somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

''আদ্রিয়ানাঃ দ্যা পিয়ানো'' (গল্প)

২৯ শে মে, ২০১২ রাত ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কান্ট্রি সাইডের একটা ছোট মফঃস্বল গ্রাম, নাম নিবোন্স। নিবোন্সের জনসংখ্যা শহর থেকে অনেকটাই কম। শহরের মত এখনো গুমোট হয়ে যায়নি. আশাপাশের গ্রাম গুলো যখন ধীরে ধীরে নগরায়নের ফলে ঘিঞ্চি হয়ে যাচ্ছে তখন নিবোন্সের অবস্থা এখনো অনেকটাই তরুন যুবকের মত। তরুন নিবোন্সের এমনি এক তরুন, নাম দ্রোমিও। সল্প জনবহুল নিবোন্সবাসীদের মাঝে দ্রোমিও বেশ সুপরিচিত। সবাই এক নামে চেনে। নিজ গুনের কারনে দ্রোমিও তার পরিচিতি ভালোভাবেই ধরে রেখেছে। নিজ অবস্থানে দ্রোমিও খুবই অন্তর্মুখী একজন তরুণ।

দ্রোমিও তার যেই কারনে সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে তা হল তার হারমনিকা বাদন। ছোট থেকেই নানা ধরনের সঙ্গীতএর প্রতি দ্রোমিওর ছিলো ভীষন আকর্ষণ। বড় হওয়ার পথে একটা বিশাল সময় কাটিয়েছে নানা ধরনের সঙ্গীত শুনে। দ্রোমিওর মামা ছিলেন একজন সঙ্গীতপ্রেমী, মামার কাছ থেকেই সঙ্গীতের প্রতি টান জন্মেছে তার। সঙ্গীতের প্রতি টান বা আকর্ষণ দেখেই মামাই কিনে দিয়েছিলেন হারমোনিকা। তারপর থেকে এই হারমনিকাই ছিলো দ্রোমিওর সঙ্গী। অন্তর্মুখিতার কারনে বন্ধু খুব কম ছিলো তার কিন্তু হারমনিকাটা সব সময় বন্ধুর মত পকেটেই থাকতো। অনেক শখ করে হারমনিকার নাম দিয়েছিল লিলিয়ানা।

দ্রোমিওর একটা বাঁশিও ছিলো, বাঁশিটির নাম ছিলো এমিলিয়া। কোন এক অটামের মেঘময় দিনে বাঁশিটি হারিয়ে ফেলেছে সে। তাতে অনেক কষ্ট হয়েছিলো তার। বাঁশিটি হারানো মানে একটা বন্ধু হারানো।

দ্রোমিওর মামা যখন হারমনিকাটা উপহার দিয়েছিল তখন বলেছিলো, ''জীবনে যদি কোনোদিন বন্ধুর অভাব মনে হয় তবে এই হারমনিকাকে বাজাস, বন্ধুর অভাব সহজেই দূর হয়ে যাবে।" আসলেই তাই, মানুষের একাকিত্বে একটা মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট একটা ভালো বন্ধু হতে পারে।

পড়ালেখা যতটা দরকার ততটা করে এখন নিজেই কিছু করার চেষ্টা করছে। নিবোন্স ছেড়ে বাইরে যেতে ইচ্ছে করেনা তাই বাইরে একটা ভালো চাকুরীর প্রস্তাব ছেড়ে দিয়েছে। কান্ট্রি সাইডের এই উচ্ছল বাতাস, সবুজ গম ক্ষেত, দিগন্তজোড়া নীল আকাশ মনেহয় আর কোথাও নাই। দুপাশে গমের ক্ষেত তার মাঝ দিতে চলে গেছে সরু রাস্তা। এই রাস্তা যেন স্বর্গের পানে চলেছে নিবোন্সবাসীকে নিয়ে।

গ্রামের এক কোনে একটা ছোট মোটেল কাম বার এর মত খুলেছে দ্রোমিও। এটা দেখাশোনা করা আর পরিচালনাই এখন তার একমাত্র কাজ। সাথে অবশ্য একটা সহযোগী রেখেছে। দুজনে মিলে ভালই গুছিয়ে নিয়েছে।

দুপুরে বাইরের গ্রাম থেকে আসা ব্যাবসায়ীরা দুপুরের খাবার সারার জন্য এই বারকেই বেছে নেয়, আর সন্ধ্যায় বিয়ার খায়, গল্পকরে অনেকেই। কখনো নিজেই হারমোনিকা বাজিয়ে শোনায় দ্রোমিও।

এবার খুব শীত পড়েছে। মোটেল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সবজি, মাংস আর বিয়ার গাড়িতে করেই আসে শহর থেকে, কিন্তু শীতে গাড়ি আসতে না পারায় এসবের অভাব পড়ে যায়। কিন্তু বার তো আর বন্ধ করা যায়না। তাই নিজেই ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে শহরে যাওয়ার সিধান্ত নিয়ে ফেলে সে। এখান থেকে ইনোসেস শহরের দূরত্ব নেহায়েত কম নয়। গোটা দিনের অর্ধেক চলে যাবে।

খুব ভোরেই ওভারকোট গায়ে জড়িয়ে, হাতে পশমি গ্লাভস আর হ্যাটটা পড়েই ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তুষারপাতে বরফের আবরন পড়ে গিয়েছে রাস্তায়, রাস্তার দুধারে ম্যাপেল ট্রি গুলোর পাতা ঝরে গেছে। ডালে ডালে তুলার মত থোকা থোকা বরফ জুড়ে আছে। মনেহচ্ছে যেন বরফের জন্যই গাছগুলোর জন্ম। বরফের উপরে ঘোড়ার খুরের শব্দ তেমন প্রকট নয়, সহজেই শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। জনমানবের দেখাও খুব একটা পাওয়া যাচ্ছেনা শীতের জন্য এই সময়ে।

অনেকটা পথ পেরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় দ্রোমিও, পকেটে থাকা স্যান্ড ওয়াচ টা পরখ করে দেখে। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেছে। শহর আর খুব একটা দূরে নয় তবে একটানা ঘোড়ার পিঠে বসে এতটা পথ এসে হাপিয়ে উঠেছে সে। পানির ব্যাগটা খালি হয়ে গেছে পথের মাঝেই। তাই পানির খোঁজ করতে ঘোড়া থেকে নামে দ্রোমিও। কিছুটা পথ থেটেই একটা ছোট কাঠের বাড়ি দেখতে পায় সে। পানির জন্য বাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়। ঘোড়ার লাগামটা হাতে ধরেই ঘোড়াকে সাথে নিয়েই যাচ্ছে সেদিকে।

দোতলা বাড়ির সামনে এসে একটু খটকা লাগে তার। কোন শাড়াশব্দ পাওয়া জাচ্ছেনা। লোহার তৈরি প্রধান ফটকটা খোলা থাকলেও বাড়ির অন্দরমহলের কাঠের গেটটা বন্ধ। আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছেনা। বাড়ির ভেতরেও কোন আলো বা শব্দ নেই। গেইটের কাছে গিয়ে তাই নিজেই নক করে সে। বেশ কয়েকবার নক করার পরও কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলেনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দ্রোমিও ফিরে যাওয়ার জন্য বাড়িটাকে পেছনে ফেলে পা চালাতেই দরজা খোলার শব্দ আসে। থমকে দাঁড়ায় সে। পেছনে ফিরতেই এক মধ্যবয়স্ক লোক কে দেখতে পায়। লোকটি চোখের ইশারায় দ্রোমিওকে ভেতরে যেতে বলে।


ভেতরে ঢুকেই অবাক হয় দ্রোমিও, সে ভাবতেই পারেনি এই পুরোনো বাড়ির ভেতরটা এতোটা সুন্দর হতে পারে। একদিকে ফায়ারপ্লেসে আগুন জলছে। তার ঠিক পাশেই সেলফে সাজানো আছে বাহারি রকমের পানীয়। ডুপ্লেক্স বাড়ির মত সিঁড়িটা ভেতরেই। তবে সিঁড়ির কারুকাজ চোখ ধাঁধানো। লোহার উপরে নক্সা আঁকা সর্পিলাকার সিঁড়ি। ফায়ার প্লেসের ঠিক উল্টো দিকে বসার জন্য সোফা। হরিণের চামড়া ঝুলানো আছে একটি দেয়ালে, আরেক দেয়ালে পেইন্টিংস। একটা মোহনীয় পরিবেশ। সোনালী আলোতে ঘর ভরে আছে।

খুটিয়ে খুঁটিয়ে এসব দেখতে দেখতে দ্রোমিও অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলো পানি নিয়ে আবার শহরের দিকে রওনা করতে হবে। হঠাৎ করেই বাড়ির লোকটি একটা কাচের গ্লাসে পানীয় ঢেলে দ্রোমিওর সামনে ধরে এবং বলে, “নিন অনেক দূর থেকে এসেছেন নিশ্চই, গলাটা ভিজিয়ে শরীরটা গরম করে নিন”

দ্রোমিও চমকে ওঠে, সম্বিৎ ফিরে পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁচের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলে, “ধন্যবাদ অনেক আপনাকে, আমি আসলে শহরের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথে পানির প্রয়োজনে আপনার বাড়িটা দেখে পানির জন্য এসেছিলাম”

লোকটি গ্লাসে নিজের জন্যও এক গ্লাস পানীয় ঢেলছিল, নিজের গ্লাসে চুমুক দিতেই জিজ্ঞাসা করে, “এই শীতে শহরে কেন? আর আপনি থাকেন কোথায়?”

“জি আমি থাকি নিবোন্সে, কিছু বাজার আর বিয়ার কেনার জন্য যাচ্ছি, আমার একটা মোটেল আছে, বাজারের অভাবে বন্ধ হবার জোগাড়” দ্রোমিও কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে উত্তর দিলো।

দ্রোমিওকে চিন্তিত দেখে লোকটির মাঝেও চিন্তার ভাব দেখা গেলো। তিনি বললেন, “নিবোন্স তো অনেক দুরের গ্রাম, আজ তো শহর থেকে বাজার করে ফিরে যেতে পারবেন না। এই কনকনে শীতে রাতের বেলা ফিরতে গেলে বিপদ হতে পারে, আপনি বরং আজ রাতটা আমার এখানেই থাকুন”

“নাহ, আমাকে আজই ফিরতে হবে”, চিন্তার ছাপ আরো গভীর হয় দ্রমিওর।

“আচ্ছা আপনার নামটা জানা হলনা এখনো, আপনার নাম কি? আমার নাম জোহান'' পরিচয় জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে লোকটি।

“আমার নাম দ্রোমিও, আসলে আপানার বাড়িটা অনেক সুন্দর, দেখতে দেখতে কুশল জানাতেই ভুলে গিয়েছিলাম” হাতের গ্লাস টেবিলে রাখতে রাখতে উত্তর দেয় দ্রোমিও।


“শুনুন দ্রোমিও, আজ শহরের দোকানগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ, আপনি আজ আমার এখানেই থাকুন” আবারো জোহান দ্রোমিওকে থাকার অনুরোধ করে।

২য় বার অনুরোধ করার পর দ্রোমিও কিছুক্ষণ ভেবে থাকার জন্য সম্মতি জানায়। তারপর জোহান তার নিজের কথা বলতে থাকে দ্রোমিওকে।

জোহান এই বাড়িতে একাই থাকেন। বহু বছর আগে এক গ্রীষ্মের দাবানলে এখানের জনবসতি লোপ পায়। দাবানলের পরে কিছু পরিবার এখানে নতুন করে বসতি করেছে তবে আগের মত বসতি গড়ে ওঠেনি। জোহানকে তার পরিবারের অন্যান্যদের কথা জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, বছর পাঁচেক আগে দাবানলের আগুনে পুড়ে তার একমাত্র কন্যা ও স্ত্রী পুড়ে মারা যায়। জোহান কাজ করতেন তখনকার রাশিয়ান নৌ বন্দরে। কাজের জন্য তাকে দাবানলের সময় থাকতে হয়েছিলো ঘর পরিবার ছেড়ে অনেক দূরে। খবর পাওয়া মাত্রই সে ফিরে আসে, এসে আর তার পরিবারের কাউকে জীবিত পায়নি।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। রাতের খাবারের জোগাড় করার জন্য জোহান উঠে দাঁড়ায়। দ্রোমিওকে নিজে নিজে ঘুরে দেখতে বলে সে সরাইখানার দিকে পা চালায়। দ্রোমিও অনুমতি পেয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। বাড়ির বাহিরের দিকটা দেখতে পুরোনো মনে হলেও ভেতরটা একদম ঝকঝকে, দেখতে দেখতে সিঁড়িটার কাছে এসে দাঁড়ায়। জোহান যে দিকে চলে গেলো সেদিকে তাকিয়ে জোহানের কোন সাড়া না পেয়ে উপরে ওঠার অনুমতি ছাড়াই শিড়ি বেয়ে উঠে যেতে থাকে।

উপরের দিকে দুটো ঘর। দুটো ঘরই গুছানো তবে হালকা ধুলো পড়ে আছে, দেখেই বোঝা যায় এই দিকে কেউ খুব একটা আসেনা। ডানের ঘরের ওয়ালে জোহানের সাথে এক মহিলার ছবি। জোহানের স্ত্রীর ছবি এটা নিশ্চই। জানালায় সাদা পর্দা ঝুলানো, একটা টেবিলে কয়েকটা বই পত্র আর একটা হাত ঘড়ি।

বামের ঘরটা ছিমছাম। একপাশে বিশাল একটা আয়না। দেয়ালে এক সদ্য কৈশোর পার হাওয়া তরুণীর ছবি। আরেকপাশে একটা বিশাল টেবিলের মত। অবাক করা বিষয় হল টেবিলটি কালো একটা কাপড়ে ঢাকা। টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায় দ্রোমিও। কাছে যেতেই পেছন থেকে জোহান ডাক দেয়, “আসুন, খাবার তৈরি হয়ে গেছে প্রায়”

হঠাৎ জোহানের ডাকে হতচকিত হয়ে যায় দ্রোমিও, অগত্যা হাত গিয়ে পড়ে সেই টেবিলের এক কোনে। আর সাথে সাথে এক ঝংকারের সৃষ্টি হয়। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে দাড়িয়ে থাকে দ্রোমিও। দ্রোমিওর এই অবস্থা দেখে জোহান শান্ত গলায় বলে “ ওটা একটা পুরোনো পিয়ানো। নিচে আসুন, খেতে খেতে আলাপ করা যাবে”

নিচে খাবারের টেবিলে বসে খেতে খেতে জোহান বলে পিয়ানর কথা। জোহানের মেয়ের খুব শখ ছিলো পিয়ানো বাজানো। মেয়ের নাম ছিলো আদ্রিয়ানা। আদ্রিয়ানা যখন পিয়ানো বাজাতো তখন মনে হত পিয়ানোর সুর বাড়িতে একটা নৈসর্গিক আবহ তৈরি করতো। পাখিরা কলতান থামিয়ে দিতো, শুভ্র একটা ভাব চলে আসতো। আদ্রিয়ানার মৃত্যুর পর পিয়ানোটি আর কেউ কখনো বাজায়নি, এবং সেই সময়ের দাবানলে ঘরবাড়ির উপর দিয়ে যে ভয়াবহতা বয়ে যায় তাতে পিয়ানোটি কিছুটা খতিগ্রস্ত হয়। তার পর থেকে পিয়ানোটির অবস্থান সেই কালো কাপড়ের নিচে।

পিয়ানোটির প্রতি আগ্রহ হয় দ্রোমিওর, খাবার শেষ করে দুজনে মিলে পিয়ানোটির উপর থেকে কালো কাপড়টি সরিয়ে দেখে। অদ্ভুত সুন্দর একটা পিয়ানো। মিশমিশে কালো রঙের ফ্রেমের পিয়ানো। পিয়ানোর কীবোর্ড সাদা কালো ঠিকি তবে স্ট্রিংস গুলো খুব চকচকে এখনো। প্যাডেলের একটা অংশ ভেঙ্গেছে, উপরের কাভারটাও ফাটল ধরা। এছাড়া বাকি সব ঠিক আছে দেখলো।

দ্রোমিও জোহানকে বলল, “যদি কিছু মনে না করে তবে আমি এটি নিয়ে ঠিক করে এতে আবার সুর তুলতে চাই”
তবে সমস্যা হল, জোহান তার মেয়ের এই প্রিয় জিনিসটি ছাড়তে নারাজ। মেয়েকে তিনি এই পিয়ানোতে খুঁজে পান। পিয়ানোকে ছেড়ে দেয়া মানে অনেকটা মেয়েকে দিয়ে দেয়া। তবে দ্রোমিও অনেক বুঝিয়ে জোহানকে আশ্বস্ত করল যে, পিয়ানোটি তার কাছে ভালই থাকবে। জোহান কিছুক্ষণ ভাবলেন। তার কাছে মনে হল এভাবে পড়ে থাকার চাইতে যদি এটি ঠিক করে আবার সুর তৈরি হয় তবে হয়ত তার মেয়েকে আরো ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। অবশেষে অনুমতি দিলেন এটি নিয়ে ঠিক করে আবার যেন সুর তুলতে পারে। তবে শর্ত দিলেন যে, যে কোন সময়ে জোহান দ্রোমিওর মোটেলে গিয়ে পিয়ানো শুনতে চাইবেন এবং তাতে না করা যাবেনা। এই সহজ শর্তে রাজি হয় দ্রোমিও।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই পকেটের হারমনিকাটা বাজাচ্ছিলো দ্রোমিও, হারমোনিকার শব্দে জোহানের ঘুম ভাঙ্গে। একসাথে নাস্তা করে, তারপর দ্রোমিও শহরের দিকে যে কাজে এসেছিলো সেই কাজে যায়, জোহান তাকে আশ্বস্ত করে তুষারপাত একটু কমে গেলেই পিয়ানো পাঠিয়ে দেয়া হবে। জোহানের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে জোহানকে ধন্যবাদ দেয় দ্রোমিও কথা দেয় যে, যে করেই হোক আদ্রিয়ানার পিয়ানোতে আবার সুর তুলবে সে।

ফিরে আসে দ্রোমিও নিজ গ্রামে, শীতের প্রকোপ অনেক খানি কমে গেছে। তুষারপাত বন্ধ হয়েছে আরো দুদিন আগে। সকালে মোটেলের ডাইনিং নাস্তা সরবরাহ করে বার সাইডের ব্যালকুনিতে এক গ্লাস এপেল জুস হাতে নিয়ে পথের দিকে তাকাতেই দেখে মিষ্টি রোদের মাঝে চারপাশটা অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে। বার্লির ক্ষেতে মৃদু হাওয়া বইছে। হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ যেতেই সে দেখে একটা মালবাহী ঘোড়ার গাড়ী তার মোটেলের দিকে আসছে। গাড়িটি মোটেলের সামনে এসে দাড়াতেই নিচে নেমে যায় সে। নিচে নেমেই পরিচিত জোহান কে দেখে আনন্দ হয় খুব দ্রোমিওর। এতক্ষণে তার বুঝতে বাকি নেই যে সেই কাঙ্ক্ষিত পিয়ানোটি চলে এসেছে। জোহান কে মোটেলের নিচ তলায় নিজের ঘরে নিয়ে যায় সে। আর পিয়ানোটি একটা বারান্দায় রাখে।


জোহান দ্রোমিওর মোটেলটা ঘুরে ফিরে দেখে, দুপুরের খাবার খেয়ে বিদায় নেয় । পিয়ানোটি দ্রোমিওর কাছে দিতে পেরে স্বস্তি পায় জোহান। তার বিশ্বাস পিয়ানোর কোন ক্ষতি হবেনা।

দীর্ঘ দেড় মাস ধরে পিয়ানোটিকে নিজ হাতেই ঠিক করে দ্রোমিও, তবে এই কাজের জন্য একজন পিয়ানো বাদকের সাহায্য নিয়েছে সে। কর্ড হোলাডার টা ঠিক করার সময়ে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করে দ্রোমিও। ওটার মাঝে কিছু কর্ড নোট টনানো। সেগুলো অক্ষত আছে। একটা কর্ড নোটের উপরে লেখা “জার্নি টু হ্যাভেন” (Journey to heaven). ছাপানো কোন লেখা নয় , হাতে লেখা কর্ড গুলো। হয়ত আদ্রিয়ানো নিজ হাতেই লিখেছিলো টোন গুলো। হয়তবা আদ্রিয়ানার নিজের সৃষ্ট কোন সুরের কর্ড হবে।

এর মাঝেই ক্রিসমাস চলে আসে, নিবোন্স সাঁজতে থাকে নতুন রূপে। দ্রোমিওর মোটেল কাম বারও নতুন করে সাঁজে। সব কিছু গোছগাছ হয়। বারের একটা কর্নারে মিউজিক কর্নার তৈরি হয়, সেখানে সন্ধ্যায় চলে সুর মূর্ছনা। সেখানেই পিয়ানোর অবস্থান হয়। খুব অল্প সময়ের মাঝেই পিয়ানোটির প্রতি মায়া জন্মে যায় দ্রোমিওর। সে জোহানের মেয়ের নামে পিয়ানোটির নাম রাখে আদ্রিয়ানা। পিয়ানোটি বাজানোর সময় অদ্ভুদ এক ধরনের অনুভব হয়। ঠিক যেন এই পৃথিবী থেকে বাইরের অন্য কোন জগতে সে চলে যায়। একটা জাদুকরী শক্তি আছে যেন পিয়ানোটির। জোহানের বাসার দ্বিতীয় তলায় আদ্রিয়ানার ছবি দেখে যেমনটা হারিয়ে গিয়েছিলো সে ঠিক তেমন একটা অনুভূতি। মোহনীয় সেই অনুভুতির কথা বর্ণনাতীত।

নিবোন্সের অধিবাসীদের একটা মিলনস্থলে পরিনত হয়েছে দ্রোমিওর বারটি। তাই ক্রিসমাসের সারাটা দিন বার ছিল আনন্দে মুখোর। সন্ধ্যায় নিজেই সঙ্গীত পরিবেশন করে দ্রোমিও। সেই লিলিয়ানা নামের হারমনিকা আর আদ্রিয়ানার পিয়ানোতে সুর তুলে পুরো গ্রামকে মাতিয়েছিল আনন্দে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়তে থাকে , সবাই যার যার বাসায় ফিরে যায়। দ্রোমিও বসে থাকে পিয়ানোর সামনে। হঠাৎ করেই দ্রোমিওর চোখ যায় কর্ড হোল্ডারে আদ্রিয়ানার লেখা সেই কর্ড নোট “জার্নি টু হ্যাভেন” এর দিকে।

কর্ড দেখে দেখে বাজাতে শুরু করে জার্নি টু হ্যাভেনের সুর। সেই সুর বাজাতেই দ্রোমিও হারিয়ে যায় এক অন্য জগতে। সেখানে যেন এক শীতল শুভ্রতা। সাদা আলোর এক ভুবনে হারিয়ে যায় সে। দ্রোমিও একাই ছিলো মিউজিক কর্নারে, আর বাজিয়ে জাচ্ছে সেই মায়াবী সুর। মনের সকল সংকীর্ণতা যেন এক নিমিষেই দূর করে দিচ্ছিলো সেই সুর। বাজাতে বাজাতে কখন যে চোখ বুজে ফেলেছে দ্রোমিও সেটা সে নিজেও জানেনা। হঠাৎ করে চোখ খুলে সে দেখতে পায় সারা ঘর আলোকিত। পেছনের দরজাটি ধীরে ফাক হতে থাকে, তখনো বাজিয়ে জাচ্ছে সে। দরজার ওপাশ থেকেও যেন আলো আসছে। দ্রোমিও তার পাশে দেখতে পায় এক প্রলম্বিত ছায়া।

ছায়াটি ধীরে ধীরে পেছন থেকে তার দিকে আসতে থাকে। সাদা চাপা কোমরের গাউন পরা এক ছায়ামূর্তি দেখতে পায় সে। খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ছায়ামূর্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। ঠিক আদ্রিয়ানার মত দেখতে। চেহারায় সেই কমনীয়তা। শরীরে মায়াময় মোহনীয়তা। পৃথিবী থেকে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় দ্রোমিও। সে শুনতে পায় অদূরে কোন তরুণী তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। চোখ ফেরাতে পারেনা দ্রোমিও। অজানা এক আকর্ষণে সে ছুটে চলে সেই তরুণীর দিকে।


(সমাপ্ত)
১৩টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×