আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
আলকাশ প্রথম পর্বঃ Click This Link
আমার ফোনের কথা শুনে,মইন চরম হাউ-কাউ শুরু করল! মনে হচ্ছে আমি কালকেই চলে যাব।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন গুনছি তখন সুস্থ হবার। লারিসা –মইনের অভিসার চলে বারান্দার ডিভানে। ভালবাসার প্রজাপতি উড়ছে আকাশে। মইন এখন অনেকটাই নির্ভার- কিন্তু তার ঘন ঘন বাইরে যাওয়া আর মাতাল হয়ে ফিরে আসা আমার ভাল ঠেকছে না। ফোন আসলেও আমার সামনে কথা বলে না – এক্সটেনশন ক্যাবেল থাকায়, এ ঘর ও ঘর করা যায়।
সপ্তাখানেক বাদে ফের আমার ফোন!
তবে এবার করেছে লিয়েনা, লারিসা আমার হাতে রিসিভারটা ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে অন্য রুমে চলে গেল। ঠোটের ব্যাথায় কথা বলায় তখনো কষ্ট হত, কিন্তু কিসের কি? ভুলে গেলাম নিমিষে আমার ব্যথা বেদনা- আবেগের ঝুড়ি পুরোটাই উপুড় করে ধরলাম।
সেদিন একটুক্ষন এসে ফিরে যাওয়া। আমার কোন খোঁজ না নেবার জন্য কত রকমের অনুযোগ।আমি বলেই চললাম আর সে এক টানা শুনে গেল; মাঝে মাঝে একটু হাসি, মাঝে মধ্যে দ্বীর্ঘশ্বাস!
কথা বলতে বলতে আমি হাপিয়ে উঠলাম। শেষ দিকে সে শুধু আমকে বলল ‘শোন’? এক শব্দে আমি ভাষা হারালাম।
‘তে লুবেস্তে!’ কি ক্কি কি বললে? আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই সে একটা গাঢ় চুম্বন দিয়ে ফোনটা রেখে দিল।
তে লুবেস্তে, তে লুবেস্তে...তে লুবেস্তে যেন পৃতিবীর সব বর্ণ, শব্দ, বাক্য তিরোহিত হয়ে গেছে আমার মস্তিস্ক থেকে।
যেন সু-দীর্ঘ কোমা থেকে ফিরে আসার পরে আমি শুধু একটাই বাক্য স্মরন করতে পারি,- তে লুবেস্তে!
লিয়েনার একটা কথা আমার জন্য ম্যাজিকের মত কাজ করল। তারপর দিনই নাকের গজ ফেলে দিলাম( ডাক্তার বলেছিল, নিদেন পক্ষে মাস খানেক রাখতে হবে) মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে আমি ভুলেই গেছি যে, আমার এক জোড়া নাকের ফুটো আছে!
ঠোটের ক্ষতটাই বেশি ভোগাচ্ছিল। সেটার ব্যাথাও ভুলে গেলাম! তিন দিনের মাথায় আমি মুক্ত আকাশের নীচে আঁশ মিটিয়ে শ্বাস নিলাম।
অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক ভেবেছি; কেন ওরা এভাবে আমাকে নির্দয়ের মত আঘাত করল? প্রথমবার যখন অজ্ঞান হই,অস্পস্ট মনে আছে আমি যখন ‘বাড়ি নম্বর’ দেখার জন্য ঘাড় ঘোড়ালাম তখন ওরা সুযোগ বুঝে আমার ঘাড়ে আঘাত করেছিল।আঘাতটা এত সুক্ষ আর পারফেক্ট ছিল যে তখুনি আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ি।
যদি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যেই ওরা আমাকে আক্রমন করবে তবে কেন জ্ঞান হারানোর পরে কেন ওরা লাথি ঘুষি কষেছিল।
আমার মানিব্যাগ অক্ষত ছিল ওখান থেকে একটা টাকাও খোয়া যায়নি । শুধুমাত্র গলার সরু একটা সোনার চেন আর হাতের কমদামী (মাথার খুলি আকৃতির)একটা আংটি খুলে নিয়ে গেছে ।
আঘাতের হিংস্রতা দেখে মনে হয় এটা পুর্ব শত্রুতার জের বা কোন আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ!ওদের মুলত উদ্দেশ্য ছিল আমাকে আঘাত করা- ছিনতাইয়ের বিষয়টা সম্ভবত সাজানো।
কিন্তু এখানেতো আমার সাথে কারো ব্যাবসায়িক বা লেনদেনের সম্পর্ক নেই। যতদুর মনে হয় এখানে যে কয়ঘর বাঙ্গালী আছে তাদের কারো সাথেই কখনো ঝগড়া বিবাদ মায় কটুবাক্য বিনিময় হয়নি। অন্যকারো প্রেমিকা বা বান্ধবীর দিকে কু —নজরে তাকিয়েছি বলে মনে পড়েন। তবে?
তবে কি মইন ভেবে আমাকে মেরেছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানি কোনদিনও পাবনা।
বাইরে থেকে ফিরে এসে দেখি, মইন ঝিম মেরে বসে আছে! কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আজকে সে দুপুর বেলাতেই মদের বোতল খুলে বসেছে। লারিসা কয়েকবার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে পাত্তা না পেয়ে আন্দ্রের ঘরে শুয়ে আছে। মইনের সঙ্গী শুধু ‘রো’- এ বাড়িতে অমঙ্গলের মেঘ যে ঘনীভূত হচ্ছে সেটা তার অনুমিত হচ্ছিল। এক থাবার উপরে মাথা রেখে , কপালে বিরাট চিন্তার ভাঁজ ফেলে-একবার আমার একবার মইনের দিকে তাকাচ্ছে।
আমার প্রশ্নবান থেকে মুক্তি পাবার মানসে, মইন গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। কিস্যু হয় নাই। চলেন বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
লারিসাকে বলেন ও যাবে নাকি?
পরদিন থেকে মইনের অন্য চেহারা। মদ খাওয়া আরো বেড়ে গেল! টেলিফোনে কাদের সাথে যেন উচ্চস্বরে হড়বড়িয়ে কথা বলে ( রোমানিয়ান ভাষায়)। ঝড়ের বাসা থেকে বের হয় আর ঢোকে।
একদিন আমি পেড়ে ধরলাম তাকে, কোথায় যাচ্ছেন? আমাকে সাথে নিয়ে যান। সে নানা তাল বাহানা করে আমার হাত গলে বেড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমার পাশে খুটি বেধে দাড়াল লারিসা- ওকে না নিলে তোমাকে বাসা থেকে বেরুতে দেব না। হ্যাংলা পাতলা মইন- লারিসার শক্ত গাথুনীর শরির দেখে ডরায়।ও এর মাঝেই এ মেয়ের শারিরিক শক্তির নমুনা পেয়েছে। ভাবে ত্যড়াবেড়া করলে ওকে তুলে আছাড় মারতে পারে।
দু’জনে একসাথে বের হলাম। মইন আমাকে নিয়ে সেই পুরনো পার্কে গিয়ে বসল। কোন কথা নেই চুপ চাপ –কোন এক অজানায় চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ! এতদিন আমি উচ্ছল, প্রানবন্ত, বাগাম্বর, স্টাইলিস্ট, নেশায় জড়ানো বন্ধু অন্তপ্রান মইনকে চিনতাম। তার এই রূপ আমার ভীষণ অচেনা।
আমি তার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম,- কি হয়েছে ভাই? আমাকে বলা যায়না?
কথা শেষ হতেই ,সে হাঁউ মাউ করে কেঁদে ফেলল!! -আচমকা তার এহেন আচরনে আমি বিহ্ববল হয়ে গেলাম।
-লতিফ –ভাই লতিফ আমারে শেষ করে দিছে।‘ - লতিফের কথা শুনেই আমার রাগে গা জ্বলে গেল!
কি হয়েছে খুলে বলেন?
ও বলছিল, শ’দুই লোক আছে । আগে দেবে ফিফটি আর আদম ওপারে পাঠানোর পরে ফিফটি। আপনে না করার পরেও ওর কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম। দু-চার জনের কাছ থেকে খোজ খবর-ও নিয়েছিলাম। শুনেছিলাম লোক নাকি সলিড লেন-দেনে কোন সমস্যা নেই।
প্রথমে দিল পঁচিশ ভাগ। দুই’শ লোক পাঠাবে। আমি দৌড়াদৌড়ি করে ধারে বাকিতে পারাপারের লোকদের, ও পারের ব্যাপারিরে, পুলিশরে প্রায় পুরা টাকা দিয়ে দিছি। লোক ওপারে পাঠানোর পরে লতিফ লা পাত্তা। পুলিশ-গোয়েন্দা সব লাগাইছি। শালার কোন খোঁজ নাই!
আমার মাথা তখন ঝিম ঝিম করছে। দুই’শ লোকের টাকা। বিরাট অঙ্ক! মইন এই ধাক্কা সামলাবে কেমনে? লতিফ যে বাটপার কিসিমের লোক তার ধারনাতো আমি আগেই করেছি। আমি তাকে ওর সাথে মেলামেশা খানিকটা করলেও ব্যাবসা যেন না করে সেইটে পই পই করে বুঝিয়েছি। কিন্তু সে আমাকে পাশ কাটিয়ে গোপনে তার সাথে হাত মিলিয়েছে। আর একটাই হোল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমি এর আগে যত পাকিস্থানী ব্যাবসায়ীদে সাথে মিশেছি প্রায় সবখানেই দেখেছি তাদের প্রতারনা —বাটপারী নারী ললুপতা ! আর সে যদি আদম ব্যাবসায়ী হয় তাহলেতো কথাই নেই প্রতারনা সে করবেই(—শতভাগ সম্ভাবনা)। মিস্টি কথায় মইনকে ভুলিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে,কসম কেটে আপন মায়ের পেটের ভাই পাতিয়ে‘তুভি মুসলিম হো ভাই ম্যায় ভি মুসলিম,ভাইকি সা ভাই কাভি গাদ্দারী(!)নহী কর সাক্তা’ আপ্তবানী!ঝেড়ে প্রতারনার ছুরি আমুল সেধিয়ে দিল তার হৃদয় অভ্যান্তরে।
লতিফের মত ধুরন্ধর প্রতারকের কাছে চরম ধরা খেয়ে মইন এখন হাল ভাঙ্গা পাল ছেড়া দিকভ্রান্ত কোন জাহাজের নাবিক- আর আমি তার সুকানি। নিজেকেই কেমনে সামাল দেই- ওকেই কেমনে সামলাব!
তারপরেও আশ্বস্ত করলাম। যা হবার হয়েছে এখন নতুন করে ঘুরে দাড়ান।‘ কিন্তু শান্তনার বানীতে কি কাজ হয়- ঘটনা যেটা ঘটার ঘটে গেছে! এর চড়া মুল্য দিতে হবে মইন ও লারিসার পরিবারকে-ওদিকে আমিতো আছি-ই । এ ঘানির দু’চার চক্কর আমাকেও টানতে হবে।
আমি মইন বাড়ি ফিরে দু’জনেই মুখে কুলুপ আঁটলাম। লারিসা আর তার পরিবারকে কোন ভাবেই এ ঘটনা জানানো যাবে না। ফোন ধরা বন্ধ করে মইন লারিসার কোলে মুখ গুঁজল। লারিসার প্রতি তার ভালবাসা যেন টগ-বগ করে ফুটে উঠল। সন্ধ্যে হলেই মদের বন্যা বয়ে চলে। লারিসার প্রিয় যা কিছু আছে সারা বাজার ঘুরে সব এনে জড়ো করে। লারিসা ভেবে পায়না কি যাদু মন্ত্রে তার এহেন পরিবর্তন!
সেদিনের পর থেকে লিয়েনাও মাঝে মধ্যে শরির ভর্তি জলন্ত অঙ্গার নিয়ে আসে আর আমি পতঙ্গের মত তার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেই।
আমাদের গল্প চলে অনেক রাত অব্দি! সে তার অফুরন্ত ভান্ডার থেকে ভুত-প্রেমের গল্প বলে। ওদিকে আমার ভান্ডারের তলানীতেও তেমন কিছু নেই। সত্য মিথ্যেয় মিশেলে গাজা খুরি প্রেমের গল্প ফেঁদে তাকে বলি। কেঊ কারো অতীত নিয়ে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হই না। সারাক্ষন শুধু যে এটাই আমাদের আলোচনার বিষয় বস্তু থাকে তা কিন্তু নয়। গল্প হয় পরিবার নিয়ে, দেশ নিয়ে , বন্ধু , সংস্কার, ধর্ম নিয়ে। মাঝে মধ্যে দু চুমুক ওয়াইন, প্রজ্বলিত ধুম্র শলাকায় চুম্বন আর একটু আধটু নাচ। ওর পাশে থাকলে আমার হাত –ঠোট বশে থাকে না। সারাক্ষণ উদ্গ্রীব হয়ে থাকে একটুকু ছোঁয়া, আবেশী চুম্বন কিংবা প্রলোভনের।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:৪০