আমি তখন এইচ.এস.সি. তে পড়ি। আমরা কয়েকজন বন্ধু একসাথে একজন ম্যাম এর কাছে রসায়নের টিউশন নিতাম। একদিন আমি, সাওন, জ্যোতি, রকি আরো ২-১ জন ছিল সম্ভবত, হেটে হেটে ম্যামের বাসায় যাচ্ছিলাম। তার বাসার গেইটের একটু আগে দেখলাম ছোট একটা জটলার মত। একটুখানি দেখলাম, যে একজন লোক রাস্তার পাশে শুয়ে আছে আর কয়েকজন তাকে ঘিরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে। আমাদের সময় ছিল না তাই দাড়াই নি। খুব বেশী ভাবলাম না ওটা নিয়ে। মনে হয়েছিলো কেও শম্ভবত ভিক্ষা করছেন নিজের অসুস্থতার কথা বলে। পড়া শেষ করে ম্যামের বাসার গেইট থেকে বেড়িয়ে দেখি, ওই লোকটা রাস্তার উল্টোদিকে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। চলে যাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু আমার ভালো লাগে নি এভাবে কিছু দেখেও না দেখার ভান করতে। আমি বন্ধুদের বললাম একটু দাড়াতে। লোকটার সামনে গিয়ে আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছে আপনার। লোকটি প্রায় কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল বাবা আমারে বাঁচান। আমি একটু ধাক্কার মত খেলাম। জানতে চাইলাম কি হয়েছে। উনি আমার হাত টা ধরে তার পেটের একটু নিচের দিকে ছোঁয়ালেন। আমি অনুভব করলাম তার পেট একটি ফুটবলের মত শক্ত হয়ে ফুলে আছে। বললেন তার প্রস্রাব আটকে আছে ৬ ঘণ্টা ধরে। আমি বুঝলাম যে লোকটি কি পরিমান কষ্ট সহ্য করছে শেষ কয়েক ঘণ্টা ধরে। কারন আমাদের যখন প্রস্রাব ধরে আর আমরা তা না করতে পাড়ি তাহলে বোঝা যায় কেমন কষ্ট হয়। ডায়াবেটিস এর কি একটা সমস্যার কারনে এটা হয়েছে। একটি ইনজেকশন দেওয়া লাগবে। তা না হলে তার প্রস্রাব হবে না। জানতে চাইলাম তার পরিবারের কথা। বলল তার ছেলে নাকি জেলে আছে। কি কারনে জেলে তা আর জানতে চাইলাম না। তিনি রিকশা চালান। তার স্ত্রী ছাড়া দেখার আর কেউ নেই।
ভাবলাম আমাদের মত সুস্থ ও সাবলম্বি মানুষগুলো থাকতে একটি মানুষ সামান্য ২০০ টাকার জন্য মারা যাবে সেটা হতে পারে না। আমি বন্ধুদের কাছে আসতে বললাম আর বেপারটা বললাম। আমি আমার পকেটে হাত দিয়ে দেখি ৩০ টাকার মত ছিল। বন্ধুদের যার কাছে যা আছে তা দিতে বললাম। কারো কাছে তেমন বেশী টাকা ছিল না কারন আমরা সবাই ছাত্র। সবার টাকা মিলিয়ে দেখি ১০০ টাকার মত হয়েছে। পরে আমরা রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে লোকটাকে দেখিয়ে সামান্য কিছু সাহায্য চাইতে শুরু করলাম। অবাক ভাবে লক্ষ করলাম ৫ টাকা ১০ টাকা, যে যা পাড়ছে সবাই দিচ্ছে। একজন তো তার পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে দিলেন। শেষে যখন দেখলাম ২৫০ টাকার মত হয়েছে। তখন একটি রিকশা দাড় করালাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম ওই লোকটাকে একটু বারডেম এ নিয়ে যাও। রিকশাওয়ালা যেতে চাইল না। তাকে মিনতি করে বললাম তোমার মতই একটি রিকশাওয়ালা মারা যাচ্ছে। তখন রিকশাওয়ালা বলল ভাই আমি বারডেম পর্যন্ত জাইতে পারমু না। কারন আমার রিক্সার নাম্বার নাই। তখন বললাম অন্য কোন রিক্সা নাই আসে পাশে তুমি তাহলে সামনে নিয়ে গিয়ে আরেকটি রিক্সায় তুলে দিও। তোমাকে ভাড়াও দিয়ে দিচ্ছি। ২৫০ টাকার মধ্যে ৫০ টাকা রিক্সা ওয়ালাকে দিলাম আর বাকি ২০০ টাকা ওই লোকটিকে দিলাম। পরে লোকটিকে রিক্সায় তুলে দিলাম। লোকটির চোখ থেকে পানি পরছিল। আমাদের মুখের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি ওই চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। কি কি যেন বলছিল লোকটি আমদেরকে। কোন কথাই আমার কানে যাচ্ছিলো না। রিক্সা চলতে শুরু করতেই আমরা বাসার দিকে হাটতে শুরু করলাম।
বাসায় এসে সারাদিন মন খারাপ হয়ে থাকল। রাতে ঘুমাতে গিয়েও ঘুমাতে পাড়ি নি এই ভেবে যে লোকটিকে কি ওই রিক্সা ওয়ালা পৌঁছে দিয়েছিল? সেকি বারডেম এ যেতে পেরেছিল? তাকে কি বাঁচাতে পেরেছি আমরা? এর পর আর জানতে পাড়ি নি লোকটির শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিলো...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


