পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ আমীর হোসেন যখন তার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ‘ময়নার হাট রেল স্টেশনের’ ছোট্ট বেঞ্চটাতে এসে বসেন তখন সেটা কারো নজরে পড়ার কথা না। পড়েও না। শুধু ময়নার হাট রেল স্টেশনের জীর্ণ শীর্ণ ভাঙ্গাচোরা লোহার কাঠামোগুলো একটু খুশি হয়। কোন একজন এসেছে তার সাথে কথা বলতে।
- কি খবর আমীর হোসেন। শরীর খারাপ নাকি?
- শরীর দিয়ে আর কি হবে ভাই। তোমার এরকম শক্ত পোক্ত লোহার শরীরের যে অবস্থা তাতে আমি যে বেচে আছি সেটাই তো বাড়তি পাওনা।
- তা যা বলেছ। তবে জানো কি, বাইরের কাঠামোটাও ভেঙ্গে পড়ে যখন মনের ভেতরটা ভেঙ্গে যায়।
- তোমার আবার মন?
- তা যা বলেছ। আমি একটা জড় পদার্থ আমার আবার মন। তবুও তুমি তো জানো কেমন ছিলাম আমি। এই যে ময়নার হাটের জনপদ এটাতো আমাকে ঘিরেই গড় উঠেছিল। এই যে স্কুল, এই যে কলেজ, মিল-কারখানা সব। আর আজ আমি ভাঙ্গাচোরা এক স্টেশন। সপ্তাহে একদিন আমি খুশি হই। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠে মন। একারনেই বোধহয় এখনো বেঁচে আছি। প্রতি বুধবার যখন ট্রেনটা আসে তখন খুব অল্প হলেও মনটা ভড়ে উঠে। মুখরিত হয় আমার জীবন, সার্থকতা পাই জীবনের। ওহ! তোমাকে কি বলছি, তুমি কি বুঝবে আমার ব্যাথা।
- ভাইরে, তোমার ব্যাথা বুঝি বলেই এখানে এসে বসে থাকি। তুমি তো তাও প্রতি বুধবারে মুখরিত হও কোলাহলে। আমার যে শুধু বুধবার যায় আর আসে কিন্তু মুখরিত হওয়া আর হয় না। পাচটা ছেলেমেয়ের সবাই দূরে থাকে। খোজ খবর খুব একটা নেয় না। বছর দুবছরে একবার দেখে যায়। সেসময় খুব আনন্দ পাই তোমার মতো, একটা ট্রেন আসার মতো। খুব হইচই হয় বাড়িশুদ্ধ, যেরকম হয় তোমার এখানে। তারপর সবাই যখন চলে যায় তখন আমি পড়ে থাকি একা নিঃসঙ্গ, যেমন তুমি পড়ে থাকো একটা ট্রেন যাওয়ার পরে। তোমার তবুও সপ্তাহ পরে বুধবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চলে যায় কিন্তু আমার যে কতদিনের অপেক্ষা তাইতো জানি না। জানিই যে না, অপেক্ষার শেষ হবে কিনা।
কৌতুহলী কেউ যদি একটু এগিয়ে কান খাড়া করে রাখে আমীর হোসেন আর ময়নার হাট রেল স্টেশনের মধ্যকার কথাবার্তা শোনার জন্য তাহলে তাকে নিরাশ হতে হবে। তাদের মধ্যকার কথাবার্তা কেউ কোনদিন শোনেনি। তবুও তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়।
নিঃসঙ্গ দুটো মনের কথাবার্তা যে বাতাসে ভাসে না। সেটা যে হয় মনে মনে। সেটা যে অনুভব করতে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



