সকাল সাতটায় বিশ্ববিদ্যালয় মেইন গেটে উপস্থিত থাকার কথা। ওখানে বাস থাকবে। উদ্দেশ্য মুজিবনগর, মেহেরপুর যাব। আমি আসলাম সাতটা আট মিনিটে। একে একে সবাই আসতে লাগল। আমার সহপাঠী বন্ধু সোহাগ, রাকিব ও বাত্তানি ওখানে এসে জড়ো হল। ডিপা্র্টমেন্টের ছোট ভাইও অনিক ও আরা আছে। দেখে খুব ভাল লাগছে। এতো জড়ো-ছাত্র দেখে ডিবি পুলিশ আমাদের জিজ্ঞাসা করল, জটলা কিসের? রুমেল ভাই বলল-আমরা পিকনিক যাচ্ছি। তা শুনে পুলিশ সটে পড়ল। গাড়ির চালক তার সীটে বসলেন ৮:০৮ এ। গাড়ি স্টার্ট্ দিলেন। ১২০ জন ছাত্র দুটি বাসে করে শুরু হল যাত্রা। আটটা আটে যখন চালক গাড়ি স্টা্র্ট্ দিলেন তখন মনে পড়ে গেল কোলকাতার আর্ট্ ফিলম ‘লোকাল ট্রেণ আটটা আট’ । ঐ মুভিতে পরিচালক সমাজের অনেক অযৌক্তিক প্রথা, দুর্নীতি, অমানবিক অত্যাচার, রীতি ভাঙতে চেয়েছেন। আমরা কি আমাদের এ যাত্রার মধ্য দিয়ে দেশের অন্যতম ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত মুজিবনগর অবলোকন করে আমাদের সমাজটাকে পরিবরতন করতে পারব? গাড়ি চলছে তার নিজ গতিতে। বানেশ্বর, চারঘাট, বাঘা, ঈশ্বরদী, লালন সেতু হয়ে গাড়ি যাচ্ছে। আমার সাথে বসে আছে বন্ধু সোহাগ। তবে এ যাত্রায় বা পিকনিকে অনেক অব্যবস্থাপনা দেখলাম। গাড়ি ছাড়ার সময় কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। পিকনিক কমিটি কোন ঘোষণা ছাড়াই গাড়ি ছাড়ার অনুমতি দিলেন। এরকম হওয়া উচিত ছিল যে, “আমরা সবাই মুজিবনগর, মেহেরপুর যাচ্ছি, গাড়ি দেরীতে ছাড়ার জন্য আন্তরিকভাবে দু:খিত। রাস্তায় এসব জায়গায় বিরতি দেয়া হবে। এতটার মধ্যে পৌছা হবে, আবার এতটার মধ্যে ক্যাম্পাসে ফিরা হবে। রাত এতটা বাজতে পারে।” এমন কিছুই বলা হল না। পিকনিকের শুরু থেকে শেষ পযন্ত এরকম অনানুষ্ঠানিকতা ছিল।
আমি সাথে করে কয়েকটা সাপ্তাহিক পত্রিকা ও একটি কবিতার বই ঐকতান নিলাম। গাড়ি ছুটছে । আর আমি পত্রিকা পড়ছিলাম। আমি আর সোহাগ বসছিলাম একেবারে সামনের সীটে। পত্রিকা পড়ছিলাম আর ভাল না লাগলে দু’জনে ভবিষ্যত প্লান নিয়ে গল্প করছি। পেছনের অংশে চলছে গান আর হৈ হট্টগোল, হাসি আনন্দ। হিন্দি গানের তালে তালে সেকেন্ড, থার্ড্ ইয়ারে ছাত্র-ছাত্রীরা নাচা নাচি করছে। তবে গান শুনার মধ্যে হিন্দি গান শুনার প্রতি ঝোক একটু বেশী ছিল। প্রথমেই হিন্দি গান দিয়ে শুরু। যাওয়ার সময় আমি গনণা করে দেখলাম ৩১টি হিন্দি, ১৪টি বাংলা গান, ৩টি ইংলিশ গান ও একটি রক গান বাজানো হয়। গানের তালে তালে নাচানাচিতে কোন জুনিয়র সিনিয়র ছিল না। সবাই একসাথে হয়ে খুব মজা করেছেন। বড় আপু পাপিয়া, খাদিজা আপু মারুফ ভাই, আর আমার বিভাগের ছোট বোন আরা, অনিক খুব মজা করল। ফার্স্ট্ সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে আমরাও এরকম অনেক মজা করেছি। তবে অনেক বড় আপু –ভাই মাস্টারসে পড়া অবস্থায় এরকম নাচানাচি না করলেও পারত। কিছু বিষয় আছে যা কখনোই শোভনীয় নয়। এদিকে লেগেছে খুব ক্ষুধা, এখনও নাস্তা দেয়া হয়নি। ঘড়িতে বাজছে ৯:০০ টা। অবশেষে নয়টা আট মিনিটে সবাইকে দেয়া হয় নাস্তা।
গাড়ি লালন সেতু অতিক্রম করার পর একটি ফুয়েল স্টেশনে ২০ মিনিটের বিরতি দেয়া হল। বিরতিটা একটু আগে দেয়া উচিত ছিল। আমাদের সবার প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার রওয়ানা দিল বাস স্থিত লক্ষের দিকে। বাস চলছে আর আমরা প্রকৃতির দৃশ্য দেখছিলাম। একটি বিষয় খুব লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশের প্রতিটিগ্রাম, এলাকা, শহর, প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রায় একই রকম অথবা হুবহু একই রকম। আমি বাংলাদেশের আনেক জেলা শহরে ও গ্রামে ভ্রমণ করেছি, গ্রামের দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছে কিন্তু সবই একই রকম মনে হয়েছে। কোন ভেরিয়েশন নেই। রাজশাহী থেকে যাচ্ছি মেহেরপুর মুজিবনগর। যাওয়ার পথে অবলোকনকৃত গ্রাম ও প্রাকৃতিক দৃশ্যও একই রকম। তবে পার্ব্ত্য চট্টগ্রামে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির কথা আলাদা। চিরাচরিত দৃশ্য দেখছিলাম বাসের জানালা দিয়ে। দেখছি শীতের সকালে কৃষকেরা মাঠে কাজ করছে।এখন শীতকালীন সবজী চাষে কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। মাঠে কোন ফসল দেখি না। আবাদের কাজ চলছে। কেউ গরু দিয়ে হাল চাষ করছেন আবার কউ করছেন ট্রাকটর দিয়ে। তবে পুরো মাঠই ধু ধু মরু প্রান্তরের ন্যায়। শুধু ধুসর মাটি। যতদুর চোখ যায়। দেখে মনে হচ্ছে মাটি এখন প্রস্তুত ফসল উৎপাদনের জন্য। মাটি অপেক্ষা করছে তার মালিক কৃষকের হাতের ইশারার জন্য । যখন হাত নাড়িয়ে বীজ ছিটাবেন তখন মাটি মনে করবে মালিক তাকে আদেশ দিচ্ছেন ফসল ফলানোর জন্য। কয়েকটি জায়গায় শুধু বাঁধা কপি, আর সরষে ফুল এর চাষ হচ্ছে দেখতে পেলাম। রাস্তা পাশের গ্রামের আর কৃষি জমির এরকম রুপ দেখতে দেখতে আমরা মেহেরপুরের আমঝুপি-নীলকৃঠি তে এসে পৌছালাম বেলা সাড়ে এগারটায়। এখানে আমাদের ২০ মিনিট সময় দেয়া হল । ২০ একর জমির উপর অবস্থিত আমঝুপি –নীলকুঠি টি ১৮ লক্ষ ২ হাজার টাকা খরচ করে দর্শ্নীয় স্থান হিসেবে তৈরী করা হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, ১৭৫৭ সালের পলাশী পরাজয়ের নীলনকশা রচিত হয়েছিল এই নীলকৃঠিটিতে। রবা্র্ট্-ক্লাইভের সাথে মীর জাফরের সাথে শেষ বৈঠক হয়েছিল এইখানে। এরপরই অস্ত যায় বাঙালি মুসলমান –পলাশীর সূর্য্। একটি নিদির্ষ্ট্ ফি দিয়ে আমরা সবাই নীলকুঠির ভেতরের প্রতিটি কক্ষ দেখলাম। কোন ঘরে তারা ঘুমুতেন, কোথায় বসতে আড্ডা দিতেন, নাচগান করতেন সবই দেখা হলে এক এক করে। কুঠিটির সামনে রয়েছে একটি সুন্দর বাঁধানো ঘাট। সেই সময় জমিদাররা কেমন বিলাসী জীবন যাপন করতে তা দেখে ভা্বতেই অবাক লাগে। বিপুল টাকা ব্যয়ে নিমিত ঘাট, বাড়ি দেখে মনে হচ্ছে জমিদাররা কি অমানবিক ভাবে প্রজাদের নিযাতন করতেন। নীলকুঠি দেখে আমরা আবার রওয়ানা দিলাম আমাদের মূল আর্ক্ষণ
মুজিবনগরে। দুপুর দুইটায় পৌছলাম মুজিবনগরে। আমরা উঠলাম পরিদর্শ্ন
বাংলোতে। এটি সবার জন্যই উন্মুক্ত। আমরা সবাই ফ্রেস হলাম ওখানে। এখানে নামার পর ও আমাদের কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। বাস নামার পর সবাইকে বলা উচিত ছিল যে “আমরা দীর্ঘ্ পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে মুজিবনগরে পৌছলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্রেই খাবার দেয়া হবে। তারপর আমরা শহীদ মিনার, মানচিত্র, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে প্রধানমন্ত্রী করে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল তা দেখব। এতটার মধ্যে পৌছা আবার আপনাদের বাংলাতে ফিরে আসতে হবে।” নামার পর সবাই অস্থির হয়ে ঘুরছে। কখন খাবার দেয়া হবে কাউকে কিছু বলা হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পর একজন করে এসে রুমেল ভাই কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে ভাই খাবার দিবেন। অনেক অতিক্রম করার পর সবার ক্ষুধাটা একটু বেশী্ই লেগেছিল। যাইহোক অবশেষে ২টা ১০ মিনিটে সবাইকে খাবার দেয়া হল। তবে খাবার টা দারুণ হয়েছিল। রান্না ভাল হইছে। আমরা সবাই খেয়ে মুগ্ধ। এর জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য সিজার ভাই। তিনি পিকনিক উপলক্ষে পিকনিক স্পটে আগের দিন এসে পৌছেছিলেন রান্নার ব্যবস্থাসহ আনুষাঙ্গিক কাজ করার জন্য । অনেক অনেক ধন্যবাদ সিজার ভাইকে পিকনিকের দিনে ভাল খাবার পরিবেশন করার জন্য।
খাবার শেষে সবাই বেরিয়ে পড়লাম আমাদের ইতিহাস দেখার জন্য। যেখানে আমাদের চেতনা , অন্যায় হলেকিভাবে প্রতিবাদ করতে হয়, কিভাবে গজে উঠতে হয় অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে। প্রথমেই দেখলাম শহীদ মিনার। সাথেই রয়েছে একটি মঞ্চ যেখানে দাড়িয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মুনসুর, কামারুজ্জামান বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এসব স্মুতি বিজরিত জায়গা দেখে গায়ের পশম দাড়িয়ে যায়। চেতনা ফিরে পাই কোন মুহুর্তে কত কষ্টে, কত ত্যাগে আমরা বাংলাদেশ গড়েছিলাম। শহীদ মিনারে রয়েছে ২৩ টি উঁচু স্তম্ভ। ২৩ টি স্তম্ভ দেয়ার কারণ আমরা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পযন্ত ২৩ টি ক্রান্তিকাল বছর অতিক্রম করে চূড়ান্ত বিজয়ে পৌছেছিলাম। জুতা খোলে সবাই শহীদ মিনারে প্রবেশ করলাম। নিজেকে সাক্ষী বানাতে ছবি উঠালাম। আমি বাত্তানি আর সোহাগ আসিফ ভাই। আমাদের কয়েকটি ছবি উঠালেন মাসকমের রত্না আপু। শহীদ মিনারের অদুরেই নিমিত করা হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত। মানচিত্রটি খুব সুন্দরভাবে তৈরী করা হয়েছে। মানচিত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনাবলী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রের্সকোর্স্ ময়দানের ভাষণ, কোথায় যুদ্ধ হচ্ছিল, কোথায় ঘড়বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, কোন পথ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়, কিভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় তার সব চিত্র সিমেন্ট দিয়ে তৈরী করে ফুটিয়ে তোলা হয়। এখানেও আমরা কয়েকটি ছবি উঠালাম। মানচিত্র দেখার পর আমি আর সোহাগ গেলাম সীমান্ত দেখার জন্য। সীমান্তটি সোনাপুর গ্রামে অবস্থিত। ওখানে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া দেখা যায়। ভারতকে সম্মান জানাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। সেই সাথে ধিক্কার জানাই কাটাতারের বেড়া নিমাণ করে প্রতিদিন গুলি করে মানুষ মারার জন্য। সীমান্ত এলাকা থেকে আমি ও সোহাগ ফিরে আসলাম বাংলোতে। ওখানে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চিরাচরিত খেলা হাড়ি ভাঙ্গার প্রতিযোগীতা টি ভাল লাগছে। সেই সাথে ছিল পিকনিকে উপস্থিত ডেলিগেটদের নানা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান। এর মধ্যে ছিল মিস বি উটি পারলার, মিস লজ্জাবতী, মি: হেয়ারস্টাইল, মি: খাদকসহ ১০ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হয়। আমার বন্ধু রাকিব ও মি: হেয়ার স্টাইল হিসেবে ভূষিত করা হয়। এবং ওর হাতে তুলে দেয়া হয় চিরুনী, শ্যাম্পু। সন্ধ্যা ৬ টায় আমরা রওয়ানা দিই ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। রাত বারটায় আমাদের পিকনিকের বাস ক্যাম্পাসে এসে পৌছে। বিজয়ের মাসে মুজিবনগর দেখতে খুব ভাল লাগল।
৭ ডিসেম্বর’১২
সকাল সাতটা
শের ই বাংলা হল
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



