
ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল অনেক বিষয়ই ক্লিয়ার করে দিয়েছে…এর পাশাপাশি আমাদেরও একটা ধারণা দিচ্ছে কে জিতবে সামনের ইলেকশনে…
ডাকসুর নির্বাচনে শিবির বলতে গেলে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে। নির্বাচনে কিছু সুক্ষ্ণ কারচুপির ব্যাপার যে থাকতে পারে, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু এরপরও যে শিবিরের প্রার্থীরা এত বেশি ব্যবধানে জয়লাভ করেছে, এর পিছনে তো এইটাই কারণ যে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাদের ভোট দিয়েছে। কেন এমনটা হলো?
কারণ আর কিছুই না…দেশে ডানপন্থার উত্থান (আমার মতে)! মানি আর না মানি, এটাই এখনকার রাজনীতির সবচেয়ে আসক্তিকারক ট্রেন্ড!
হ্যাঁ, এটাই সত্য! গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ৫ আগস্টের পরে দেশে ডানপন্থার উত্থান আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে হয়েছে। এর অনেকটাই ঘটেছে সরকার, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনে। কিন্তু হয়েছে তো! বিশেষ করে, জেনজির ভিতরে ডানপন্থা বা ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি আসক্ত হওয়ার পরিমাণ আরো বেশি।
ডানপন্থা মানে কিন্তু এই না যে সবাই জামাতে ইসলামি বা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে (চরমোনাইয়ের দল) সমর্থন করে বা ভোট দিবে। দেশে একটা বিশাল অংশের ইসলামপন্থী মানুষ আছে, যারা শার্ট-প্যান্ট পরে, জুমার নামায ছাড়া আর কোনো ওয়াক্তেই নামায খুব একটা পড়েন না, আধুনিক জীবনযাপন করেন, এমনকি তাদের বেলাতেও দেখা যায় যে তাদের অনেকেই দেশে ইসলামকে কায়েম দেখতে চান বা ইসলামী শাসন চান। এরকম উদাহরণ আমাদের দেশে আছে ভূরিভূরি। আপনাদের জীবনের এমন মানুষ অনেক পাবেন। পাবেন আপনার পরিচিতদের মধ্যে, পাবেন রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে…অনেকই পাবেন। তো এদের অনেকেই আমি দেখেছি বর্তমানে এনসিপি বা এবি টাইপের দলকে সাপোর্ট করছে। বিশেষ করে আমি দেখেছি এনসিপির সমর্থন প্রচুর। আমার তো মনে হয় দেশের প্রাপ্তবয়ষ্ক লোকদের ভিতর কমসে কম ৭% এনসিপির সাপোর্টার। এনসিপি যেহেতু জুলাইয়ের চেতনা এবং ইসলামকে ব্যবহার ভালোভাবে করতে পারছে, প্রচুর জেন-জি লোক অবশ্যই এনসিপির পিছনে আছে। এর সাথে ধরেন, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ এবং আধা সক্রিয় অন্যান্য ইসলামি ও ডানপন্থী দলগুলোর কথা…
আমার সকল পলিটিক্যাল অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণ থেকে আসেন অনুমান করি যে এদের টোটাল ভোট কত? ফ্রি ফ্র্যাংক একটা হিসাব দেই আসেন (শতাংশের এই হিসাব জাস্ট আমার অনুমান নির্ভর; কেউ একে পুরো সত্য বা নির্ভুল মনে করবেন না, প্লিজ):
জামাতের ভোট আমার ধারণা ১৮%+ এনসিপির ভোট ৭%+ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের ভোট ৭%+গণ অধিকার পরিষদের ভোট ৩%+এবি পার্টির সমর্থন ২%+ অন্যান্য সকল ইসলামী ও ডানপন্থী দলের সমর্থন বা ভোট ৩%।
তো টোটাল কত হলো? ৪০%। জ্বি, হ্যাঁ…সবগুলো ইসলামিস্ট বা ডানপন্থী দলের টোটাল ভোট এখন এমনটাই হওয়া খুবই সম্ভব।
এবার আসেন, অন্যান্য দলের ভোটের হিসাবটা একটু করিঃ
১। এই ইন্টেরিমের অধীনে নির্বাচন হলে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগকে অংশ নিতে পারবে না। দেশে বর্তমানে আমার মতে, লীগের ভোট আছে ২৫-৩০%।
২। জাতীয় পার্টিরও মোট ভোট ভালোই আছে দেশের উত্তরাঞ্চলে, যেটা টোটাল প্রায় ৭-৮% হবে বলে
তাহলে, বাকি ভোটারদের পারসেন্ট অবশিষ্ট থাকেঃ
ডানপন্থীদের মোট ভোট ৪০%+লীগের ভোট ২৫%+ জাতীয় পার্টির ভোট ৫%= ৭২%।
তাহলে বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের জন্য সর্বোচ্চ ভোট অবশিষ্ট থাকে ২৮%। সর্বোচ্চ ৩০% ও যদি ধরি, তাহলেও কিন্তু ডানপন্থীদের 'ইসলামী মহাজোট’(সকল ইসলামী বা ডানপন্থী দল, সাথে এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদের মতো দল মিলে যে সম্ভাব্য জোট হওয়াটা আলোচনায় রয়েছে)-এর চেয়ে তাদের মোট ভোট কিন্তু বেশ কম। তাও ১০%-এর মতো।
যদিও মোট ভোটের শতাংশের পরিমাণ স্রেফ পিআর ভোটেই কার্যকর, আসনভিত্তিক ভোটে নয়, তারপরও কিন্তু সলিড বা ফেয়ার ভোটেই বিএনপির নির্বাচনে হেরে যাবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এরপরও যদি নির্বাচনে বিএনপি সামহাউ ভোটে বেশি আসনে এগিয়ে থাকে, তবে সেক্ষেত্রেও আমার মনে হয় সেটাকে ট্যাকল দেওয়ার কৌশল ডানপন্থীদের জোটের থাকবে…অনেকেই বলছেঃ বিএনপি দখল করার দিকে মনোযোগী ছিল বাস, লঞ্চ, টেম্পুস্ট্যান্ড; আর ওদিকে জামাত মনোযগী ছিল দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন ও প্রশাসনের উচ্চ পদগুলোতে নিজেদের লোক সেট করার দিক দিয়ে। আমার মনে হয়, কথাটা অসত্য না। যেহেতু প্রশাসনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখন জামাত-এনসিপির লোক, সেহেতু সুক্ষ্ণ কারচুপি করে সেই ফারাকটুকু মুছে দিয়ে ‘ইসলামী মহাজোটকে’ বিজয়ী করে দেওয়া খুব বড় কোনো ব্যাপার হবে না যদি তাদের সেরকম কোনো উদ্দেশ্য থাকে!
এটাইা বাস্তব অবস্থা, মানি আর না মানি!
তবে, সেটা বোঝা সবার কম্ম না। সম্প্রতি সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না ভাই গ্রেফতার হয়েছেন বলতে গেলে সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে। কয়েকমাস আগে আমি একদিন তাকে ফেসবুকের ইনবক্সে বলেছিলাম যে দেশে তো এনসিপির সমর্থন অনেক বাড়ছে ধীরে ধীরে। উনি আমার সাথে একমত হননি। বলেছিলেন, ‘আমি তেমনটা মনে করি না!’ দেশে যে ডানপন্থার বাড়বাড়ন্ত উত্থান হচ্ছে, সেই ব্যাপারে আমি ইনবক্সে অভিমত জানিয়েছিলাম বিশিষ্ট পলিটিক্যাল এনালিস্ট ডাঃ জাহেদ উর রহমান ভাইকে। কিন্তু তিনিও আমার কথা খুব একটা আমলে নেননি।
শুধু, সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার শাহেদ আলম ভাই-ই দেশে যে এখন প্রচুর মানুষ ডানপন্থী শাসন চায়, সেই ব্যাপারে আলোকপাত করেছিলেন তাঁর এক ভিডিওতে।
কিন্তু এখন ডাকসু নির্বাচন যেন আমার কথারই প্রামাণ্য উদাহরণ হিসেবে এসেছে। হ্যাঁ, বাস্তবতা এটাই!
ডাকসু নির্বাচন পুনশ্চঃ অনেকেই বলছেন, বিএনপির নানান অপকর্ম ও লীগের উপর নিপিড়নের কারণেই লীগের ভোটগুলো সব জামায়াতের বাক্সে গেছে। এমনকি অনেক কথিত বিখ্যাত পলিটিক্যাল এনালিস্টও এমনটা বলছেন। এছাড়াও, অনেকেই মনে করছে জামাত-শিবিরের সাম্প্রতিক সুকর্ম এবং বিএনপি-ছাত্রদলের অপকর্মই এই বিশাল ভূমিধস বিজয়ের পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল। আমি তেমনটা মনে করি না…কারণটা খুলে বলছি!
জামাতের নিজেদের অপকর্মও কিন্তু কম নেই। বিএনপি প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, দখলবাজি করে; কিন্তু জামাত করে ‘হাদিয়ার নামে চাঁদাবাজি।’ এর পাশাপাশি, লুকিয়ে দখলবাজি করার অভিযোগ আছে তাদের নামে। ধর্মকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার, ‘মুখে এক অন্তরে আরেক’ মার্কা মুনাফেকি আচরণ, ধর্মের নামে মিথ্যা বলা ও কাজ করা, এদের বটবাহিনির অকথ্য ও অগ্রহণযোগ্য কাজকর্মের বিশাল দক্ষযজ্ঞ, বটবাহিনি ও সমর্থকদের মাধ্যমে এর-ওর চরিত্রহননের চেষ্টা, চরম অপ্রপ্রচারে এদের ধারেকাছে কেউ নেই। এর পাশাপাশি, একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধকে এখনো অস্বীকার, এখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা এমনকি বীরশ্রেষ্ঠদেরও অপমান করা, পাকিস্তানের সাথে, উগ্রবাদীদের সাথে মাখামাখি— এগুলোই যথেষ্ট দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে এদের অজনপ্রিয় হওয়ার জন্য। কেননা, এসব কাজের অধিকাংশই ইসলামী আদর্শের সাথেও যায় না। আর এদের গুপ্ত রাজনীতি, গুপ্ত ষড়যন্ত্র, মিথ্যার বেসাতি ও মিথা জীবনযাপন নিয়ে আর কী বলব? এরা যে আসলে কোন কোয়ালিটির, তা এই একটা জিনিস থেকেই বোঝা যায়।
কাজেই, জামাত-শিবিরের ভালো কাজ, আচরণ এবং বিএনপি, ছাত্রদলের মন্দ কাজ বা আচরণের ফলাফলে ডাকসুতে শিবির জিতেছে, এমন ধারণা খুব একটা সঠিক বলা যাবে না। শিবিরের ভূমিধস বিজয়ের কারণ হলো সম্প্রতি দেশে এবং বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডানপন্থী আদর্শের ব্যাপক উত্থান। সেটার পিছনে আবার অন্যতম কারণ গত এক দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রছাত্রী! এখন ডানপন্থী আদর্শ বা চিন্তাধারার প্রায় সকল ভোট যদি শিবিরের প্রার্থীদের পকেটে যায়, তবে সেটাই তাদের কিন্তু অনেক এগিয়ে রাখে। আর এর সাথে তলে তলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে ও বাগছাস-এর সমর্থকদের ভোট যদি জামাতের প্যানেলে যাওয়ার জন্য ঠিক হয়ে থাকে, তবে সেটা তো জামাতের প্রার্থীদের বিজয়ের জন্য যথেষ্ট! তেমনটা যদি ডাকসু ইলেকশনে হয়ে থাকে, খুব অবাক হবার মতো কিছু কি থাকবে?
কাজেই, ডাকসু ইলেকশনে যেমনটা হয়েছে, এর প্রতিফলন যদি জাতীয় নির্বাচনে দেখা যায়, তাহলে খুব বেশি অবাক হবার কিছু কী থাকবে?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


