somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবনিক- অবশেষে শেষ পর্ব

২১ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দেসা’র কৃষ্ণ সাগরের পারে তখনো সূর্য ডোবেনি। সূর্যস্নানে আগত স্থানীয় অধিবাসী আর পর্যটকেরা পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছে। অল্প কিছু মানুষ এদিক ওদিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে সূর্যাস্ত দেখবে বলে। মুল সাগর পাড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে বলে এদিকটা খানিকটা নির্জন। শেষ বিকেলের রক্তিম রাগ বেলাভূমিতে প্রতিচ্ছবি আঁকছে। নীলাভ সাগরের পানি ধীরে ধীরে কালচে বর্ণ ধারণ করছে। লম্বা ধুসর একটা স্কার্ট আর দুধ ধবল ফতুয়া গায়ে খালি পায়ে উষ্কখুষ্ক চুল এলিয়ে দু’পায়ে ক্রস এঁকে নির্লিপ্ত নয়নে সেই অস্তগামী সূর্যের দিকে এক-ধ্যানে চেয়ে আছে এলিনা। দূর থেকে মানুষ কিংবা মূর্তি বোঝা দুষ্কর!
শুকনো ক্লিষ্ট দেহ –মাথার চুলে পাঁক ধরেছে কয়েক গোছায়। ও চুলে বহুদিন তেল শ্যাম্পু মাখে না কিংবা আঁটসাঁট করে পনিটেল বেঁধে বাহারি ব্যান্ড পরে না। ফ্যাকাসে নীলচে চোখ আর মুখাবয়বের খাঁজে খাঁজে বলি রেখার স্পষ্ট আভাস! বয়সের থেকে বুড়ো হয়ে গেছে সে বেশ খানিকটা। সঠিক পুষ্টির অভাবে শরীর প্রায় রক্ত শূন্য! মা মরে গেছে বহুদিন আগে। প্রিয় একমাত্র বোনটা স্বামী নিয়ে জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছে কয়েক বছর হোল। আর হয়তো ফিরে আসবে না কখনো।

~এই ধরা-ভূমে আপনজন বলতে তার আর কেউ নেই। হৃৎস্পন্দন কমতে কমতে পঞ্চাশ এর ঘরে এসে ঠেকেছে। ডাক্তার বলেছে এভাবে চললে তাকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
এলিনা ভাবছে; কেন সে এতদিন বেঁচে ছিল? কিসের আশায়- কার প্রতীক্ষায়? সপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচবে কি নিয়ে? তারও একটা স্বপ্ন ছিল- অতি ক্ষীণ একটা আশা ছিল। কোন একদিন মা মেয়ের কথা হবে। সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সব মুখোশ খুলে ফেলে সে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসবে। মেয়েকে বলবে, তার ভয়ঙ্কর একাকীত্বের নিঃসঙ্গের একেকটা বিনিদ্র রজনীর কথা!
নিজের পেটের মেয়ে বলে কথা। মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য সে দিন রাত এক করে ইংরেজি শিখেছে।
~শুধু এই দিনটার অপেক্ষায় ছিল সে। আঃ ষোলটি বছর- দীর্ঘ, সুদীর্ঘ ষোলটি বছর!! নিজের মনে নিজে কত গল্প করেছে, কতই স্বপ্ন না এঁকেছে। কল্পনায় মেয়েকে ছুঁয়েছে বহু শতবার। পেটের উপর হাত রেখে তার উষ্ণতা উপভোগ করেছে।
কেমন দেখতে হয়েছে সে- কতটুকু লম্বা হয়েছে? মায়ের আদল কি পেয়েছে সে/ কিভাবে সে তাকায়, কেমন করে হাটে কেমনে কথা বলে? শত সহস্র প্রশ্ন এসে ভিড় করেছে সারাক্ষণ!
সম্ভব নয় জেনেও তাকে জড়িয়ে ধরে, কোলের মধ্যে গুটিসুটি মেরে মেয়ে তার ঘুমাচ্ছে এই কল্পনায় কত রাত ভোর হয়ে গেছে! ঘুম আঃ ঘুম কতদিন সে মন ভরে ঘুমায় না।
~আজ এক নিমিষেই সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল! এখন আর সে কি নিয়ে বাঁচবে- কাকে নিয়ে ভাববে? কার উষ্ণতার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করবে?
কি দোষ ছিল তার? সময়ের থেকে সে হয়তো পিছিয়ে ছিল খানিকটা। অন্য সবাই যখন শরীরের খেলায় মেতেছে তখন সে বিপরীত স্রোতে ভালবাসার আবেগে মথিত হয়েছে। সে সবার মত গড্ডালিকায় গা ভাসায়-নি এটাই কি তার অপরাধ?
~সে চেয়েছিল মাত্র একজন প্রেমিক পুরুষ। নির্ভেজাল টক ঝাল মিষ্টি একটা ছোট্ট সংসার। অর্থ অলঙ্কার বিলাস ব্যসন সে কিছুই চায়নি। শুধু চেয়েছিল ভালবাসা। বিনিময়ে নিজের আত্মাকেও উৎসর্গ করতে রাজী ছিল যে।
যেন সে অপার নিয়ে বসে ছিল সর্বনাশের আশায়!
কেন সে এমন নির্মম প্রতারক প্রবঞ্চক কিছু মানুষের সংস্পর্শে এল? একজন দুজন নয় বহুজনের প্রতারণার শিকার সে। ঈশ্বর কেন তাকে এত বোকা নির্বোধ করে পাঠিয়েছেন- একের পর এক সেই মানুষগুলোর ভালোমানুষির অভিনয়ের ফাঁদে ধরা দিয়েছে। তারা কি অভিশপ্ত নয়? তবে যে পৃথিবীর সব সুখ শান্তি ওদের পদতলে আছড়ে পড়ে! কেন তাকে নিয়েই নিয়তি এমন নিষ্ঠুর লীলাখেলায় মেতে উঠেছে?
প্রকৃতি অভিশপ্ত,প্রতারক, প্রবঞ্চক, মিথ্যেবাদী মানুষকে কোন শাস্তি দেয়না। কেউ শাস্তি পেলে আমরা তার অতীত খুঁড়তে বসি। তার খারাপ কোন কর্মের ফল হিসেবে সে শাস্তি পেয়েছে সেই ভেবে আমরা সান্ত্বনা পাই। এলিনার মত স্বাভাবিক স্রোতের বিপরীতে সাতরে যাবার চেষ্টা-রত কিছু মানুষকে এভাবে ভয়ঙ্কর জীবন-যুদ্ধে লড়তে হয়! নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করতে করতে সে আজ ক্লান্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে।
বহু বছর বাদে ধীরে ধীরে দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এল তার। বুকের মধ্যে সেই কষ্টের যায়গা থেকে জমিয়ে রাখা নীল কষ্টগুলো ভীষণ দমকে বের হয়ে আসতে চাইছে। একসময় পৃথিবীর প্রতি ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃতির প্রতি আক্রোশে- ঘৃণায় সে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল। অস্তাচল সূর্যটাও যেন কেঁপে উঠল তার চিৎকারে। তার আত্মা যেন উড়ে গেল দূর অসীম-পানে... সে আলতো করে লুটিয়ে পড়ল সেখানটায়।
সূর্য ডুবে গেছে বেশ খানিক্ষন আগে। কৃষ্ণ সাগরের কালচে বালুতে অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি ঠিকরে যাচ্ছে। জোয়ারের সময় হয়ে এসেছে। এলিনার চোখের কোনে তখনো নোনা জলধারা বইছে ধীরালয়ে। কৃষ্ণ সাগরের নোনা জল- ঢেউ এর ছন্দে এসে বার বার সেই অশ্রু যেন মুছে দিতে চাইছে।

~লাশ কাটা ঘরে যদি চেরা হয় তার বুক সংগোপনে
দেখবে সেখানে রাখা বিবর্ণ একমুঠো স্বপ্ন যতনে
যে স্বপ্ন কোন কিশোরের দেয়া উপহার গানের ভাষায়
যে স্বপ্ন প্রথাগত মিথ্যে কপট সংসারের আশায়.... নচিকেতা

~সমাপ্ত

~সৌম্য'র ডায়েরির পাতার ভাঁজে অযত্নে পড়েছিল তার একখানা মাত্র ছবি! বহু পুরনো এই ছবিতে 'এলিনা'কে চিনতে কষ্ট হয় বৈকি!

প্রথম খন্ড প্রথম পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৪:২০
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×