পুরোনো পত্রিকা নিয়ে আমার বউয়ের অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। ব্যাপারটাকে ঠিক অদ্ভুত বলা যায় কিনা সেটা নিয়ে আমার নিজের মধ্যেই সন্দেহ আছে। তবুও অদ্ভুত মনে হবার কারন হতে পারে দুটো। একঃ পরিচিতজনেদের মধ্যে অন্য কারো বউয়ের এরকম কোন ব্যাপার আছে বলে শুনি নাই। দুইঃ আমি নিজে বস্তু জগতের মানুষ। বউয়ের ভাষায় রস কস আবেগহীন। রাস্তায় চলতি পথে এক্সিডেন্টে মগজ বের হওয়া লাশ দেখলেও আমার কোন সমস্যা হয় না। সেটাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে পারি। বমি করে দেই না। সেই মগজের কথা চিন্তা করতে করতে খেতে পারি। পত্রিকায় বীভৎস কোন ছবি বা খবর পড়লেও আমার বোধে তা খুব একটা নাড়া দেয় না। তাইতো চিত্তাকর্ষক অথবা আবেগী কিছু চিত্ত বা আবেগকে নাড়া দিলে প্রথমে তাকে আমার অদ্ভুতই মনে হয়।
অদ্ভুত হওয়া নিয়ে আমি নিজে কিছুটা বিব্রত। লেখালিখি যারা করেন তাদের নাকি একটু আবেগী হতে হয়। তারা খুব টাচি হয়। অন্যদের কাছে যে ঘটনা স্বাভাবিক তাদের কাছে তা অস্বাভাবিক হিসেবে ধরা দেয়। যদিও আমি বিখ্যাত কোন লেখক নই তবুও নিজেকে আমার লেখক ভাবতে ভালো লাগে। চাকরী একটা করি বটে কিন্তু লেখালিখিটা আমার প্যাশন। প্যাশন অবশ্য দ্বিধা নিয়ে বলি। ডিকশনারীতে প্যাশনের যে অর্থ দেখি তাতে প্যাশনের সাথে আবেগের একটা যোগসুত্র আছে। ফ্যাশন সেক্ষেত্রে অনেক নিরাপদ। আবেগের ব্যাপার নাই সেখানে। তাইতো এক্সিডেন্টে মগজ বের হওয়া লাশ দেখলে আমি তার বীভৎসতা না দেখে এর পেছনে কোন গল্প আছে কিনা তা খুজি। পত্রিকার ভয়ঙ্কর কোন ছবি দেখলে খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ি তার থেকে গল্পের প্লট খুজতে। প্যাশন হলে কি হতো জানি না কিন্তু ফ্যাশন বলেই হয়তোবা বউয়ের ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয়।
সেই কখন থেকে বউয়ের ব্যাপার আর তার অদ্ভুততা নিয়ে কচলাচ্ছি। অথচ ব্যাপারটাই বলা হয় নাই। আসলে আপনাদের বলতে একটু সংকোচ হচ্ছে। কারন জানি আপনারা বলবেন এটাই তো স্বাভাবিক। মানুষ হিসেবে আমাদের তো এমনই করা উচিত। ব্যাপার কিছুই না। আমার বউ সারা বছর আমাদের ঘরে যে পত্রিকা বা ম্যাগাজিন রাখা হয় তা একসাথে বিক্রী করে। টাকার অংকে বিক্রী খারাপ হয় না। দুটো পত্রিকা, দুটো ম্যাগাজিন এবং অন্যান্য জিনিশপত্র মিলিয়ে সারা বছরে যা হয় তা বিক্রী করে মোটামুটি হাজা তিনেক টাকা পাওয়া যায়। এটা অদ্ভুত ব্যাপার না। যারা বাসায় পত্রিকা রাখে তারা সবাই এ কাজটা করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে টাকা পাওয়া যায় তা ঐ বছর পত্রিকায় প্রকাশিত কোন মর্মস্পর্শী রিপোর্টের ভুক্তভুগী মানুষের কাছে পাঠানো হয়। এই যেমন গতবছর স্বামীর নির্যাতনের স্বীকার ঝালকাঠির আমেনা বেগমের কাছে টাকাটা পাঠানো হয়েছে। কখনো আমরা দুজন গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসি আবার কখনো স্থানীয় সংবাদকর্মী বা সংবাদপত্র অফিসের মাধ্যমে। এবার টাকাটা পাঠানো হবে চন্দ্রভানুর কাছে এবং আমার বউয়ের সবিনয় ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা নিজেরা গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসব তার হাতে।
লেখালিখি যার ফ্যাশন ভেতরে ভেতরে সে যতই কাট-খোট্টা হোক তাকে বাইরে তাকে অনেক নরম-সরম এবং হূদয়বান হিসেবে প্রকাশ করতে হয়। গল্পের নায়িকার চোখের জলে আর্দ্র হতে হয়। নায়কের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বলতে হয় বিবেকের তাড়না। তাইতো চন্দ্রভানুকে নিজ হাতে টাকা দিয়ে আসার জন্য বউয়ের সবিনয় ইচ্ছাটাকে গুরুত্ব দিতে হয়। যতটানা সংসারের অশান্তি থেকে বাঁচার জন্য তারচেয়ে বেশি লেখক হিসেবে নিজের নরম মনকে বউয়ের সামনে প্রকাশ এবং নতুন গল্প আশায়। অভিজ্ঞতা বলে মানুষের কষ্টকে পুজি করা গল্প খুব হিট হয়। যদিও এরকম সমালোচনাও শুনা যায় ‘মানুষের কষ্টকে পুজি করিয়া যাহারা এই রকম সাহিত্য রচনা করিয়া থাকেন তাহাদের রক্তের দলায় বসিয়া থাকা মাছির মতন মনে হয়।’
আমি খুঁজে খুঁজে চন্দ্রভানুর উপরে লেখা পত্রিকার রিপোর্ট পড়লাম। খুব আহামরি কোন ঘটনা না। অন্তত আমার কাছে মনে হয় নাই। আমি জানি এরকম চন্দ্রভানুর খোজ দেশের প্রতিটা গ্রামে একটা করে পাওয়া যাবে। তবুও চন্রঁভানুর ভাগ্য পত্রিকায় তার কথা এসেছে। চারপাশে বর্ডার দেয়া বড় রিপোর্ট আকারেই এসেছে।
‘তার নাম চন্দ্রভানু। পরিচয়পত্রে তাঁর বয়স ৫৫। বিচারের আশায় অন্তত একটি দশক দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। বাড়ি তাঁর বরগুনার বেতাগী উপজেলার কেওড়াবুনিয়া গ্রামে। একখণ্ড জমি নিয়ে বিরোধ। পরিমাণ ৩৭ শতাংশ। তাঁর প্রতিপক্ষ একই গ্রামের আবদুল মালেক। বেতাগী উপজেলার ছোট মোকামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তিনি। চন্দ্রভানুর মতে, মালেক মাস্টার দুর্ধর্ষ। আর মালেক মাস্টারের বর্ণনায়, চন্দ্রভানুর চরিত্র ভয়ংকর। চন্দ্রভানুর উক্তিতে, ‘আমি লাগাই’ মানে তিনি ধান লাগান। ‘হে উগলায়’ মানে মালেক সে ধান উপড়ে ফেলেন। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, তাঁরা উভয়ে ওই জমির মালিকানা দাবি করে আসছেন। এ জন্য সময়ে সময়ে তাঁরা পরস্পরের ফসল নষ্ট করেন।’
বাহ! রিপোর্টারের রিপোর্টটা ভালো। লেখায় একটা আলাদা মাধুর্য আছে। এ ধরনের রিপোর্টারদের অবশ্য ভবিষ্যত বলে দেয়া যায়। বছর দু-বছর পরে, সাহিত্য অঙ্গনে তারা যখন একটু পরিচিত হবে তখন তারা বই লিখবে। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস। সাংবাদিক পরিচয় ছাপিয়ে হয়ে উঠবে বুদ্ধিজীবি। বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা। তখন তাদের পথ হবে মসৃন, সাংবাদিকের লাঙ্গল দেয়া আদোখাদো পথ হবে না। ধুর, কিসের মধ্যে কি নিয়ে আসলাম। চন্দ্রভানুর কথাই বলি। রিপোর্টারের বয়ানে-
‘ ... তাঁর নামে পাঁচটি মামলা। ‘যদি সত্য অয়, মোর গর্দানটা যাউক। তয় তদন্ত চাই। বিচার চাই। হেইডাই পাই না।’ চন্দ্রভানু নিজকে নির্দোষ দাবি করতে এভাবেই সতর্ক। চন্দ্রভানু স্পষ্ট করেন, শিক্ষকদের ওপরওয়ালাদের তালাশ লাভের আশায় তিনি ওই সম্মেলন কক্ষে ঢুঁ মারেন। কারণ তাঁর শত্রু একজন মাস্টার—আবদুল মালেক। চন্দ্রভানু নিরক্ষর নন। পুঁটলি থেকে বেরোয় তাঁর সই করা একাধিক আবেদনপত্র। তাঁর কথায়, ওই শিক্ষক গায়ের জোরে তাঁর জমি জবরদখল করে তাঁকে ভূমিহীন করার পাঁয়তারা করছেন। আমার বিরুদ্ধে পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন।’
আমি বুঝে উঠতে পারি না কেন আমার বউ চন্দ্রভানুকে মনোনিত করলো। রিপোর্ট পড়ে আমার মনে হয়েছে চন্দ্রভানু একাই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে। রিপোর্টের ভাষায় ‘চন্দ্রভানুর তদবির ও প্রচেষ্টা কিংবদন্তিতুল্য।’ স্থানীয় সাংবাদিক, বেতাগী পৌরসভা চেয়ারম্যান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ডিআইজি বরিশাল, বরগুনার পুলিশ সুপার, স্থানীয় সংসদ সদস্য সবাইকেই ধরা হয়ে গেছে তার।
- চন্দ্রভানুকে টাকা দেয়ার তো কিছু দেখছি না।
- কেন?
- মহিলাতো একাই সব পারছে। তাকে টাকা না দিলেও সে করতে পারবে। তাছাড়া টাকাটা পেলেই যে তার খুব একটা উপকার হবে তা না। তার চেয়ে এই যে গত মাসের ওই রিপোর্টের এসিডদগ্ধ মেয়েটাকে টাকা দিলে উপকার হতো বেশি।
- তোমার কথা হয়তো ঠিক কিন্তু আমি আসলে চন্দ্রভানুর যে সংগ্রাম তার সাথে একাত্বতা প্রকাশ করতে চাচ্ছি। তুমি বুঝতে পারো, একা একটা মহিলা গত দশ বছর যাবত তার শেষ সম্পদটুকুর জন্য সংগ্রাম করছে তার চেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষের সাথে। তবুও টিকে আছে। আমি গিয়ে এই টাকাটা দিলে হয়তো খুব বেশি উপকার পাবে না কিন্তু আমি নিজে চন্দ্রভানুর হাত ধরে তার যে সাহস, তার যে একাগ্রতা সেটা ফিল করতে চাই। বলতে পারো নিজের জন্যই।
এরপর আর আমার কিছু বলার থাকে না। আসলেই তো। আজকালকার অনেক শিক্ষিত মহিলা যারা নারী অধিকার নারী অধিকার বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে তারাও কি চন্দ্রভানুর মতো সংগ্রাম করে। আমার জানা নাই।
- আচ্ছা, তোমাকে যে বললাম চন্দ্রভানুর ঠিকানাটা যোগার করতে, করেছো?
- ঠিকানা তো রিপোর্টেই দেয়া আছে।
- রিপোর্টটা তো ছয়মাস আগের। এইসব রিপোর্টের পরে অনেক সময় আরো বেশি সমস্যা হয়। সহানুভুতি যেমন পাওয়া যায় তেমনি শত্রুও বেড়ে যায়। পত্রিকা অফিসে না তোমার পরিচিত আছে। তার থেকে জানো না।
চলবে..

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



