গোয়া না শিমলা-মানালী এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা , গুগলে গবেষনার পর গোয়া জয়ী হল। সাগরের উদ্দামতার আহবান বিজয়ী হল তুষারের শীতলতার সাথে যুদ্ধে। আমার কাছে দুইটাই সমান, নতুন জায়গায় যাব এটাই আসল কথা। আমি ঘুরতে পারলেই খুশী।
হুমায়ুন আহমেদ কোন এক বইয়ের উৎসর্গে লিখেছিলেন- তোমার উঠোনে এনে দিব সাত সাতটি অমরাবতী । আর হাওড়া স্টেশনে আমাদের জন্য যে ট্রেনটি অপেক্ষা করছিল তার নামও দেখি অমরাবতী। নামটা কেন জানি ভাল লেগে গেল। হাওড়া স্টেশনে ব্যাপকতা বিশাল। সমগ্র ভারতের উদ্দেশ্যে এখান থেকে ট্রেন ছেড়ে যায়। যথা সময়ে ট্রেন ছাড়ল। স্টেশন থেকে কিনা শিকল দিয়ে ব্যাগ আটকালাম। আমাদের মূল চিন্তা হচ্ছে ৪২ ঘন্টার এই জার্নিতে টিকে থাকা নিয়ে।
ট্রেনে কেউ সিগারেট খাচ্ছেনা দেখে আমরা একটু টেনশনে পড়ে গেলাম। ২০০ রূপী জরিমানা কথাটা কি তবে সবাইরে ভয় লাগাইয়া দিছে
একজনত আরও দুঃসাহসী কর্ম করে এল। কলকাতায় মদের দোকানের কোন অভাব নেই। সে একবোতল ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। গোয়া সৈকতেও প্রতি তিন দোকানের একটা মদের দোকান।পানির দামে মদ। পাহাড়ার সুযোগে বোতল খুলে ফেলা হল। পাহাড়াদার একজন দৌড়ে এসে খবর দিল পুলিশ আসতেছে। তাড়াহুড়ায় ছলাৎ করে পড়ে গিয়ে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশ কাছে এসে এদিক ওদিক তাকায় , সাধু পুরুষরা সবাই উদাসী আড্ডায় ব্যস্ত।
যাওয়ার সময় তারা তর্ক জুড়ে দিল গন্ধ কিসের - ভদকা না হুইস্কি
ধীরে ধীরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল যারযার বাঙ্কে।
সকালে সূর্যের আলো চোখে এসে পড়ায় আর হকারের হাকডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। মাথা বের করতেই চোখে পড়ল ভুবনেশ্বর স্টেশন। আরে এখান থেকেইত এ পি জে আব্দুল কালাম ভারত জয়ের যাত্রা শুরু করেছিলেন। বিচত্র নামের (ভিজয়ানগরাম ,আনাকাপালি, ইলিমানচিলি .....) এক একটা স্টেশন পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি। ভাল লেগেছে সবগুলোই নিট এন্ড ক্লিন দেখে।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে গুরুত্ব পূর্ন ইস্যু হয়ে দেখা দিল খাব কি ?? সকালে চা পাউরুটি দিয়ে না হয় কাজ চলেছে।কিন্তু দুপুরে। হকার খাবার নিয়ে আসতে লাগল।বিভিন্ন নামের বিভিন্ন চেহারার। ইডলি বড়া , ইডলি সাম্বা , দোসা (আমাদের এখানে যেটা পাওয়া যায় তেমন না) সাউথ ইন্ডিয়ান ভাত তরকারী আরও কত কি।
খাওয়া নিয়া আমার কোন বাছবিচার নাই। সবই খাই। এ নিয়া এক মজার গল্প আছে এক কলিগের। চায়নায় যাইয়া টাল হয়ে ডিনারে গেছে। পর্ক খাবে কিনা জিগাসা করাতে ওয়েটাররে ঝাড়ি দিল। আরেকজন কয় চল খাই। পুরা টাল সে কয় ঐটা হারাম
দুপুরে খাইলাম সাউথ ইন্ডিয়ান ভাত তরকারী। বহু কষ্টে গিলে ফেললাম।এরপর একে একে সবই খাইছি। ভাল লাগছে সব স্টেশনে ফ্রেস জুস পাওয়া যায়। ট্রেন থামলেই জুসের দোকানে দৌড় দিতাম। ২য় দিন সকালে এক স্টেশনে পাউরুটি ডিম দেখে সবাই পাগল হইয়া গেছিলাম। ট্রেন হর্ন না দিলে দোকানির সব রুটি ডিম শেষ হইয়া যাইত। ৪২ ঘন্টায় কোন হকাররেই ফিরায়া দিই নাই। আঙ্গুর আর মিষ্টি বড়ই ছিল সব সময়।
বাংলা বিহার উড়িষ্যা পাড়ি দিয়ে এসেছি। দুপাশ আমাদের দেশের মতই।সবুজ ধান ক্ষেত দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বাংলার নবাব সিরাজ এত বিশাল এরিয়া ম্যানেজ করত কিভাবে ভেবে অবাক হই। মানুষ জনের চেহারাও আমাদের মতনই।পরিবর্তন চোখে পড়ে উড়িষ্যাতে গিয়ে। টিভিতে দেখা দক্ষিনের লোকদের মতন। চলতে চলতে কত নদী রেল সেতু ফেলে আসি খেয়াল নেই। শেষ বিকালের আলোতে আমাদের প্রবেশ অন্ধ্রপ্রদেশে। আর ভোরে ঘুম ভাঙ্গে কর্নাটককে পাশ কাটানো কোন এক স্টেশনে। এরপর ধীরে ধীরে ট্রেন উপরের দিকে উঠতে থাকে। সবুজ বনানীতে মুগ্ধ হবার মত শক্তি তখন আর নেই। আরও ৫/৬ ঘন্টা বাকী। কখন শেষ হবে সেটা নিয়েই আলোচনা। ট্রেন পাহাড়ের উপর উঠছে। দুপাশে হাজার ফুট গভীরতার পথ পাড়ি দিয়ে এসে থামল ক্যাসল রক এ। এখানেই দিল খোশ করা পাউরুটি ডিমের সন্ধান। ভরা পেটে ২৫ জনের দলের সবারই পুরা জোশ ফিরে এল। জোশ ডাবল হল দুধ সাগর স্টেশনে এসে।এর সামনেই দুগ্ধ স্রোতের মত পাহাড়ি ঝর্না বয়ে চলেছে। ঝর্না ঝর্না চঞ্চল ঝর্না -একে দেখেই লেখা সম্ভব। ট্রেনটা থামিয়ে যদি একবার ছুয়ে আসতে পারতাম। এখানে এসেই বুঝলাম ট্রেনটা কত বড়।
পরিচয় হল এক ডেনিসের সাথে। দেড়মাস ধরে চলছে তার ভারত দর্শন। কয়েকটা আধাঁর টানেল ও পাড় করে আসলাম। আরও দু ঘন্টা। আর যে সয়না টাইপ অবস্হা। অবশেষে দুঘন্টা শেষ হল। সাউথ গোয়ার মাডগাও এ আমরা নামলাম। ট্রেন যাবে ভাস্কো দা গামা পর্যন্ত।
আগে থেকে অপেক্ষমান বাসে করে আমাদের যাত্রা কলবা বীচ এর উদ্দেশ্যে। সেখানেই হোটেলে থাকার আয়োজন। রূমে ঢুকেই সোজা শাওয়ারে। মনেহল কতদিন গোসল করিনা। লাঞ্চ শেষে হালকা বিশ্রামের পর সবাই মিলে বের হলাম । কলবা মনোরোম নিরিবিলি বীচ। ভীড় কম।আমরা এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেরেলাম। আরব সাগরের বুকে টকটকে লাল সূর্যকে বিদায় জানিয়ে বীচ মার্কেটটা ঘুরে দেখলাম। সন্ধ্যায় পুরা পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। উচ্চ স্বরে গান আর দোকান গুলোর সামনে লনে ছোট ছোট টেবিলে লোকজন নিজেকে সপে দিচ্ছে মদ আর বিয়ারের গ্লাসে। প্রচুর সাদা চামড়ার বিদেশী (১ম বারের মত আমরাও বিদেশী) চোখে পড়ছে ....যে যার মত করে বসে আছে।
ডিনার শেষে আমরা দ্বিধা বিভক্ত। একদল সকালের ব্যস্ত সূচী বিবেচনা করে ঘুমাবে আরেক দল যাবে নাইট ক্লাবে। আমি দ্বিতীয় দলের সাথেই গেলাম। একবার অন্তত কাছ থেকে দেখে আসার ইচ্ছায়। বারটার পর শুরু হল রাতের আয়োজন। ডিজের তালেতালে নৃত্য। আমার ধারনা ছিল যারা নাচতে আসে তারা ব্যাপক দক্ষ্য। প্রত্যেক গ্রুপে মেয়ে থাকলেও আমরা অলবয়েজ টীম। কিছুক্ষন নিজেরা নাচানাচি করে ক্লান্ত হয়ে একটা বিয়ার নিয়ে একপাশে দাঁড়ালাম। নাইট ক্লাবের ছলনা পরিষ্কার হতে শুরু করল। রং বেরং এর লেজার শোতে নাচা কোন ব্যাপারইনা। হাত পা সামান্য নাড়ালেই লেজারের আলোতে বিভিন্ন রকম মুভমেন্ট হিসেবে ফুটে উঠে। আলো আধাঁরিতে সেটা উদ্দাম শরীরি নৃত্য হিসেবে ফুটে উঠে। যত বেশী নড়বেন তত বেশী ভঙ্গীমা ফুটে উঠবে। তবে অনেকেই বেশ ভাল নাচেন তালে তালে এটাও ঠিক। আমার মতন অদক্ষ্যদেরও টেনশনের কিছু নেই। ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। উপায় না পেয়ে সবাই মিলে বীচে গলাম। বীচ থেকে হোটেল চেনা সহজ ।
সকালে শুরু হল গোয়া দর্শন। বাসে করে যাত্রা। জোশ (শাহরুখ ঐশ্বরিয়া ) দেখে এমনিতেই গোয়া জায়গাটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। পুরা মাস্তির জায়গা। পূর্তগীজ দেরই হাতে গোড়াপত্তন এই শহরের। ঘরবাড়ীতে টালীর ছাদ।
মান্দভী নদী গোয়াকে উত্তর দক্ষিন দুভাগে ভাগ করেছে। রাজধানী পানাজি উত্তরে। মান্দভী নদীতে রিভার ক্রূজ করা যায় দেড়শ রূপীতে। আছে ভাসমান ক্যাসিনো। এক হাজার রূপীর এন্ট্রীফির কারনে সে ইচ্ছা বাদ দিয়েছি।
আমাদের গন্তব্য বাঘাতুরা বীচ। দিল চাহতা হ্যায় ছবিতে আমীর, সাইফ আর অক্ষয় খান্না - এর পাশে থাকা ফোর্ট এ পা দুলিয়ে বসেছিল আর এখানে দাপাদাপি করেছিল।
যাবার পথে পড়ে ডোনা পয়েন্ট। কোন এক রাজকন্যা প্রেমিককে না পেয়ে এখানে আত্মহত্যা করেছিল। প্রায় প্রতি বছরই তার স্মৃতির প্রতি সন্মান দেখিয়ে আধুনিক প্রেমিকারাও আত্মহত্যা করে। এজন্য জায়গাটা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।
গোয়ায় চৌদ্দ পনেরর অধিক বীচ থাকলেও বাঘাতুরা সবচেয়ে সুন্দর। স্বচছ নীল জলের এক পাশে পাথুরে আরেক পাশে বেলুকাবেলা।
এই বীচে ফরেনারের আধিক্য। অর্ধনগ্ন নগ্ন সব ভাবেই আছে তারা। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে সাদা চামড়া ওয়ালীরা হালকা ঝুকে পড়লে টিভিতে আমরা পলকহীন থাকলেও এখানে তাদের নগ্ন হয়ে শুয়ে বসে বই পড়া রোদ পোহানোর প্রতি আমাদের তেমন কোন দুর্বার আকর্ষন কাজ করেনাই। একজনত বলেই বসল ধূর বাঙ্গালী মেয়েদের সাথে কারো কোন তুলনা চলেনা। আমরা আমাদের মতই থাকলাম।
এরপর গিয়েছিলাম আন্জুনা বীচ এ। পুরাই রকী বীচনক্ষমের উপায় নেই। এখানে তিনটা ডাইসের একধরনের জুয়া খেলা চলে। নিষেধ সত্বেও কেউ কিছু বুঝার আগে আমাদের দুজন ১১০০রূপী ধরা খেল।
ক্যালিংগুট বীচ একদমই ভাল লাগনি। লাখো লোকের জমায়েত ওখানে। ফাইভ ষ্টার হোটেল গুলোর নিজস্ব বীচ আছে এখানে।
গোয়াতে অনেক গুলো দুর্গ আছে। শুনলাম গোয়া নাকি কখনোই ব্রিটিশদের দখলে আসেনি। পূর্তগীজদের অধীনে ছিল। আমরা ফোর্ট আগোডায় গেলাম। এটা এখন বাতিঘর। ওখান থেকে দেখা যায় এক ডায়মন্ড ব্যবসায়ীর অবকাশ নীড় আর গভর্নরের বাসভবন। গভর্নরকে মোহনার পাশের বাসভবনের জন্য হিংসা না করার কোন কারন নেই।
ডায়মন্ড ব্যবসায়ীর বাড়ী -
পরদিন সকালে বোটে করে আরব সাগরের কয়েক কিলো ভিতরে গেলাম মুক্ত ডলফিনের বিচরন দেখতে। কপাল ভেল আমরা দেখলাম ও। মেজাজ খারাপ হল যখন সাগরের বুকে তিন তিনবার ডলফিনের জাম্প আর ক্যামোরার সাটারের সিনক্রোনাইজশন হলনা।
ফিরে এসে স্হানীয় জেলে পাড়ার ছেলেদের সাথে কিছুক্ষন ফুটবল খেললাম। এই খেলায় ভাষা কোন বাঁধা নয়। এরপর কিছু রাইড এ চড়া।ওয়াটার বাইক, বানানা রাইড। সবচেয়ে থ্রিলীং ছিল প্যারাসুট এ চড়া। সাহস করে ক্যামেরা নিয়েই উঠলাম যদিও পানিতে ল্যান্ড করলে পুরা মার্ডারের ভয় ছিল। তারপর হোটেলের পুলে দাপড়ানো। কর্তপক্ষ বিরক্ত হয়ে পরে পুল বন্ধ করে দিল।
পুলিশ সব দেশেই এক। গোয়া বীচে বাইক ভাড়া পাওয়া যায়।ইচ্ছা হলেও টায়ার্ড লাগায় গেলামনা। আমদের দুজন গেল। কপাল খারাপ পড়ল পুলিশের হাতে। হেলমেট ও লাইসেন্স না থাকাতে ১০০০ রুপী জরিমানা। ৫০০রুপী বের করে দিলে পুলিশ হেলমেট না থাকায় ১০০রুপী ফাইন করল দুশ নিজে রাখল আর দুশ ফেরত দিল।
বিকালে হালকা শপিং শেষে সবাই মিলে গেলাম ওয়োলকাম মুভীটা দেখতে। বড় পর্দায় প্রথম হিন্দী মুভী। উপভোগ করলাম পুরো ছবিটি। ডিনার শেষে আধাঁর কালোয় আবার শেষ বারের মত আরব সাগর তীরে ঘুড়ে বেরালাম।
ভোরে আবার ও অমরাবতীর কোলে চেপে শুরু হবে বেয়াল্লিশ ঘন্টার ফিরতি পথ।
----------------------------------------------------------------------------------
১ম পর্ব :
ভারত ভ্রমন- কলকাতা টু গোয়া - কলকাতা পর্ব ( ভিক্টোরিয়া থেকে রবীন্দ্রনাথ ,পলাশী থেকে মহীশূর)
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


