ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না বা দেবে না জানা সত্ত্বেও কেউ যদি টাকা উত্তোলনের জন্য নিজ হিসাবের কোনো চেক অন্য কাউকে দেন এবং যথারীতি ব্যাংক কর্তৃক সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে ঘটনাটি চেক প্রদানকারীর একটি অপরাধ, যার জন্য প্রত্যাখ্যানের শিকার হওয়া ব্যক্তি চাইলে কতিপয় শর্ত পূরণপূর্বক চেক প্রদানকারীর বিরুদ্ধে নালিশি মামলা দায়ের করতে পারেন। প্রচলিত ভাষায় এটাই চেক ডিজঅনারের মামলা হিসেবে পরিচিত। চেকের ধারক টাকা পাবেন না জানা সত্ত্বেও চেক দিয়ে কেউ যাতে সে রকম ধাপ্পাবাজি না করেন, সে জন্যই আইনে চেক ডিজঅনারের ঘটনাটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং সময় সময় সংশোধনী আনার মাধ্যমে তা জোরদার করারও প্রয়াস গৃহীত হচ্ছে।
চেক ডিজঅনারের মামলাগুলো ‘দ্য নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১’ (সংক্ষেপে এনআই অ্যাক্ট)-এর বিধানমতে (১৩৮-১৪১ ধারা) চালিত হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে পরবর্তী বিভিন্ন সময় এ বিষয়টিতে বেশ কিছু সংশোধন বা পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন, আগে তর্কিত চেক দেওয়ার উদ্দেশ্যে যদি থাকত কোনো ‘ঋণ’ বা ‘দায়’ থেকে অব্যাহতি লাভ, তাহলেই কেবল অপরাধ হতো, এখন আর সে সীমাবদ্ধতা নেই। আগে জরিমানার পরিমাণ তর্কিত চেকের মূল্যমানের দ্বিগুণ পর্যন্ত দেওয়া গেলেও এখন তা দেওয়া যায় তিন গুণ পর্যন্ত; আগে নোটিশ দেওয়া বা নোটিশের পর টাকা পরিশোধের জন্য ১৫ দিন সময় পাওয়া গেলেও এখন তা ৩০ দিন পর্যন্ত। আগে না থাকলেও এখন বিধান হচ্ছে, জরিমানা হিসেবে আদায়কৃত অর্থ দিয়ে প্রত্যাখ্যাত চেকের দাবি মেটানো হবে এবং চেক ডিজঅনারের মামলা হোক বা না হোক, দাবির কোনো অংশ যদি অনাদায়ী থেকে যায়, তাহলে দেওয়ানি মামলা করার সুযোগও প্রাপকের থাকবে এবং চেক ডিজঅনারের মামলায় দণ্ডাদেশ হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে তর্কিত চেকের মূল্যমানের অর্ধেক টাকা জমা দেওয়ার পর। মামলারবিচার হতে হয় দায়রা আদালতে।
আইনসম্মতভাবেই একটি ব্যাংক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে জামানত বা গ্যারান্টি গ্রহণ করতে পারে। কোনো ব্যাংক যদি সেসব ছাড়াই ঋণ বিতরণ কিংবা আর্থিক সুবিধা দেয়, তাহলে সেটি তার নিজের দায়। কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংকই ওই আইনসম্মত কাজের বাইরে অন্য একটি নিন্দনীয় কাজের চর্চা করে থাকে। আর সেটি হচ্ছে, ঋণগ্রহীতাকে দিয়ে নিজেদের ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে একটি হিসাব খোলানো এবং সেই হিসাবের জন্য দেওয়া চেকবইয়ের অলিখিত পাতায় ঋণগ্রহীতার স্বাক্ষর নিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দেওয়া। কনজ্যুমারস লোন বা ‘অজামানতি’ ঋণের বেলায় এর চর্চা বলতে গেলে নিয়মিত বিষয়। ঋণগ্রহীতা যদি সময়মতো ঋণের সম্পূর্ণ বা কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন, তাহলে ব্যাংকটি নিজেকে গ্রহীতা ও প্রাপক এবং ঋণগ্রহীতাকে দাতা ইস্যুকারী দেখিয়ে একটি চেক পূরণ করে এবং যথারীতি ডিজঅনারড দেখিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর আদালতে গিয়ে চেক ডিজঅনারের মামলা করে। ব্যাংক কর্তৃক চেক ডিজঅনার মামলা আনার উদ্দেশ্য ও সাফল্য এখানেই। কারণ, চেক ডিজঅনারের নোটিশ পেয়ে কিংবা মামলায় পড়ে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি শুধু কিস্তি নয়, পুরো ঋণের দাবিই শোধ করে ফেলার চেষ্টা করেন, যার দরুন ব্যাংকটিকে পাওনা আদায়ের জন্য অপেক্ষা বা অর্থ ব্যয় করা লাগে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংকের এ রকম আচরণ আইনসিদ্ধ কি না?
বর্তমানে ফৌজদারি আদালতগুলোতে চেক ডিজঅনার মামলার ফরিয়াদি হিসেবে ব্যাংগুলোর গিজগিজে উপস্থিতিতে ওই রকম প্রশ্ন অবান্তর বা বাহুল্য বলে মনে হলেও কয়েকটি বিষয় খতিয়ে দেখলে মানতেই হবে যে, ব্যাংক কর্তৃক চেক ডিজঅনারের মামলা আনা বেআইনি ও অনৈতিক তো বটেই, রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণারও শামিল। কারণ, ঋণ আদায়ের বৈধ পন্থা হচ্ছে জামানত হিসাবে রাখা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় কিংবা ক্ষেত্রমতো দেওয়ানি (মানিস্যুট বা অর্থঋণ) আদালতে মামলা করা। খরচ বা কষ্ট পরিহার কিংবা কোর্ট ফি ফাঁকি দেওয়ার জন্য তা না করে সাজানো চেক ডিজঅনারের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা আনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতারণা নয় তো কী? ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আগাম স্বাক্ষর নিয়ে রাখা পাতায় পরবর্তী সময়ে নিজেদের সুবিধামতো তারিখ ও টাকার অঙ্ক বসিয়ে চেক তৈরি করাটাও নিঃসন্দেহে জালিয়াতি বা মিথ্যা দলিল তৈরির অপরাধ (দণ্ডবিধির ৪৬৩-৪৬৫, ৪৬৮ ধারা)। যেকোনো নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টের মতো একটি বৈধ চেকের কার্যকারিতারও অন্যতম শর্ত হচ্ছে, প্রদানকারীর চুক্তি করার যোগ্যতা ও অবাধ সম্মতি থাকা (এনআই অ্যাক্টের ২৬ ও ৫৮ ধারা একত্রে পঠিত)। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে যে স্বাক্ষরযুক্ত অলিখিত পাতা দিতে ঋণগ্রহীতাকে বাধ্য করার জন্য ঋণদানকারী ব্যাংকটি হয় এ আশ্বাস দেয়, প্রক্রিয়াগত কারণে সেগুলো নিয়ে রাখা হলেও ঋণগ্রহীতার হিসাব থেকে ব্যাংকের হিসাবে টাকা ডেবিট করার সুযোগ এলেই কেবল চেকটি ইস্যু করানো হবে এবং তা তাকে জানিয়েই। কিংবা এই বলে অসংগত প্রভাব খাটানো হয় যে তা না করলে ঋণের টাকা ছাড় করা হবে না। তখন ঋণের জন্য উদগ্রীব লোকটি উপায়ান্তর না দেখে ব্যাংকের প্রত্যাশাই মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু সেটি যে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তির অবাধ সম্মতির (ফ্রি কনসেন্ট) ফসল নয়, তা তো বলাই বাহুল্য। ক্ষেত্রবিশেষে একই ব্যক্তি কোনো চেকের গ্রহীতা ও প্রাপক—উভয়টি হতে পারলেও আইনের (১৩৮ ধারা) প্রত্যাশা অনুযায়ী চেক ডিজঅনারের অপরাধ সংঘটনের জন্য অবশ্যই তিনটি স্বতন্ত্র পক্ষের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়। যথা, চেকের দাতা (ড্রোয়ার), গ্রহীতা ব্যাংক (ড্রোয়ি) ও প্রাপক (পেইয়ি/হোল্ডার)। এই ধারায় ড্রোয়ি বোঝাতে ‘উইথ এ ব্যাংকার’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহূত হয়েছে এবং পেইয়ির জন্য ‘টু অ্যানাদার পারসন’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে এটাই বোঝানো হয়েছে যে প্রাপক ব্যক্তি হবেন ব্যাংকবহির্ভূত তৃতীয় কেউ। আইন যদি ব্যাংকটিকেও তর্কিত চেকের হোল্ডার বা পেইয়ি হিসেবে দেখতে চাইত, তাহলে ‘টু অ্যানাদার পারসন’ শব্দগুচ্ছের পর ‘অর দ্যাট ব্যাংকার’ কিংবা ‘অ্যানাদার’ শব্দটির স্থলে ‘অ্যানি’ শব্দ ব্যবহূত হতো। অর্থাৎ, কোনো ব্যাংক তার কোনো ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের অভিযোগ আনার জন্য নিজেই তিনটি পক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
যদি ধরেও নেওয়া হয়, যে চেকটি ডিজঅনারের অভিযোগ আনীত হয়েছে, সেটি ব্যাংক কর্তৃক বানানো ছিল না, তাহলেও নৈতিকতার দায় থেকে ফরিয়াদি ব্যাংক অব্যাহতি পেতে পারে না। কারণ, ঋণগ্রহীতার নামীয় হিসাবটি যেহেতু নিজেরই কাছে, সেহেতু কোনো চেক গ্রহণের আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা হিসাবে রয়েছে কি না, তা যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ ও দায়িত্ব অবশ্যই ব্যাংকটির রয়েছে। আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে চেক ডিজঅনারের ‘শিকার’ হওয়া থেকে মানুষকে বাঁচানো, কিন্তু ব্যাংকগুলো নিজেরাই চেক ডিজঅনারের ‘সুবিধাভোগী’ হওয়ার জন্য সে ঘটনাকে খুশি মনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়া অপরাধ, ঋণদানকারী ব্যাংকটি যদি এর সত্যিকার শিকার হয় এবং অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই যদি ফৌজদারি মামলা দায়ের করে থাকে, তাহলে ব্যাংক কর্তৃক দায়ের করা প্রায় সব মামলাই মাঝপথে কিংবা চূড়ান্ত বিচারে গিয়েও আপস হয়ে যাচ্ছে কেন বা কীভাবে?
চেক ডিজঅনার মামলায় পড়ে সেই ঋণগ্রহীতা যদি ব্যাংকের সমুদয় দাবি মিটিয়েও ফেলেন, তাহলেও ব্যাংকের জিম্মায় থাকা সম্পত্তি উদ্ধার করার জন্য ‘প্রক্রিয়াগত কারণে’ আবারও তাঁকে অতিরিক্ত টাকা ঠিকই খরচ করতে হয়।
অর্থাৎ, নিজে একাধিক অপরাধমূলক কর্ম সাঙ্গ করেই একটি ব্যাংক তার কোনো ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের অভিযোগ নিয়ে আদালতে হাজির হয়। ফলে, ঋণদাতা ব্যাংক কর্তৃক ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের অভিযোগ আনা কিংবা তার ভিত্তিতে মামলা আমলে নেওয়ার আইনসিদ্ধ সুযোগ আসলেই আছে কি না বা বর্তমানে এসবের যে চর্চা বিদ্যমান আছে, তা সামনেও চলতে দেওয়া উচিত কি না, তা ভাবার আসলেই প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক সিনিয়র সহকারী জজ, গাইবান্ধা।
Click This Link
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।