রাজা ডেভিডের রাজত্বের সীমা
বেশ কিছুদিন আগে ইজরাইলীদের ইতিহাস লেখা শুরু করছিলাম। এক পর্যায়ে দুই পর্ব লিখেও ফেলছিলাম বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেঃ
ইসরাইলিয়দের ইতিহাস যেভাবে তাদের উৎপত্তি (প্রথম পর্ব)
ইসরাইলিয়দের ইতিহাস যেভাবে তাদের উৎপত্তি (দ্বিতীয় পর্ব)
কিন্তু সমস্যা হল ইজরাইলীদের ইতিহাস লিখতে গেলে কোন প্রমান্য পাওয়া যায় না, মুলতঃ ওল্ড টেষ্টামেন্ট বা তাওরাত বা তোরাহ ওপর নির্ভরশীল এই ইতিহাস। তারপরো এর মাঝ থেকে যেটুকু নির্যাস সম্ভব হয়েছে সেটুকু লিখে যাবার প্রচেষ্টা। এইই শেষ এ সংক্রান্ত পোষ্ট আর লিখব না।
নবী স্যামুয়েল রাজা সলকে অভিষেক করাচ্ছেন
১৪৪৫ খ্রিষ্টপূর্বে কোনান বিজয়ের মাধ্যমেই শুরু হয় ইহুদীদের বিজয় ইতিহাস। ১০৯৫ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত সল এর সম্রাট হিসাবে অভিহিত হবার আগে “জিহোভা”র (ইহুদীরা সৃষ্টিকর্তাকে এই নামেই ডাকত) নামে এক ধর্ম ভিত্তিক শাষন ব্যাবস্থা। শাষক ছিলেন বিচারকরা। তাদের বলা হত ইজরাইলের নেতাদের প্রধান। মোজেস বা মুসা (অঃ) দিয়ে ইজরাইলীদের শুরু এরপর জোসুয়া এসে কোনান বিজয়ের মাধ্যমে একে একটা রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় নিয়ে আসে। এক পর্যায়ে এই বিচারক ভিত্তিক শাষন ব্যাবস্থা নষ্ট হয়ে যায়, তখন সাধারন মানুষের ওপর নির্দেশ থাকে তাদের দৃষ্টিতে যা ভালো সে অনুযায়ী কাজ করার। মুলতঃ এতে কোনানে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে জনগন একজন রাজা দাবী করে। জনগনের দাবীর মুখে বেঞ্জামিন গোত্রের কিশের পুত্র সলকে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করা হয়, এবং তৎকালীন নবী স্যামুয়েল তার অভিষেক প্রদান করেন। এই ঘটনার সাথে সাথে শুরু হয় ইজরাইলের ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়।
সুরা বাক্কারার আয়াত
আমার এই লেখা তোরাহ এবং পশ্চিমি ইতিহাসবিদদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা কিন্তু এখানে মুসলমানদের দৃষ্টিকোন থেকে প্রসঙ্গক্রমে এই রাজা সল এবং স্যামুয়েল কে সামান্য দু চার লাইন লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। তোরাহ তে উল্লেখিত রাজা সল (কোরানে উল্লেখিত তালুত) যার উল্লেখ্য পাবেন সুরা বাক্কারা ২৪৮, ২৪৯ আয়াতে। আর স্যামুয়েল হল ইসলামিক স্কলারদের উল্লেখিত হযরত শামাবিল (আঃ) যার কথা কোরান শরীফে সরাসরি উল্লেখ্য না থাকলেও সুরা বাক্কারা ২৪৭-২৬৪ আয়াতে যে নবীর কথা উল্লেখ্য আছে ইনিই হযরত শামাবিল (আঃ) যাকে তোরাহতে স্যামুয়েল নামে উল্লেখ্য করা হয়েছে। যাই হোক এ ব্যাপারে আপাততঃ প্রসঙ্গ বাড়াব না সেক্ষেত্রে মুল ব্যাপার থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরে যাবে।
সল ছিলেন একজন যোদ্ধা। ফলে কোনানের পুরোহিতরা তাকে সহ্য করতে পারত না। সিংহাসনে বসেই তিনি আশেপাশের অঞ্চলগুলোর সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। যার মধ্যে প্রথম ছিল আমোনিয়ার, এরপর প্যালেষ্টাইন হামলা করেন তিনি যা “ব্যাটল অভ মিশমাচ” নামে খ্যাত। এরপর একে একে আরো যুদ্ধ হয়। রাজার এই যুদ্ধবাজ মনোবৃত্তি পুরোহিত এবং সাধারন জনগনের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই পর্যায়ে পটভুমিতে আবির্ভাব হয় ডেভিডের ( যাকে ইসলামে দাউদ (আঃ) নামে অভিহিত করা হয়)।
হার্প বাজিয়ে ডেভিড রাজা সলকে সুস্থ্য করে তোলেন
ডেভিড ছিলেন ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ রাজা। বাইবেলের তথ্য অনুযায়ী তিনি ছিলেন জেসের পুত্র, জন্ম জুডাহর বেথেলহেমে ১০৮৫ খ্রিষ্টপূর্বে। জেস ছিলেন ওবেদের পুত্র এবং বোয়াজ ও রুথের নাতি। বোয়াজ ছিলেন জুডাহের পুত্র ফারেজের বংশধর। যৌবন ডেভিড খুব সুরেলা গলার অধিকারী ছিল (একই কথা কোরান শরীফেও উল্লেখ্য আছে)। বলা হয়, যৌবনে রাজা সল “অশুভ শক্তি”র কারনে খুব পীড়িত হয়ে পরে। ডেভিড হার্প বাজিয়ে তাকে সুস্থ্য করে তোলেন।
ডেভিড এবং গোলিয়াথ এর যুদ্ধ
১০৬৩ খ্রিষ্টপূর্বে যখন ইজরাইলের সাথে প্যালেষ্টাইনের যুদ্ধ বাজে তখন ডেভিড রাজা সলের প্রসাদ থেকে বিদায় নিয়ে বেথেলহেমে নিজের বাড়ীতে ফিরে আসেন। এক পর্যায়ে দেখেন দুই সেনাবাহিনী পরস্পর যুদ্ধ সাজে যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছে তখন তিনি কোনানের (যা ইজরাইল নামে পরিচিত) রাজা সলের অনুমতি নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসেন কারন ততদিনে কোনানের রাজা সলের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে যদিও তিনি প্যালেষ্টাইনের অধিবাসী ছিলেন, সেখানে প্যালেষ্টাইনী দৈত্য গোলিয়াথ ডেভিডকে দ্বৈত যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানান। ডেভিড একটা গুলতি হাতে নিয়ে পাচটি পাথর নিয়ে গোলিয়াথের মুখোমুখি হন এবং গুলতি দিয়ে গোলিয়াথকে আঘাত করেন যাতে গোলিয়াথ পরাজয় বরন করে। মিথোলজিতে এটা ডেভিড গোলিয়াথের যুদ্ধ নামে পরিচিত। (ইসলামে এটা তালুত জালুতের যুদ্ধ নামে পরিচিত।)
ডেভিড পালিয়ে গিয়ে জুডিয়ার বুনো অঞ্চলে আশ্রয় নেয়
এরপর রাজা সল খুশী হয়ে ডেভিডের সাথে তার মেয়ে মিচালের বিয়ে দেন এবং সেনাবাহিনীতে চাকুরী দেন। খুব অল্প সময়ের মাঝে ডেভিড সেনাবাহিনীতে উন্নতি করেন এবং সাধারনের ভালোবাসা পান। কিন্তু এটা তার জন্য ভালো কিছুই আনে না কারন রাজা সল ডেভিডের উপর হিংসাবোধ করেন। এবং কয়েকবার তাকে হত্যা চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ডেভিড পালিয়ে গিয়ে জুডিয়ার বুনো অঞ্চলে আশ্রয় নেয় (১০৫৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এখানে কিছু সৈন্য তার সাথে যোগ দেয়। ডেভিড কয়েকবার সুযোগ পেয়েও নিজ শ্বশুর রাজা সলকে হত্যা করেনা কারন সে রাজার রক্তে নিজ হাত রঞ্জিত করতে চায় না।
এরপর ডেভিড প্যালেষ্টাইন পালিয়ে যায়। সেখানে তাকে সল এবং ইজরাইলের শত্রু হিসাবে সাদরে গ্রহন করা হয়। প্যালেষ্টাইনের রাজা তাকে এবং তার অনুসারীদের জিকলাগ শহরে বসবাসের অনুমতি দেয়। ১০৫৫ খ্রিষ্ট পূর্বে প্যালেষ্টাইনের সেনাবাহিনী ইজরাইলের ওপর আক্রমনের নিমিত্তে জড়ো হলে ডেভিড প্যালেষ্টাইনের পক্ষে যুদ্ধ করতে চায়। কিন্তু প্যালেষ্টাইনের সেনাপ্রধানরা ডেভিডকে বিশ্বাস করে না। কারন তার শ্বশুর ইজরাইলের রাজা সল। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ডেভিড যুদ্ধে অংশ না নিয়ে নিজ শহর জিকলাগে ফিরে আসেন।
ডেভিড কর্তৃক আমালকিয়াদের হত্যা
সেখানে এসে দেখেন আমালকিয়ারা জিকলাগ আক্রমন করে ডেভিডের স্ত্রী পুত্র কন্যাদের বন্দী করে পুরা জিকলাগ শহর মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে, এ পরিস্থিতিতে ডেভিড আমালকিয়াদের পিছু ধাওয়া করে নিজ স্ত্রী সন্তানদের উদ্ধার করে সব আমালকিয়াদের হত্যা করে এবং তাদের লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধার করে। মাত্র ৪০০ আমালকিয়া তার হাত থেকে পালিয়ে বেচেছিল।
ওদিকে প্যালেষ্টাইন এবং ইজরাইলীদের মাঝে যুদ্ধে প্যালেষ্টাইনীরা বিজয়ী হন। ইজরাইলীরা গিলবোয়া পাহাড়ে পালিয়ে যায় সেখানে সলের এক পুত্র বাদে সবাই নিহত হয়। এবং গুরুতর আহত সল তলোয়ারের ওপর ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। সলের বেচে যাওয়া পুত্র ইশবোশেথকে ইজরাইলের রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ওদিকে এক মাত্র জুডাহ গোত্র ছাড়া সবাই ইশবোশেথকে মেনে নেয়। এই জুডাহ গোত্রের প্রধান ছিল ডেভিড। প্রায় সাত বছর ইশবোশেথ রাজত্ব করার পর আততায়ীর হাতে নিহত হলে ডেভিডের জন্য ইজরাইলের সিংহাসনে বসার পথ খুলে যায়।
কিং ডেভিড
সিংহাসনে বসেই ডেভিড জেরুজালেম দখল করেন। যা ছিল জেবুসীয়দের প্রধান নগরী। যাকে তারা বলত জেবুস। ১০৫৫ খ্রিষ্টপূর্বে ডেভিড রাজা হবার পর জেবুস সালেম বা জেরুজালেমকে নিজের রাজধানী ঘোষনা করেন। পরবর্তী তেত্রিশ বছর এখান থেকেই রাজা ডেভিড রাজত্ব করে। ১০৪৫ খ্রিষ্টপূর্বে রাজা ডেভিডের নির্দেশে আর্ক অভ কভেন্যান্ট কিরজাথ জিয়ারিম থেকে জেরুজালেমে নিয়ে আসা হয় এবং একটি অস্থায়ী উপাসনালয়ে রেখে দেয়া হয়। ১০১৫ খ্রিষ্টপূর্বে চল্লিশ বছর রাজত্ব করার পর মারা যান ডেভিড। ইজরাইলের সিংহাসনে বসা শাষকদের মাঝে তিনি ছিলেন সব থেকে বিখ্যাত। তারপর সিংহাসনে বসেন তার পুত্র সলোমন। যিনি ছিলেন বাথসেবার গর্ভে ডেভিডের পুত্র। রাজা ডেভিড ছিলেন প্রথম ব্যাক্তি যিনি অস্থায়ী উপাসনালয়ের বদলে স্থায়ী তীর্থ স্থানের প্রস্তাব দেন। মন্দিরের নকশা এবং স্থান ডেভিড নির্বাচন করলেও মন্দির নির্মানের ঐশী নির্দেশ তার ওপর ছিল না, সে দায়িত্ব বর্তায় তার ছেলে সলোমনের ওপর।
কিং সলোমন টেম্পল
রাজা সলোমন তার রাজত্বের চতুর্থ বছরে, ১০১২ খিষ্টপূর্বে রাজা সলোমন এই মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ইতিহাসে যা কিং সলোমন টেম্পল নামে প্রসিদ্ধ। সে আর এক মহা ইতিহাস। আগেই এনিয়ে পোষ্ট দিয়েছিলাম। জানতে চাইলে এক নজর ঘুরে আসুন কিং সলোমন টেম্পল
সুত্রঃ দ্যা অরিজিন অভ ফ্রি ম্যাসনারি, কাসাসুল আম্বিয়া, হিব্রু থেকে ইহুদী এবং অন্তর্জাল। ছবি অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৩:৫৩