somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হেলাল ভাই এর গল্প

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার ছোটবেলাটা কেটেছিল উত্তর বঙ্গএর হিমশীতল ছোট্ট একটা জেলা শহরে। শহর বললে ভুল হবে, বলতে হবে গ্রাম্য শহর। একই সাথে শহর আর গ্রামের অদ্ভুত মিলন। খুব সুন্দর একটা সময় ছিল। ঐসময়ের নিজেকে এখনো নিজেই হিংসা করি। বাসার সামনে বিশাল একটা মাঠ ছিল। একদম ছোটবেলায় রুপকথার বই পড়ে যেগুলো বুঝতাম না, সেগুলোকে অটো ফিল ইন দ্যা গ্যাপ করে দেবার প্রবনতা ছিল। ভাবতাম এই মাঠটাই সেই তেপান্তরের মাঠ।
বড় হয়ে ওঠার কোন বাঁধাধরা নিয়ম ছিলনা। স্কুলের ঘণ্টা বাজলেই হেলেদুলে রওনা হয়ে বাসার পাশে স্কুলে ঢুকে পড়া যেত। স্কুলে বন্ধুস্থানীয় ভীন পাড়ার সাথে কারো ধাক্কা ধাক্কি হলে লেগে যেত পাড়ায় পাড়ায় মারা-মারি। বড় ভাইদের দল মোটর সাইকেল দাপিয়ে শো-ডাউন করতো। কোন বাসায় সকালের নাস্তা খাচ্ছি, কোন বাসায় দুপুরের খাবার আর সন্ধ্যার নাস্তা কোন বাসায় কোন ঠিক ঠিকানা নেই। শফিক ভাই, পাশের বাসার সোমা আপার সাথে প্রেম করছে, চিঠি চালাচালির ডাকপিয়নের দায়িত্বটা অবধারিত।
আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক হঠাত ইলেকশানে দাঁড়িয়ে গেলেন। লাবু চাচা ইলেকশানে দাড়িয়েছেন, আমাদের মিছিল না করলে হয়? সমস্যা হলো মিছিলে গিয়ে কি বলবো? “তোমার চাচা আমার চাচা লাবু চাচা লাবু চাচা! শুনতে কেমন জানি লাগে। অপরিচিত ভোটপ্রার্থীকে ভাই বলা যায়, তাই বলে লাবু চাচার সামনে তো বলতে পারি না, তোমার ভাই আমার ভাই লাবু ভাই। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখলাম, আমাদের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন রবিন ভাইকে নিয়ে। লাবু চাচা রবিন ভাইএর বাবা। তিনি তো মিছিলে গিয়ে খামোখাই চিল্লা চিল্লি করে। আমার দেখার ইচ্ছে ছিল- তোমার আব্বা আমার আব্বা বলে স্লোগান তোলেন কি না। উনি নিরাশ করলেন। স্লোগানের কথায় একটা মজার কথা মনে পড়লো। ঘটনাটা চাপাই নবাব গঞ্জের ওদিকে। এক আত্মীয়ের বাসায় গেছি। ইলেকশান করছেন এলাকার লোক নাম সুধীর দত্ত। লোকজন মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে “তোমার ভাই আমার ভাই, সুধীর ভাই সুধীর ভাই”। সমস্যা হচ্ছে চাপাই নবাব গঞ্জের লোকেরা “স” এর উচ্চারন করে বিচিত্র ভাবে। পোংটা পোলাপান আর ইচ্ছে করে বিকৃত উচ্চারনে স্লোগান দেয়ায় সুধীর ভাই এর “স” শোনা যেত “চ” এর মত। মহা কেলেঙ্কারী অবস্থা। যাদেরকে মিছিল করার জন্যে টাকা পয়সা খরচ করে এনেছেন- শোনা যাচ্ছে তারা সবাই দল বেধে ওমুকের ভাই বলে গালি দিচ্ছে। পাড়ার মুরুব্বীরা সুধীর বাবুকে ডেকে বলে দিলেন-সবাইকে বলো সুধীর ভাই না বলে সুধীর দাদা বলে স্লোগান দেবে। বিচিত্র স্লোগান- তোমার দাদা আমার দাদা-সুধীর দাদা সুধীর দাদা।
তো যাই হোক, নিজের জায়গায় ফিরে আসি। একবার ইলেকশানে আমাদের পেছনের বাসার উকিল সাহেব দাড়ালেন। মহল্লা থেকে একটু দূরে তার একটা ইসলামী ক্যাডেট মাদ্রাসা ছিল। ক্যাডেট মাদ্রাসা’টা যে কি জিনিস সেটা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না। যাই হোক উনি নাকি ইলেকশান উপলক্ষে ঢাকা থেকে গুন্ডা ভাড়া করে এনেছেন। সেই গুন্ডারা ঐ মাদ্রাসার ঘরে থাকে, খায় দায়। এবং প্রতিদিন তার মিছিলে সামনে সামনে থাকে। বিশাল শোডাউন। আমরা ছোট বাচ্চারা একদিন দল বেধে গেলাম গুন্ডা দেখতে। ভেবেছিলাম ভিসিআরে দেখা হিন্দি সিনেমার গুন্ডাদের মতো ঝাকড়া চুল ইয়াবড় গোঁফ দাড়িওয়ালা লোক দেখবো, উঠোনো ডন বৈঠক দিচ্ছে নইলে হকিস্টিক নিয়ে মারামারির প্র্যাকটিস করছে। গিয়ে দেখি রোগা পিলপিলে চারপাচজন তরুন জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পড়ে বিড়ি ফুঁকছে। ভদ্রলোক স্থানীয় জামাতীর নেতা। কোনবারও জিততে পারেনা। সবাই আড়ালে রাজাকার বলে গালি দিত। পাড়ার সবাই সবার বাসায় অবারিত যাতায়াত থাকলেও কি কারনে জানি উনারা কারো বাসায় যেতেন না, কেউ তাদের বাসায় যেতনা। উকিল সাহেবের তিন ছেলে। প্রথম দুই ছেলেই ভয়াবহ ব্রিলিয়ান্ট। ঢাকা মেডিক্যালে নাকি বুয়েটে পড়ে। মাঝে মাঝে বাসায় আসে, আমরা চিনতামই না। একদম ছোট ছেলে হেলাল ভাই। সম্ভবত তার শারীরিক ভাবে কোন অসুখ ছিল, হরমোনের সমস্যা বা এজাতীয়। হেলাল ভাই উচ্চতা সাতফুটের বেশী। হ্যাঙ্গা পাতলা, আর এতই লম্বা যে সাধারন দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে তাকে কুঁজো হয়ে ঢুকতে হতো। হেলাল ভাই পড়াশুনায় ভালো না, প্রতিবার ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে ফেল করতেন, তাই বড় ভাইদের মতো ঢাকায় চলে যান নি। পাড়ার সবার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমরা তালগাছ বলে ডাকতাম। উকিল সাহেব এই ছেলেটাকে দুচোখেই দেখতে পারতেন না। একেতো শারীরিক ত্রুটি (যতোটা মনে পড়ে বুদ্ধির দিক দিয়েও কিছুটা ত্রুটি ছিল, ঠিক প্রতিবন্ধি না কিন্তু অদ্ভুত রকমের সরল)। উকিল সাহেব লোকজনের সামনেই এত বড় ছেলেকে লাঠিপেটা করতেন।
একসময় আমাদের পরিবারও ঢাকায় মুভ করলো। স্কুলের ছুটি ছাটায় গ্রামের বাসায় ফিরে যেন দম ফিরে পেতাম। হেলাল ভাই এর সাথেও দেখা হতো। একবার দেশের বাড়ি গিয়ে শুনলাম ভয়াবহ ঘটনাটা। আমাদের বাসাটা ছিল শহরের ঠিক মধ্যে খানে। উপজেলায় গ্রামে উকিল সাহেবদের বিস্তর জমি জিরাত আধি দেয়া ছিল। ফসল কাটার সিজনে হেলাল ভাইকে পাঠানো হতো গ্রামে গিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে আসা। একবার উনি টাকা নিয়ে ফিরছেন। এক বাসায় অনেক হৈ হল্লা শুনে গিয়ে দেখেন এক গৃহস্থের বাসায় মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিয়ের দিন যৌতুকের টাকা দেবার কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের বাবা টাকা রেডি করতে পারেনি। হেলাল ভাই ওখান থেকে মেয়ের বাবাকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, আমি ধার হিসাবে দিচ্ছি, এটা দিয়ে বিয়ে করান। আমার বাবা পলিটিশিয়ান অমুক। সবাই চেনে। আপনি কিন্তু চাচা যতো তারাতারি পারেন টাকা শোধ করে দেবেন।
বাসায় ফিরে উকিল সাহেব দেখেন ছেলে টাকা কম এনেছে। হেলাল ভাই গল্পটা উনি বিশ্বাস করলেন না, উড়িয়েই দিলেন। অনেক লোক জনের সামনে ছেলেকে জুতা পেটা নাকি করেন, বলেন ঐদিকে মেলা বসছে-হাউজি জুয়া আর বাজে মেয়ে ছেলের পিছে টাকা উড়ানোর চান্স আছে। তুই নির্ঘাত ঐ কাজ করেছিস। রাগে দুঃখে হেলাল ভাই গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় বাস্তব গল্পের চেয়ে অদ্ভুত। গল্প হিসাবে বললে আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু যেদিন হেলাল ভাইএর জানাযার পড়ে ডেড বডি দাফনের জন্যে নিয়ে যাচ্ছিলো ঐদিন গ্রামের ঐ গৃহস্থ টাকা নিয়ে হাজির। উকিল সাহেবকে গিয়ে বলে-আপনার ছেলের মতো ভালো মানুষ হয় না। উনি আমার মেয়ের জীবনটা রক্ষা করেছিলেন।
উকিল সাহেব এর পড়ে রাজনীতি ছেড়ে দিছিলেন। লোকজনের সাথে আগেও খুব মিশতেন না। একেবারে লোক চক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন। মাঝে মাঝে দেশের বাড়ি গেলে এখন হেলাল ভাইদের বাসাটা দেখি। বিশাল বাসা, ভুতের বাড়ির মতো খা খা করে।

গল্পের সবগুলো ক্যারেক্টার বাস্তব। কে কি মনে করে এই ভেবে সবগুলো নামই পরিবর্তন করে দিয়েছি শুধু হেলাল ভাই এর নামটা ছাড়া।
৭টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×