বহু ছোটাছুটি করে আগাম টিকিট কেটেও রাজধানী থেকে কমপক্ষে দেড় লাখ বাসযাত্রীর আজ নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত হয়ে গেছে বিএনপির ডাকা হরতালের কারণে। এ নিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। গতকাল অনেক বাস কাউন্টারেই টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে হরতালের মধ্যেও আজ সদরঘাট থেকে বিভিন্ন রুটে লঞ্চ ছেড়ে যাবে। ট্রেনগুলোও যথারীতি চলবে। এদিকে এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএ হরতাল প্রত্যাহারের জন্য খালেদার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সড়ক পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির কর্মকর্তারা জানান, প্রধান তিনটি টার্মিনাল ও বিভিন্ন কাউন্টার থেকে আজ রবিবারের টিকিট বিক্রি হয়েছে দেড় লাখেরও বেশি। হঠাৎ করে এ হরতালের ডাক দেওয়ায় যাত্রীদের রবিবারের এই ঈদযাত্রায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী খান কালের কণ্ঠকে জানান, হরতালের কারণে রাজধানীর প্রধান তিনটি বাস টার্মিনাল থেকে কমপক্ষে আড়াই হাজার গাড়ি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে না। এসব পরিবহনের বেশির ভাগই উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের যাত্রী।
হরতালের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি ও ঢাকা
জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি. নম্বর ১৭৭৬)। ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে গতকাল এক সভা করে হরতালকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করে আজ গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এনায়েত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঈদের আগ মুহূর্তে এ ধরনের হরতাল করা উচিত হয়নি। তবে যাত্রীদের স্বার্থরক্ষার জন্য আমরা চালকদের যানবাহন চালানোর কথা বলেছি।'
বিভিন্ন পরিবহন সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে কমপক্ষে ১৪০টি কম্পানির যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের একটি অংশ কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রাজধানীতে সচল রাখার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা বাধা পেলে সড়কে গাড়ি চালাবেন না। তবে ঢাকা মহানগরী ও আশপাশে সিটিং সার্ভিসের গাড়ি চলাচল করতে পারে।
আকস্মিক হরতালের কারণে পরিবহন মালিকরাও হতভম্ব। ঈগল পরিবহনের বাসগুলো চলে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। এ পরিবহনের মালিক অশোক রঞ্জন কাপুড়িয়া বলেন, 'রবিবার ঈগল পরিবহনের ৫০টি ট্রিপ খুলনা এবং ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রিপ বরিশালে যাবে। এসব ট্রিপে কমপক্ষে ৪০ যাত্রী টিকিট কিনেছে। এখন হরতালের কারণে যাত্রা নিয়ে উদ্বেগে আছি।'
হানিফ পরিবহনের হাজারের বেশি বাসের যাত্রা আজ বাতিল হয়ে যাবে সড়কে বাস চালাতে না পারলে। এ ব্যাপারে এ পরিবহনের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামে এ কম্পানির ১৫০টি, সিলেটে ১০০টি, খুলনায় ১০০টির বেশি এবং উত্তরের বিভিন্ন জেলার অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়েছে বহু আগেই।
গতকাল রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালের আলিফ পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কিনতে গিয়েছিল অনেক যাত্রী। হরতালের খবর মুখে মুখে রটে যাওয়ায় বিকেল ৩টার দিকে কাউন্টার থেকে যাত্রীদের চলে যেতে দেখা গেছে। সায়েদাবাদ টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, যানজটে সময় নষ্ট করে অনেক যাত্রী বিভিন্ন কাউন্টারে টিকিট কিনতে হাজির হয়েছে। কিন্তু হরতালের সংবাদ শুনেই তারা জ্বলে ওঠে ক্ষোভে। পর পর পাঁচ দিন চেষ্টার পরও টিকিট না পেয়ে টিকিট পাওয়ার আশায় এসআর পরিবহনের কাউন্টারে আসা শফিক আহমেদ বলেন, এ হরতালের কারণে অনেকেই বাড়ি যেতে পারবে না। নিজের চট্টগ্রামের বাড়িতে যাওয়াও অনিশ্চিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সদরঘাটে নেই 'হরতাল আতঙ্ক' : সদরঘাটে ভিন্নচিত্র। লঞ্চ মালিক সমিতির অফিসে গেলে তানজিল-৩ লঞ্চের মালিক মো. সালাম বলেন, ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের সময় মাত্র দুই দিন নদীতে নৌপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর চৌধুরী বলেন, হরতালের মধ্যেও লঞ্চ চলাচল করবে।
গতকাল দুপুর থেকে সদরঘাটে যাত্রীদের ভিড় লক্ষ করা গেছে। অন্যান্য দিনে ৪০টি লঞ্চ ছেড়ে গেলেও গতকাল বিকেল পর্যন্ত ছেড়েছে ৫৭টি।
হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান এফবিসিসিআই, বিজিএমইএর
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ হরতাল প্রত্যাহারে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ঈদে ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনা কমাতে এবং দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখতে উভয় সংগঠনের পক্ষ থেকে গতকাল আলাদা জরুরি সংবাদ সম্মেলন থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।
মতিঝিলে এফবিসিসিআই ভবনে গতকাল বিকেলে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, 'দেশপ্রেমিক নেত্রী হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতাকে হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানাই। হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধে রাজনীতিবিদদের প্রতি অনুরোধ জানাই। এ জন্য প্রয়োজনে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে বসতেও রাজি আছি আমরা।'
অন্যদিকে গতকাল সন্ধ্যায় আলাদা এক সংবাদ সম্মেলনে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী হরতাল আহ্বানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ ও তাদের ঘরে ফেরা নির্বিঘ্ন করতে বিরোধী দলের প্রতি হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, 'গত তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি এসেছে ৩০ শতাংশ। সরকারের রাজস্ব আদায়ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ জোরদার করতে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন। অন্যদিকে ঈদের আগে মাত্র দুটি কার্যদিবস রয়েছে। এ সময়ে বিরোধী দলের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকায় আমরা দুঃখ পেয়েছি।'
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, ঈদুল আজহার আগে আজ রবি ও আগামীকাল সোমবার_মাত্র দুই দিন কার্যদিবস রয়েছে। দেশের বন্দরগুলোতে প্রচুর মাল খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। আবার প্রচুর রপ্তানি পণ্য বন্দরে পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য ব্যাংক খোলা রাখা প্রয়োজন। আর সাম্প্রতিক সময়ে অ্যানথ্রাঙ্রে কারণে চামড়া ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় চামড়া সংগ্রহ করতে পারেননি। আসন্ন ঈদুল আজহায় সেই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। হরতালে ব্যাংক বন্ধ থাকলে চামড়া শিল্পের মালিকরা চামড়া কেনার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থ পাঠাতে পারবেন না।
বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বর্তমান সময়টি এ শিল্পের মালিক-শ্রমিক উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদের আগে দুই কর্মদিবসে শ্রমিকদের বেতন, ওভারটাইম ও অন্যান্য ভাতা পরিশোধ করতে হবে। যেসব শ্রমিক ইতিমধ্যে পাওনাদি পেয়েছে ও আগামীকাল (আজ রবিবার) পাচ্ছে, তাদের বড় অংশই বাড়ি ফেরার জন্য রবিবারের টিকিট কেটেছে। এ অবস্থায় হরতালের কারণে তাদের পক্ষে আর বাড়ি ফেরা সম্ভব হবে না। শ্রমিকরা যাতে পাওনাদি নিয়ে ভালোভাবে বাড়ি ফিরতে পারে, সে জন্য হরতাল প্রত্যাহারের জন্য বিরোধীদলীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিকেএমইএও হরতাল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। গতকাল সংগঠনের সচিব সুলভ চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, পবিত্র ঈদুল আজহার মাত্র দুদিন আগে ডাকা এই সিদ্ধান্ত দেশের নিট শিল্পখাত এবং এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিপাকে ফেলবে। হরতালের কারণে নিট খাতের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ঈদের আগে পরিশোধের প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হবে। সংগঠনটি হরতাল প্রত্যাহারের জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



