পাহাড়ে আগুন, রাজধানীতে নীরবতা: রাষ্ট্রের অদৃশ্য দায়িত্বহীনতা ও ভয়াবহ ভবিষ্যৎ
পাহাড়ে সহিংসতা থামছেই না। নিরপরাধ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখনই কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা।
আমরা সবাই চাই—পাহাড়ে শান্তি, মানুষের জীবনে নিরাপত্তা।
পাহাড়ে যা ঘটছে তা আর সহনীয় পর্যায়ে নেই। বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ে টানটান উত্তেজনা থাকলেও এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। অতীতে সংঘর্ষ মূলত নির্দিষ্ট কিছু সংগঠন বা সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এবার রাস্তায় নেমে এসেছে সাধারণ মানুষ—পুরো জাতিগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। এটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংকেত।
এখন যদি রাষ্ট্র বা প্রশাসন পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে সামাল দিতে ব্যর্থ হয়, তবে এ আগুন কেবল পাহাড়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমতলেও ছড়িয়ে পড়বে, এবং তা সামাল দেওয়া হবে প্রায় অসম্ভব।
রাষ্ট্রের দায়িত্বহীন নীরবতা
যেকোনো সংকট পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনগণের কাছে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়া। এই বার্তাটি শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, আস্থা তৈরির প্রতীকও বটে। কিন্তু পাহাড়ের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত সরকারের বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো নির্দিষ্ট মুখপাত্রকে নিয়োগ করে ধারাবাহিকভাবে মিডিয়াকে ব্রিফ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সংবাদমাধ্যমে বিচ্ছিন্ন কিছু বিবৃতি এসেছে—কখনো পুলিশ, কখনো সেনা, আবার কখনো কোনো মন্ত্রী—কিন্তু সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা বা একক নেতৃত্বের ইঙ্গিত নেই। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
এটাই হলো দ্বৈত শাসনের মারাত্মক কুফল। সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে দায়িত্ব কার—এ নিয়ে স্পষ্টতা নেই। ফলে মাঠে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিভ্রান্ত, আর সাধারণ মানুষ মনে করে রাষ্ট্রের কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নেই। যেখানে কর্তৃত্বের অস্পষ্টতা থাকে, সেখানে গুজব ও ভুল তথ্য সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
#পাহাড়ে_শান্তি #হিংসা_বন্ধ_করুন #মানবিকতা
ঘরের আগুন, বাইরে ব্যস্ততা
রাজধানী এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বর্তমানে ব্যস্ত নিউইয়র্ক সফর, গাজার যুদ্ধ, এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ইস্যু নিয়ে। টেলিভিশনের টকশোগুলোতেও এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ নিজের ঘরের ভেতর পাহাড়ে যখন আগুন জ্বলছে, তখন সেখানে দৃষ্টি দেওয়ার মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
এ যেন অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে বসে দূরের আলোকসজ্জা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা।
পাহাড়ের সংঘর্ষের দীর্ঘ ইতিহাস
পাহাড়ের সমস্যার শিকড় বহু পুরনো। দীর্ঘদিনের অবহেলা, বৈষম্য, এবং বিশ্বাসের সংকট পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর মনে ক্ষোভ জমিয়েছে। বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিবার সংঘর্ষ বাড়লে দ্রুত সেনা মোতায়েন বা প্রশাসনিক কঠোরতা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলো কেবল উপসর্গে প্রলেপ দেওয়ার মতো।
রোগের মূলে হাত না দিলে যতবারই এই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা হবে, ততবারই নতুন আকারে সমস্যা ফিরে আসবে।
এবার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা আগের চেয়ে আলাদা। হঠাৎ করে কেন একটি গোটা জাতিগোষ্ঠী এমন ব্যাপক সংখ্যায় রাস্তায় নেমে এসেছে? কিসের ভয়ে বা কিসের ক্ষোভে তারা এত সংগঠিত হয়েছে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আন্তরিক চেষ্টা কি কেউ করছে? নাকি সবকিছুকেই বিদেশি ষড়যন্ত্র, বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্রান্ত বা “রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড” বলে চিহ্নিত করে দায় এড়ানো হচ্ছে?
ষড়যন্ত্রের গন্ধে আসল গন্ধ হারানো
আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সবচেয়ে বড় অভ্যাস হলো—সবকিছুর পেছনে ষড়যন্ত্র খোঁজা।
সমস্যা হলো, ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজতে খুঁজতে আসল সমস্যার গন্ধটাই হারিয়ে যায়। পাহাড়ে যা ঘটছে তার পেছনে হয়তো কিছু ষড়যন্ত্র আছে, কিন্তু কেবল সেই ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকলে প্রকৃত সমাধানের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
যেমন, একটি পুরো জাতিগোষ্ঠী কেন রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে পারছে না, কেন তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারা অস্ত্রধারীদের কথায় রাস্তায় নামতে প্রস্তুত—এই প্রশ্নগুলো যদি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে।
যোগাযোগের সংকট: তথ্যহীনতার ভয়াবহতা
পাহাড়ে এখন সবচেয়ে বড় যে সংকট তৈরি হয়েছে তা হলো যোগাযোগের অভাব।
রাষ্ট্রের কোনো পক্ষ থেকে যদি প্রতিদিন সঠিক তথ্য দিয়ে জনগণকে অবহিত করা হতো, তাহলে গুজব ও ভুল তথ্যের বিস্তার কমত। কিন্তু বর্তমানে তথ্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে গুজব, ভয় এবং উত্তেজনা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের ভিডিও, ছবি, এবং অডিও ছড়িয়ে পড়ছে, যেগুলোর বেশিরভাগই যাচাই করা নয়।
এমন পরিবেশে সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় আবেগের ওপর ভিত্তি করে, যুক্তির ওপর নয়। আর এই আবেগই সংঘর্ষকে আরও তীব্র করে তোলে।
রাষ্ট্রের শেষ সুযোগ
রাষ্ট্র যদি সত্যিই আন্তরিক হয়, তাহলে এখনো কিছু করার সময় আছে।
১. একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:
পাহাড়ে একটি স্পষ্ট নেতৃত্ব ঘোষণা করতে হবে, যিনি সরাসরি জনগণের সঙ্গে কথা বলবেন এবং মিডিয়াকে নিয়মিত ব্রিফ করবেন।
২. স্বচ্ছ তদন্ত:
সংঘর্ষের মূল কারণ বের করতে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে পাহাড়ের জনগণ বিশ্বাস রাখতে পারে।
৩. উন্নয়ন ও আস্থার পদক্ষেপ:
কেবল সামরিক বা প্রশাসনিক শক্তি নয়, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ও আস্থার পুনর্গঠন জরুরি।
৪. দ্বৈত শাসন অবসান:
সেনা ও বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব স্পষ্টভাবে আলাদা করতে হবে, যাতে বিভ্রান্তি দূর হয়।
শেষ কথা: অগ্নিকাণ্ডের আগেই সতর্কতা
পাহাড়ের বর্তমান অগ্নিকাণ্ড যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে এটি কেবল একটি ভৌগোলিক সমস্যাই থাকবে না।
এটি পুরো রাষ্ট্রের জন্য একটি ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকটে পরিণত হবে।
আজকের এই নীরবতা, আজকের এই অবহেলা—আগামী দিনের ভয়াবহ ধ্বংসের ইঙ্গিত হতে পারে।
রাষ্ট্রের চোখ যদি এখনো না খোলে, তবে পাহাড়ের আগুন একদিন গোটা দেশকে গ্রাস করবে।
এখন প্রশ্ন কেবল একটি—রাষ্ট্র কি সত্যিই পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবে, নাকি দেরি করে ফেলবে এতটাই যে কিছু করার আর সময় থাকবে না?


অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


