বাবরী মসজিদ বিষয়ক ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নামাজ পড়ুক না পড়ুক ঈমানদারদের জ্বালাময়ী স্ট্যাটাসে মুখবইতে যে ঝড় উঠেছে তাতে বুলবুলও ঢাকা পড়েছে । আমি লিখবো না লিখবো না ভাবলেও না লিখে পারছি না । লিখবো না ভেবেছিলাম কারণ আইনের ছাত্র হিসেবে আমি যে দৃষ্টিকোণ থেকে এই রায়কে বিবেচনা করছি তা অনেকে স্বাভাবিকভাবে নাও নিতে পারে । তাছাড়া কথাগুলো যদি না লিখি তাহলে আমার একচোখা মুখবই বন্ধুরা একচোখা দৃষ্টিতেই চিরকালই রায়টাকে বিচার করবে । সংক্ষেপেই লিখছি- প্রথমেই ইতিহাস বাদ দিই । এটা সবাই জানে । রায়ের কথাগুলোও বাদ দিই । এটাও সবাই জানে । আমি কিসের প্রেক্ষিতে এই রায় এসেছে তা নিয়ে আলোচনা করি । আমি মনে করি এই মূর্হুতে এরচেয়ে ভালো ও ব্যালেন্স রায় আর হতে পারে না । ইনফ্যাক্ট সার্বিক বিবেচনায় এটাই যথার্থ রায় । ব্যাখ্যা করছি -
প্রথম কথা ভারতে একটা সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতায় এসেছে । যে দল ভারতীয় সংস্করণে নব্য নাৎসীবাদে বিশ্বাস করে । যার প্রধান এমন একজন যার হাত এই বাবরী মসজিদের প্রেক্ষিতেই সৃষ্ট দাঙ্গায় হাজারো মুসলিমদের রক্তে রাঙানো । স্বাভাবিকভাবে বিচারব্যবস্থায় তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ থাকাটা স্বাভাবিক । তবে এই রায়ে বিজেপির ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রকাশিত হয়েছে ভাবলে ভুল হবে । ধরেন এবারে বিজেপির জায়গায় কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল । কংগ্রেস বাবরী মসজিদ নিয়ে পুণরায় রাজনীতি করতে এর রায় আরো এক টার্মের জন্য পিছিয়ে দিতো বা যদি একান্ত বাধ্য হয়ে এই রায় ঘোষণা করতেই হয় তাহলে ঠিক এই রায়টার কপি পেষ্ট আসতো ।
কারণটা খুব সিম্পল । সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা । ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৩.৪ শতাংশ মুসলিম, ৮০.৫ শতাংশ ভাগ সনাতন ধর্মালম্বী। সরকার স্বাভাবিকভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণকেই খুশি করবে নিজ ভোট ব্যাংক বাঁচানোর জন্য । বাকি সংখ্যালঘুকে নির্দ্ধিধায় তাদের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কথা অকপটে স্বীকার করে (যা শুনতেও ভালো লাগবে) তাদের আঘাতে মলম দিবে । সাথে সাথে এমন ক্ষতিপূরণ দিবে যা অলটারনেটিভ অপশন হিসেবে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি । ২.৭ একর বাবরী মসজিদের জায়গার বদলে থেকে ৫ একর জায়গা অন্যত্র দিচ্ছে । ঠিক এইভাবে সরকার দুই কূলই রক্ষা করল । হিসাব করে দেখলে সুপ্রীম কোর্টের রায় পূর্ববর্তী রায় থেকে বহুগুণ ভালো এসেছে ।
যেখানে ২০১০ সালে তিন বিচারপতি নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় ছিল -অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭ একর (১.১২ হেক্টর) জমিটি তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হবে, যেখানে ১/৩ অংশ রাম ললায় বা হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিত্বকারী শিশু রামের হাতে যায়, ১/৩ অংশ যায় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের হাতে এবং বাকি ১/৩ অংশ যায় নির্মোহী আখড়ার হাতে। রায়টি নিশ্চিত করে যে এই বিতর্কিত স্থানটি হিন্দুদের বিশ্বাস অনুসারে রামের জন্মস্থান ছিল এবং বাবরি মসজিদ একটি হিন্দু মন্দির ভেঙে দেওয়ার পরে নির্মিত হয়। এছাড়া রায়ে উল্লেখ করা হয় যে মসজিদটি ইসলামের তত্ত্ব অনুসারে নির্মিত হয়নি। এবারের রায়ে খুবই সতর্কতার সাথে তত্ত্ব বিষয়ক সকল কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ।
ধরেন বর্তমান রায়ের ঠিক বিপরীতটাই হল । বাবরী মসজিদ লজিক্যালী যাদের তাদেরই হলো । ব্যস গুজরাটে যা হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি হবে । প্রতিশোধের ঢেউ পাকিস্তান ছাড়িয়ে বাংলাদেশেও আসবে । রক্ত ঝরবে উভয় সম্প্রদায়ের । আবার বাবু বজরঙ্গির মত কোন পিশাচ পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে। ধর্ষিত হবে নারী । মাঝ থেকে চিরে ফেলা হবে দুধের শিশুদের। মায়ের পেট থেকে ৯ মাসের ফিটাসকে মায়ের পেট কেটে বের করে আগুনে পুড়িয়ে দিবে ।
এই ব্যালেন্স রায়ে আর যাইহোক উভয় পক্ষের রক্তক্ষরণ এড়ানো গিয়েছে । কারণ বর্তমানে ভারতীয় মুসলিম নেতাদের (আসাদউদ্দিন ওয়াইসি'র মত) মাঝে নতুন নমনীয় যৌক্তিক নেতৃত্ব উঠে এসেছে । যারা বুঝতে পেরেছে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের স্মৃতি রক্ষার চেয়ে এক বিন্দু রক্তের দাম অনেক বেশি । আমি একে সাধুবাদ জানাই । তবে মুসলিমরা ৫০০ বছর ধরে একাধিপত্য জারী না করে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা দেখিয়ে মালিকানা হারাল আর একদল উগ্রপন্থী হিন্দু অসহিষ্ণুতায় মসজিদ ভেঙে জমির দখল পেল - মনের ভেতর এ দুঃখ থাকাটা স্বাভাবিক । তবে এই সামান্য দুঃখের দাম নিশ্চয়ই হাজারো নিরপরাধের রক্তের দাম এর সমতুল্য নয় ?
এখানে অনেকেই বলতে পারে আইন চলবে নিজস্ব গতিতে । রাজনৈতিক বিবেচনায় না । ওয়েল, তাহলে বলবো আপনি আইন বুঝেন না । আইনে বিজ্ঞ বিচারকদের একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে । যাকে বলে বিচারকের বিবেচনাধীন ক্ষমতা (Discretionary Power) । এই ক্ষমতা বলে বিচারক সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত ক্ষমতার মধ্যে দিতে পারে । পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স এখানে একমাত্র কারণ না । বাংলাদেশে যারাই এই রায়ের বিরোধিতা করেছে তারা আসলে জ্ঞান স্বল্পতায় ভুগছে । আর হ্যাঁ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়া ঈমানদার বাঙ্গালীদের পরস্পর বিরোধী স্ট্যাটাসে আমি বিরক্তির সাথে সাথে একটা মজার দিকও খুঁজে পাচ্ছি । যে ব্যক্তিটি রাতদিন ভারত বিরোধী স্ট্যাটাস দিয়ে হোম পেইজ কাঁপায় । তাকেই দেখি বাবরী মসজিদ নিয়ে আবেগতাড়িত স্ট্যাটাস দিচ্ছে । ভারতের মুসলমানরা তো ভারতেরই তো অংশ । ভারতের শাসন ক্ষমতার অংশ। আপনি যখন ভারতকে গালি দেন পক্ষান্তরে আপনি সেখানকার মুসলিমদের সহ গালি দেন । এগুলো এক ধরনের হিপোক্রেসি ।
ভারতবর্ষের মাটিতে ব্রিটিশ সূর্য অস্ত গিয়েছে আজ ৭২ বছর । ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িকতা সুতো দিয়ে আমরা আজো সাম্প্রদায়িকার লাল চাদর বুনে চলেছি । এই চাদর দীর্ঘে প্রস্থে আরো প্রসারিত হচ্ছে । এই প্রসারণ বন্ধ হবে না । অন্ততকাল চলবে । বাবরী মসজিদ দখল এসেছে সামনে আছে তাজমহল ।
শান্তনু চৌধুরী শান্তু
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১৬