আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
আলকাশ প্রথম পর্বঃ Click This Link
. আলকাশ
[আলকাশের সঠিক বাংলা অভিধানিক অর্থ আমার জানা নেই। মদে যার প্রচন্ড আসক্তি-মদ ছাড়া যে একটা মূহুর্তের কথা ভাবতে পারেনা তাদেরকে রুশীয়রা তাচ্ছিল্য করে ‘আলকাশ’বলে ডাকে। ইংরেজীতে যাকে বলে ‘এ্যালকোহলিক’(কিন্তু আলকাশ শব্দের অর্থ ঠিক এ্যালকোহলিক নয়, এটা কিছুটা বিদ্রপাত্মক, কিছুটা শ্লেষাত্মক-আবার কিছুটা মজা করার জন্যও বন্ধু বলে বন্ধুকে কিংবা প্রেমিক প্রেমিকাকে) এর অর্থ আমরা ধরে নিই মদ-আসক্ত। যাকে নিয়ে আমার এই লেখা তাকে আমি ঘনিষ্ঠ ভাবেই চিনি। প্রায় দেড় যুগেরও বেশী সময় তার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আমার সেই বন্ধু নিজে থেকেই হারিয়ে গেছে-হয়তো চিরতরে…। এই লেখাটা তাকে উৎসর্গ করছিনা –করছি ভাগ্য বিড়ম্বিতা সেই বিদেশীনিকে;যাকে সে ভালবেসেছিল।]
সে রাতের পর থেকে আমার জীবন-যাপন আমুল পাল্টে গেল!
মইন আর লারিসার আমাকে আর বিশেষ একটা দরকার পরে না। ওরা নিজেদের নিজেরা বুঝে নিয়েছে খানিকটা। প্রথম চুম্বনের পর তাদের শারিরিক মেলামেশা বেড়েছে একটুখানি। আমার বর্তমান - বা অনুপস্থিতি ভাল বাসায় ব্যাঘাত ঘটায় না। শরিরের ছোঁয়াছুঁয়িতে ভাষা লাগেনা। শরিরের-ই এক নিজস্ব আদিম ভাষা আছে। তবে লারিসা সর্বক্ষণ সংকুচিত থাকে। হয়তো মনটাকে সে এখনো বশে আনতে পারেনি, দ্বীধা –দ্বন্দে কাছে আসার সংকোচ। ওদের মান-অভিমানে বা তীব্র উচ্ছাসে আমার ডাক পড়ে।
আমি তখন অন্য ভুবনের বাসিন্দা! সে রাতের গান গুলো শুনি সর্বক্ষণ আর মহা সুমুদ্রের এ-কুলে ও-কুলে আবেগে ভাসি।
মন বলে সে ফের আসবে না –আর অন্তর বলে এ প্রেম এভাবে হারাবার নয়।
লারিসা আমার মনের ভাষা পড়ে ফেলে টপ করে আর মইন তাকে খোঁচায়!! আমি বুঝি লিয়েনা লারিসার বন্ধু হলেও, অর্থনৈতিক- মানসিক দুরত্ব বেশ অনেকখানি। ফোন করে আসতে বলতে তার দ্বীধা। কিন্তু মইন নাছোড় –অবশেষে দ্বীধা ঝেড়ে লারিসা ওকে ফোন দেয়।
পৃথিবীতে অতি আশ্চর্যজনক কত কিছুই না প্রতিদিন ঘটে। তেমনি ভাবেই আমাকে ভীষণ ভাবে অবাক করে দিয়ে, লিয়েনা কথা দিল আসবে। সাথে আবার একটু মাখন স্প্রেড করল, আমাদের সাথে গল্প করে তার নাকি ভাল লেগেছে।
এত সুখের মাঝেও বুকের এককোনে কোথায় যেন সারাক্ষন কাটার মত বিঁধত। আবেগ ঝেড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসতাম। ভাবতাম,আমি এদেশে এসেছি কি এভাবে নিস্কর্মার মত শুয়ে বসে আড্ডা মেরে দিন কাটানোর জন্য?সেই সাথে কারো অনুগ্রহ(তার মধ্যে যতই আন্তরিকতা থাকুক না কেন)করুনা সেই সাথে সহানুভুতি সহমর্মিতার জোয়ারের সামনে নিজেকে বড় বেশী অপাঙ্ক্তেয় মনে হত।
অপেক্ষা করতাম মস্কো থেকে একটা বিশেষ ফোন কলের,আনিস ভাই আমাকে বলছেন ;‘জলদি চলে এসো,পারলে বিমানে করে —কালকেই,তোমার টাকা রেডি’। হাঃ! এখন মনে হয় এটা তখন শুধুই সপ্নেই সম্ভব ছিল। কেননা আমি জানতাম না যে, মস্কো থেকে এখানে আসার মাস দুয়েকের মধ্যে সেই ব্রাদারের অর্থনৈতিক অবস্থার আরো শোচনীয় অবনতি হয়।সব দায় থেকে মুক্ত হওয়ার মানসে (!) তখন কিছু ভয়ঙ্কর ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ততদিনে তার প্রায় ভিখেরির দশা হয়েছিল,পাওনাদারদের চাপে পালাবার পথ পাচ্ছিল না।সুবিধাভোগী বন্ধুরা সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে।
-কি ভাই কি এত ভাবেন? সমস্যা তো সল্ভ।
আমি শুকনো মুখে হাসি, বলি- ভাইরে এভাবে আর কতদিন! আমাকে তো যেতে হবে।
-ফাও প্যাচাল বাদ দেন। আমার বিয়ে সাদির আগে এখান থেকে কোন নড়া-চড়া নাই। আর যাবেন কই? আনিস ভাইতো ভাগছে।
উত্তর খুজে না পেয়ে আমি তার দিকে করুন উদাস চোখে তাকাই। সে আমাকে আশ্বাস দেয়;
-বিয়েটা হোক তারপরে আপনার পড়াশুনার দায়িত্ব সব আমার। ওঠেন ওঠেন গা ঝাড়া দেন। কালকে-তো আসতেছে, বলেই চোখে আমাকে অন্যরকম ইশারা করে। বাপ বলে হেভী মালদার। ভাই, লাক একখান আপনের। যদি পটাইতে পারেন- তাহলে দুইজনে মিলে একসাথে বিয়ে করব। ভাবেন একবার , তাক লাগানো ব্যাপার হবে!
মলদোভিয়ার ইতিহাসে আমাদের নাম উঠে যাবে!!
আমি আড়মোড় ভাঙ্গতে চাই, কিন্তু ফের এসে হানা দেয় লিয়েনা আমার দিবা সপ্নে! তার আগমনের ঝড়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়।
অবশেষে লিয়েনা আসল। হাতে এক গোছা ফুল আর মায়ের হাতে বানানো কেক নিয়ে, এবার তার পরনে ছিল সাদা-কালো চওড়া স্ট্রাইপের সার্টিনের শার্ট আর হাটু অব্দি ঝোলানো কালো স্কার্ট । পায়ে উচু হিলের জুতা। অতি সাধারন রঙের পোশাকে কোন নারীকে এত অসাধারন লাগে, লিয়েনাকে না দেখলে বুঝতাম-ই না। মুখে একটু রুজ-পাফ বোলায় না কিন্তু কি উজ্জ্বল ধারালো তার মুখের জ্যোতি। সেদিন দেখেছিলাম, গোধুলী লগ্নে সূর্যের সোনালী আভায়। আর আজ দেখলাম তাহার-ই অসীম কৃপায় পরিপূর্ণ আলোতে। এ মেয়ে চলনে –বলনে, পোষাকে-গড়নে আর দশটা রুশ মেয়েদের থেকে ভিন্ন। উজ্জ্বল শুভ্র ত্বক, ঢেউ খেলানো কালো কেশগুচ্ছ, গাঢ় কৃষ্ণ আই-ব্রো, গভীর কাক চক্ষু জলের মত চোখ,অতি আকর্ষণীয় পৃথুলা গড়নের পাশে অন্য নারীদের ফিকে লাগে। কেশগুচ্ছ দুলিয়ে ভারী বক্ষ আর নিতম্বে ঝড় তুলে যখন ব্রজেশ্বরী চলেন তখন নেহায়েত নিরস পুরুষ ও আড়চোখে তাকায়।
আজকে সে গল্পের মুডে আছে। সেদিনের থেকে অনেক উচ্ছল আর প্রানবন্ত। লারিসার মুখের ভাবে মনের কথা বোঝা মুশকিল, কিন্তু মইন চরম খুশি। একদিকে লারিসার সাথে এত্ত কাঠ-খড় পুড়িয়ে খানিকটা ঘনিষ্ঠতা ওদিকে আমার মনের মানুষ খুজে দেয়ায় একটু খানি সফল। সে যেন তার ঋণ শোধ করতে চাইছে।
প্রথমে চারজনে বসে একসাথে গল্প। এরপর মইনের ওয়াইন খাবার আমন্ত্রন। একটু নেশা, তারপর খানিক্ষন নাচ গান।
মদ খেলেই মইন চঞ্চল হয়ে ওঠে লারিসার শারীরিক সান্নিধ্য পাবার জন্য। আমি আর লিয়েনা ওদের একটু ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ দিয়ে বারান্দায় চলে গেলাম। আমি গল্প করি কম শুনি বেশি! বললাম না; সে আজ গল্পের মুডে আছে। পাশাপাশি বসে গল্প করলে ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে কুন্ঠা হয়, আবার সামনা সামনি বসলে ওর শারীরিক সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হই!
এ মেয়ের রুচিবোধ উচুমানের হলেও শারীরিক শুচিতা কম! কথা বলতে বলতে, কখনো শরিরের স্পর্শকাতর অংশে তার-আমার ছুঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাচ্ছে সেই নিয়ে তার মাথা ব্যাথা নেই। যত দায় আমার। আমিতো এমনিতেই খানিকটা নেশার ঘোরে আছি- তার ছোঁয়ায় পুরো পিয়ানি( বদ্ধ মাতাল) হয়ে গেলাম।
সে মেয়ে অবলীলায় গল্প করছে তার প্রাক্তন প্রেমিকদের নিয়ে। একটা দুটো নয় পুরো গন্ডা তিনেক! কোন দ্বীধা নেই, লাজুকতা, সঙ্কোচবোধ কিছুই নেই। এসব নিয়ে গল্প শুনি আর তার প্রতি ভাললাগা আমার উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। কি মুশকিল – আমার যেন মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে অপ্সরা ধারিত্রিতে এসেই আমার কোল ঘেষে বসে পড়েছে। তার সব গল্পই যেন তাকে ছাড়া মানায় না-কিংবা সব অলীক মিথ্যে বা সপ্ন!
সে আমাকে একটা করে প্রেমের গল্প বলে আর আমি বড় বড় চোখ নিয়ে অবাক হয়ে শুনি। খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করি তারপরে কি হোল? কেন যেন মনে হচ্ছিল গল্প শেষ হলেই সে চলে যাবে – আমি তাকে কোন মতেই হারাতে চাইছিলাম না। ওর সব কিছুই ভাল লাগছে তখন- দু’চার দশটা পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে জেনেও আমার কোন বিকার নেই। সত্য ক’জনে এমন অকপটে বলতে পারে।
গল্পের মাঝখানে এক হাত বাড়িয়ে করমর্দনের ভঙ্গিতে বলল, ফ্রেন্দ।(সে টুক টাক ইংরেজীও জানে)
আমি মৃদু হেসে তার হাতখানে ধরে ‘ফ্রেন্ড’ বলে- তার সামনে এক হাটু মুড়ে পানি-প্রার্থী হবার ভঙ্গিতে অনুনয় করলাম, ফের কবে দেখা হবে?
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:৫০