somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঋণগ্রহীতা এবং চেক ডিজঅনারের অভিযোগ

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না বা দেবে না জানা সত্ত্বেও কেউ যদি টাকা উত্তোলনের জন্য নিজ হিসাবের কোনো চেক অন্য কাউকে দেন এবং যথারীতি ব্যাংক কর্তৃক সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে ঘটনাটি চেক প্রদানকারীর একটি অপরাধ, যার জন্য প্রত্যাখ্যানের শিকার হওয়া ব্যক্তি চাইলে কতিপয় শর্ত পূরণপূর্বক চেক প্রদানকারীর বিরুদ্ধে নালিশি মামলা দায়ের করতে পারেন। প্রচলিত ভাষায় এটাই চেক ডিজঅনারের মামলা হিসেবে পরিচিত। চেকের ধারক টাকা পাবেন না জানা সত্ত্বেও চেক দিয়ে কেউ যাতে সে রকম ধাপ্পাবাজি না করেন, সে জন্যই আইনে চেক ডিজঅনারের ঘটনাটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং সময় সময় সংশোধনী আনার মাধ্যমে তা জোরদার করারও প্রয়াস গৃহীত হচ্ছে।
চেক ডিজঅনারের মামলাগুলো ‘দ্য নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১’ (সংক্ষেপে এনআই অ্যাক্ট)-এর বিধানমতে (১৩৮-১৪১ ধারা) চালিত হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে পরবর্তী বিভিন্ন সময় এ বিষয়টিতে বেশ কিছু সংশোধন বা পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন, আগে তর্কিত চেক দেওয়ার উদ্দেশ্যে যদি থাকত কোনো ‘ঋণ’ বা ‘দায়’ থেকে অব্যাহতি লাভ, তাহলেই কেবল অপরাধ হতো, এখন আর সে সীমাবদ্ধতা নেই। আগে জরিমানার পরিমাণ তর্কিত চেকের মূল্যমানের দ্বিগুণ পর্যন্ত দেওয়া গেলেও এখন তা দেওয়া যায় তিন গুণ পর্যন্ত; আগে নোটিশ দেওয়া বা নোটিশের পর টাকা পরিশোধের জন্য ১৫ দিন সময় পাওয়া গেলেও এখন তা ৩০ দিন পর্যন্ত। আগে না থাকলেও এখন বিধান হচ্ছে, জরিমানা হিসেবে আদায়কৃত অর্থ দিয়ে প্রত্যাখ্যাত চেকের দাবি মেটানো হবে এবং চেক ডিজঅনারের মামলা হোক বা না হোক, দাবির কোনো অংশ যদি অনাদায়ী থেকে যায়, তাহলে দেওয়ানি মামলা করার সুযোগও প্রাপকের থাকবে এবং চেক ডিজঅনারের মামলায় দণ্ডাদেশ হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে তর্কিত চেকের মূল্যমানের অর্ধেক টাকা জমা দেওয়ার পর। মামলারবিচার হতে হয় দায়রা আদালতে।
আইনসম্মতভাবেই একটি ব্যাংক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে জামানত বা গ্যারান্টি গ্রহণ করতে পারে। কোনো ব্যাংক যদি সেসব ছাড়াই ঋণ বিতরণ কিংবা আর্থিক সুবিধা দেয়, তাহলে সেটি তার নিজের দায়। কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংকই ওই আইনসম্মত কাজের বাইরে অন্য একটি নিন্দনীয় কাজের চর্চা করে থাকে। আর সেটি হচ্ছে, ঋণগ্রহীতাকে দিয়ে নিজেদের ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে একটি হিসাব খোলানো এবং সেই হিসাবের জন্য দেওয়া চেকবইয়ের অলিখিত পাতায় ঋণগ্রহীতার স্বাক্ষর নিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দেওয়া। কনজ্যুমারস লোন বা ‘অজামানতি’ ঋণের বেলায় এর চর্চা বলতে গেলে নিয়মিত বিষয়। ঋণগ্রহীতা যদি সময়মতো ঋণের সম্পূর্ণ বা কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন, তাহলে ব্যাংকটি নিজেকে গ্রহীতা ও প্রাপক এবং ঋণগ্রহীতাকে দাতা ইস্যুকারী দেখিয়ে একটি চেক পূরণ করে এবং যথারীতি ডিজঅনারড দেখিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর আদালতে গিয়ে চেক ডিজঅনারের মামলা করে। ব্যাংক কর্তৃক চেক ডিজঅনার মামলা আনার উদ্দেশ্য ও সাফল্য এখানেই। কারণ, চেক ডিজঅনারের নোটিশ পেয়ে কিংবা মামলায় পড়ে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি শুধু কিস্তি নয়, পুরো ঋণের দাবিই শোধ করে ফেলার চেষ্টা করেন, যার দরুন ব্যাংকটিকে পাওনা আদায়ের জন্য অপেক্ষা বা অর্থ ব্যয় করা লাগে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংকের এ রকম আচরণ আইনসিদ্ধ কি না?
বর্তমানে ফৌজদারি আদালতগুলোতে চেক ডিজঅনার মামলার ফরিয়াদি হিসেবে ব্যাংগুলোর গিজগিজে উপস্থিতিতে ওই রকম প্রশ্ন অবান্তর বা বাহুল্য বলে মনে হলেও কয়েকটি বিষয় খতিয়ে দেখলে মানতেই হবে যে, ব্যাংক কর্তৃক চেক ডিজঅনারের মামলা আনা বেআইনি ও অনৈতিক তো বটেই, রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণারও শামিল। কারণ, ঋণ আদায়ের বৈধ পন্থা হচ্ছে জামানত হিসাবে রাখা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় কিংবা ক্ষেত্রমতো দেওয়ানি (মানিস্যুট বা অর্থঋণ) আদালতে মামলা করা। খরচ বা কষ্ট পরিহার কিংবা কোর্ট ফি ফাঁকি দেওয়ার জন্য তা না করে সাজানো চেক ডিজঅনারের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা আনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতারণা নয় তো কী? ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আগাম স্বাক্ষর নিয়ে রাখা পাতায় পরবর্তী সময়ে নিজেদের সুবিধামতো তারিখ ও টাকার অঙ্ক বসিয়ে চেক তৈরি করাটাও নিঃসন্দেহে জালিয়াতি বা মিথ্যা দলিল তৈরির অপরাধ (দণ্ডবিধির ৪৬৩-৪৬৫, ৪৬৮ ধারা)। যেকোনো নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টের মতো একটি বৈধ চেকের কার্যকারিতারও অন্যতম শর্ত হচ্ছে, প্রদানকারীর চুক্তি করার যোগ্যতা ও অবাধ সম্মতি থাকা (এনআই অ্যাক্টের ২৬ ও ৫৮ ধারা একত্রে পঠিত)। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে যে স্বাক্ষরযুক্ত অলিখিত পাতা দিতে ঋণগ্রহীতাকে বাধ্য করার জন্য ঋণদানকারী ব্যাংকটি হয় এ আশ্বাস দেয়, প্রক্রিয়াগত কারণে সেগুলো নিয়ে রাখা হলেও ঋণগ্রহীতার হিসাব থেকে ব্যাংকের হিসাবে টাকা ডেবিট করার সুযোগ এলেই কেবল চেকটি ইস্যু করানো হবে এবং তা তাকে জানিয়েই। কিংবা এই বলে অসংগত প্রভাব খাটানো হয় যে তা না করলে ঋণের টাকা ছাড় করা হবে না। তখন ঋণের জন্য উদগ্রীব লোকটি উপায়ান্তর না দেখে ব্যাংকের প্রত্যাশাই মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু সেটি যে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তির অবাধ সম্মতির (ফ্রি কনসেন্ট) ফসল নয়, তা তো বলাই বাহুল্য। ক্ষেত্রবিশেষে একই ব্যক্তি কোনো চেকের গ্রহীতা ও প্রাপক—উভয়টি হতে পারলেও আইনের (১৩৮ ধারা) প্রত্যাশা অনুযায়ী চেক ডিজঅনারের অপরাধ সংঘটনের জন্য অবশ্যই তিনটি স্বতন্ত্র পক্ষের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়। যথা, চেকের দাতা (ড্রোয়ার), গ্রহীতা ব্যাংক (ড্রোয়ি) ও প্রাপক (পেইয়ি/হোল্ডার)। এই ধারায় ড্রোয়ি বোঝাতে ‘উইথ এ ব্যাংকার’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহূত হয়েছে এবং পেইয়ির জন্য ‘টু অ্যানাদার পারসন’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে এটাই বোঝানো হয়েছে যে প্রাপক ব্যক্তি হবেন ব্যাংকবহির্ভূত তৃতীয় কেউ। আইন যদি ব্যাংকটিকেও তর্কিত চেকের হোল্ডার বা পেইয়ি হিসেবে দেখতে চাইত, তাহলে ‘টু অ্যানাদার পারসন’ শব্দগুচ্ছের পর ‘অর দ্যাট ব্যাংকার’ কিংবা ‘অ্যানাদার’ শব্দটির স্থলে ‘অ্যানি’ শব্দ ব্যবহূত হতো। অর্থাৎ, কোনো ব্যাংক তার কোনো ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের অভিযোগ আনার জন্য নিজেই তিনটি পক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
যদি ধরেও নেওয়া হয়, যে চেকটি ডিজঅনারের অভিযোগ আনীত হয়েছে, সেটি ব্যাংক কর্তৃক বানানো ছিল না, তাহলেও নৈতিকতার দায় থেকে ফরিয়াদি ব্যাংক অব্যাহতি পেতে পারে না। কারণ, ঋণগ্রহীতার নামীয় হিসাবটি যেহেতু নিজেরই কাছে, সেহেতু কোনো চেক গ্রহণের আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা হিসাবে রয়েছে কি না, তা যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ ও দায়িত্ব অবশ্যই ব্যাংকটির রয়েছে। আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে চেক ডিজঅনারের ‘শিকার’ হওয়া থেকে মানুষকে বাঁচানো, কিন্তু ব্যাংকগুলো নিজেরাই চেক ডিজঅনারের ‘সুবিধাভোগী’ হওয়ার জন্য সে ঘটনাকে খুশি মনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়া অপরাধ, ঋণদানকারী ব্যাংকটি যদি এর সত্যিকার শিকার হয় এবং অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই যদি ফৌজদারি মামলা দায়ের করে থাকে, তাহলে ব্যাংক কর্তৃক দায়ের করা প্রায় সব মামলাই মাঝপথে কিংবা চূড়ান্ত বিচারে গিয়েও আপস হয়ে যাচ্ছে কেন বা কীভাবে?
চেক ডিজঅনার মামলায় পড়ে সেই ঋণগ্রহীতা যদি ব্যাংকের সমুদয় দাবি মিটিয়েও ফেলেন, তাহলেও ব্যাংকের জিম্মায় থাকা সম্পত্তি উদ্ধার করার জন্য ‘প্রক্রিয়াগত কারণে’ আবারও তাঁকে অতিরিক্ত টাকা ঠিকই খরচ করতে হয়।
অর্থাৎ, নিজে একাধিক অপরাধমূলক কর্ম সাঙ্গ করেই একটি ব্যাংক তার কোনো ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের অভিযোগ নিয়ে আদালতে হাজির হয়। ফলে, ঋণদাতা ব্যাংক কর্তৃক ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের অভিযোগ আনা কিংবা তার ভিত্তিতে মামলা আমলে নেওয়ার আইনসিদ্ধ সুযোগ আসলেই আছে কি না বা বর্তমানে এসবের যে চর্চা বিদ্যমান আছে, তা সামনেও চলতে দেওয়া উচিত কি না, তা ভাবার আসলেই প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক  সিনিয়র সহকারী জজ, গাইবান্ধা।

Click This Link
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×