এফ আর খানকে বলা হয় স্থাপত্যশিল্পের আইনস্টাইন। এফ আর খানের জীবদ্দশায় তাঁর নকশা করা সিয়ারস টাওয়ারই ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। ১১০ তলা, এক হাজার ৪৫৪ ফুট উঁচু। এই ভবনই তাঁকে এনে দেয় বিশ্বখ্যাতি।
বলুন তো, সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কোন দেশে জন্মেছিলেন? বাংলাদেশে? হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু এটা ঠিক যে এই বাংলায় জন্মেছিলেন এক আইনস্টাইন। তিনি ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান)। আপেক্ষিকতাবাদের জন্য বিশ্বখ্যাতি জার্মানির আলবার্ট আইনস্টাইনের। আর বাংলার আইনস্টাইনের বিশ্বখ্যাতি স্থাপত্যে। তাঁকে বলা হয় আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার।
আপনার কি মনে পড়ছে? ২০০৯ সাল। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করছেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামা বলছেন, আমরা শ্রদ্ধা জানাই এক বাঙালি প্রকৌশলীকে। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আকাশচুম্বী ভবনটি তাঁরই নকশা করা। তিনি (এফ আর খান)। তাঁর সময়ে তিনিই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ স্বপ্নবাজ। কারণ ‘আলোকিত মানুষ’-এর স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলে থাকেন, যার স্বপ্ন যত বড়, সেই মানুষ তত বড়। এফ আর খানের জীবদ্দশায় তাঁর নকশা করা সিয়ারস টাওয়ারই ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। ১১০ তলা, এক হাজার ৪৫৪ ফুট উঁচু। এই ভবনই তাঁকে এনে দেয় বিশ্বখ্যাতি। তাঁকে বলা হয় গগনচুম্বী ইমারতের রেনেসাঁর স্রষ্টা।
বাংলাদেশের মাদারীপুরের শিবচরে তত্কালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যক্ষ খান বাহাদুর আবদুর রহমান খানের ঘরে ১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন এফ আর খান। তিনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক বাঙালি সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন বাংলার মেধাবী মুখ। ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। এ জন্যই ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থানসহ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৫২ সালে বৃত্তির সুবাদে পাড়ি জমান সুদূর আমেরিকায়। আপনার অবাক লাগতে পারে এই জেনে যে আমেরিকার ইলিনইজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এফ আর খান দুটো বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি ও একটা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন মাত্র তিন বছরে। তার পছন্দের বিষয় ছিল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং। তাঁর মেধার তীক্ষতা অনুধাবন করে স্থাপত্য সংস্থা স্কিডমুর-ওয়িংস-মেরিল। তারা আমন্ত্রণ জানায় খানকে। এবং খান তাদের সঙ্গে ১৯৫৫ সালে যোগ দেন। কিন্তু এফ আর খান ভালোবাসতেন স্বদেশকে, স্বদেশের মাটি ও মানুষকে। এ জন্যই সুযোগ পেয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন ১৯৫৭ সালে। যোগ দেন করাচি ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে। কিন্তু এখানে এসে হতাশ হলেন খান। তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পেলেন না। তাঁর স্বপ্ন ছিল নির্মাণ-কৌশলকে ঘিরে। কিন্তু নানা কাজের চাপে করাচি ডেভেলপমেন্টে তাঁর স্বপ্নটা শুকিয়ে যেতে শুরু করে। এফ আর খান ছিলেন দারুণ বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি। আপনার চোখ দিয়ে দেখতে পান নিজ স্বপ্নের অদূর অপমৃত্যু। ফলে মাতৃভূমি ছেড়ে আবার আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চিন্তা করেন। আবার দেশপ্রেমী খান ভাবেন দেশে থেকে স্বপ্নটাকে লালন-পালন করার কথা। এভাবে মনস্তাত্ত্বিক এক যুদ্ধে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ (তখন পূর্ব পাকিস্তান) ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাওয়ার। এবং ১৯৬০ সালে আমেরিকার সেই স্থাপত্য সংস্থা স্কিডমুর-ওয়িংস-মেরিলে পুনরায় যোগদান করেন। এরপর স্বপ্নটা তাঁর ডানা মেলা শুরু করে। উনিশ শ ষাটের দশকে এফ আর খান একের পর এক বড় বড় সব ভবনের নকশা আঁকতে থাকেন এফ আর খান। ১৯৬৯ সাল। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্ খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি তখন সিয়ারস অ্যান্ড কোং। তাদের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার। সব কর্মীর একটি মাত্র কার্যালয় বানানোর স্বপ্ন সিয়ারস কোম্পানির। এ স্বপ্নটার বাস্তবায়ন করেন আমাদের এফ আর খান। ১১০ তলা উঁচু একটি ভবনের নকশা তৈরি করেন তিনি। ১০১ একর জমির ওপর তিন বছর এক মাস ১০ দিনে সেই ভবনটি দাঁড়িয়ে যায় সম্পূর্ণ মাথা উঁচু করে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এক বাঙালি ব্যক্তিত্বও। সিয়ারস টাওয়ার (১৬ জুন, ২০০৯ থেকে পরিবর্তিত নাম উইলিস টাওয়ার) ছিল ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। এবং এখনো আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন সেটিই। কেউ যদি সেখানে গিয়ে থাকেন, দেখে থাকবেন করিডরের মূল ফটকে বাংলায় লেখা ‘স্বাগত জানান’ (স্বাগত জানান) আর এফ আর খানের একটা ছবি। ‘কিন্তু আমি এ বছর যখন সিয়ারস টাওয়ার ভ্রমণ করি, সেখানে কর্মরত একজন আমেরিকানকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি এফ আর খানকে বাংলাদেশি হিসেবে স্বীকার করলেন না। এবং ওই ফটকে কোথাও পরিচিতিতে এফ আর খানকে বাংলাদেশি উল্লেখ করা নেই। শুধু এভাবে লেখা আছে যে ইলিনইজের সময়ের সেরা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার।’ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এফ আর খান সম্পর্কে আলাপচারিতায় হতাশা ব্যক্ত করেন দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুল আউয়াল। ‘না, স্বদেশই যখন তাঁকে সম্মান জানাতে পারেনি, ভিনদেশিদের ওপর অভিমান করা চলে না’, নিজেকে এভাবেই সান্ত্বনা দেন তিনি। আসলে আমরা এখনো অনেক স্বপ্নকে গলা টিপে মেরে ফেলছি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। এফ আর খানের স্বপ্ন বেঁচে গিয়েছিল তিনি বিদেশে চলে গেলেন বলেই। তিনি কিন্তু বিদেশে গিয়ে ভুলে যাননি তাঁর স্বদেশকে। এ জন্যই ১৯৭১ সালে যখন দেশ ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এ লিপ্ত, প্রবাসের বাঙালিদের নিয়ে তিনি একটা ফান্ড গঠন করেছিলেন। আপনার জানা আছে কি, এফ আর খানই প্রথম বাঙালি, যিনি মার্কিন সিনেটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমনে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য? এ জন্য বিনিময়ে দেশ তাঁকে একবার স্বাধীনতা দিবস মেডেল দেয়, তাও তাঁর মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৯৯ সালে। দেশ তাঁকে ‘যোগ্য সম্মান’ না দিলেও বাংলাদেশ ছিল তাঁর অস্তিত্বে আর অনুভবে।
জীবনকে কীভাবে দেখতেন এফ আর খান? তিনি বলতেন, ‘প্রতিটি মানুষের জীবনই প্রযুক্তি। আর জীবন মানেই শিল্প। জীবন মানে একটা নাটক আর সুর-সংগীত।’ জীবনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা? বাংলার আইনস্টাইন বলতেন, ‘জীবন মানে মানুষ, মানুষই জীবন।’ মানুষ কেন বেঁচে থাকে? এফ আর খান বলতেন, ‘মানুষ বাঁচে তার স্বপ্নের জন্য। মানুষ বাঁচে তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে কেউই চায় না। কিন্তু আমি মাতৃভূমি ছেড়েছি স্বপ্নকে বাঁচাতে।’ তাঁর স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। কারণ নিয়তি তো তাঁর সঙ্গে ছিল। আল্লামা ইকবালের ভাষায় বলতে হয়:
মাতৃভূমিকে যে ছেড়ে গেল
নিয়তি তার সঙ্গ নিল
বাগানের ঝরাফুলেই গাঁথা বিশ্ববিজয়মাল্য।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



