
প্রশ্নটি প্রথমে যতটা অযৌক্তিক মনে হয়, ইতিহাসের আয়নায় তাকালে তা আরও অবাস্তব হয়ে ওঠে। কারণ, যে ব্যক্তি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে, এবং শহিদমিনার ধ্বংসকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখেছে— তার পক্ষে বাংলার কোনো দাবি তোলা নৈতিকভাবে হাস্যকর।
আজ যখন জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশের রাজনীতি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে, তখন তাদের ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়া জরুরি। ২০২৫ সালের মে মাসে তারা যেভাবে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল করেছে, তা অন্তত স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান। অথচ ২০২৪ সালের জুলাই মাসের সরকারবিরোধী আন্দোলনে তারা সাধারণ শিক্ষার্থী বা জনতার ছদ্মবেশে অংশ নেয়— গোপনে। ইতিহাসের চোখে এই গোপন রাজনীতি সর্বদা ভণ্ডামির প্রতীক হয়ে থাকে।
এই ভণ্ডামির শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা প্রজন্মে, বিশেষ করে গোলাম আজমের রাজনীতিতে। তাঁকে ‘ভাষাসৈনিক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা হয়— সেই ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকত্বের সময়কার একটি মানপত্রের সূত্র ধরে। ১৯৪৮ সালে তিনি লিয়াকত আলী খানকে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিক উদ্যোগের অনেক পরে দেখা যায়, ১৯৭০ সালে গোলাম আজম নিজেই বলেন— “বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করা পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল ছিল।” অর্থাৎ, তিনি নিজেই তাঁর অতীত অবস্থানের বিরোধিতা করেন এবং ভাষা আন্দোলনকে অস্বীকার করেন।
এই আত্মবিরোধই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মূল চরিত্র। ১৯৫২ সালে ছাত্রদের রক্তে গড়া ভাষা আন্দোলনকে তিনি ইসলামবিরোধী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, আর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনারা যখন কেন্দ্রীয় শহিদমিনার ভেঙে ফেলে, তখন জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদকীয় লেখে—
“সেনাবাহিনী এই কুখ্যাত মিনারটি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ গড়ে শহিদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন।”
এ এক ভয়াবহ ঐতিহাসিক দলিল। শহিদমিনারকে “কুখ্যাত মিনার” বলা মানে কেবল স্থাপত্য নয়, বাংলার আত্মাকে অপমান করা।
গোলাম আজম ও তাঁর জামায়াত ১৯৭১ সালে কেবল পাকিস্তানের পক্ষেই ছিলেন না, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধেও সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। যুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস সংগঠনের নেপথ্য পরিকল্পনাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতের দালাল’, ‘দুষ্কৃতকারী’, এমনকি ‘ইসলামের শত্রু’ বলে অভিহিত করেন। ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান ও নিয়াজির সঙ্গে বৈঠক করে তিনি যুদ্ধ দমন কৌশল নিয়ে পরামর্শ দেন। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করতে মুসলিম দেশগুলোতে প্রচার চালান যে “বাংলাদেশের বিদ্রোহ ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র”।
এই অবস্থান কেবল রাজনৈতিক নয়, গভীরভাবে নৈতিক দেউলিয়াত্বের পরিচায়ক। কারণ, ইসলাম কখনোই অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা বা দমননীতির পক্ষে দাঁড়ায় না। কিন্তু গোলাম আজম ইসলামের নামেই সেই অন্যায়কে সমর্থন করেছেন। পাকিস্তানকে তিনি বলেছেন “পবিত্র ভূমি”, অথচ ‘পাকিস্তান’ শব্দটি এসেছে ভৌগোলিক রাজ্যগুলির নামের সংক্ষিপ্ত রূপ থেকে— এতে কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য নেই। তিনি ইসলামকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন, আর সেটাই তাঁর পুরো রাজনীতির নির্মম সত্য।
১৯৭১ সালের পর যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখনও গোলাম আজম সেই বাস্তবতাকে স্বীকার করেননি। পাকিস্তানে বসে তিনি বাংলাদেশের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, আর পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে নিজেকে “ভাষাসৈনিক” বলে প্রচার করেছেন। এই আত্মবিরোধিতা কেবল ইতিহাসের নয়, নৈতিকতারও অবমাননা।
তাঁর অনুসারীরা আজও এই বিকৃত ইতিহাস প্রচার করে— যেন বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা সবকিছুই তাঁদেরও উত্তরাধিকার। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়: যে ব্যক্তি ভাষার দাবি ‘ভুল’ বলেছিলেন, শহিদমিনার ভাঙাকে প্রশংসা করেছিলেন, এবং পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ দমন করেছিলেন— তাঁর কি বাংলার ওপর কোনো নৈতিক দাবি থাকতে পারে?
বাংলা তাদের নয়, যারা বাংলাকে অস্বীকার করেছে। বাংলা তাদের, যারা শহিদমিনারের পাশে দাঁড়িয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে।
সুতরাং উত্তর একটাই—
না, বাংলা গোলাম আজমের নয়; গোলাম আজমই বাংলার নন।
বাংলার ইতিহাস, চেতনা, ও আত্মপরিচয় মুক্তিযুদ্ধের রক্তে নির্মিত— কোনো ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকের মিথ্যা ভাষাস্মৃতি দিয়ে নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




