ৭:৩০
১০.১০.১১
শের-ই-বাংলা হল
রাবি
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১১ সকাল ৮:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



