
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে এখন যেন এক রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে বিএনপি। দলটি প্রকাশ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবের সমালোচনা করলেও, সেগুলো সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার মতো অবস্থানও নিতে পারছে না। কারণ, এই ‘না’ বলাটাই হতে পারে রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ—যা সরকারের হাতে তুলে দেবে নতুন এক প্রচারণার অস্ত্র: “বিএনপি সংস্কারবিরোধী দল।”
অন্যদিকে, পুরোপুরি মেনে নেওয়াও সম্ভব নয়। কারণ, কমিশনের সুপারিশের কিছু অংশ এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতের সরকার (বিশেষ করে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে) অনেক সীমাবদ্ধ অবস্থায় পড়বে। এ যেন গিলতে না পারা, উগরাতে না পারার পরিস্থিতি।
গত দুই দিনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা একাধিকবার বৈঠক করেছেন। আলোচনায় এসেছে কৌশলগত পথনির্ধারণ—তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার বদলে ধীরে ধীরে সরকারের ওপর পাল্টা চাপ সৃষ্টি করা। দলীয় নীতিনির্ধারকেরা বুঝে গেছেন, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখালে সেটি ‘বাধা সৃষ্টিকারী’ চেহারায় ফুটে উঠবে। তাই আপাতত সংযমী থাকা এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও কমিশনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আপত্তিগুলো তোলার পরিকল্পনা করছে বিএনপি।
এই কৌশলকে অনেক বিশ্লেষক বলছেন “কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা।”
একদিকে দলটি সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে—বিশেষত গণভোটের সময় নির্ধারণ, সংবিধান সংস্কার পরিষদের গঠন ও ভিন্নমতের উল্লেখ না থাকা—অন্যদিকে পুরো প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও রাখছে না।
বিএনপি নেতাদের মতে, সরকার জুলাই সনদকে দুই ভাগে ভাগ করে তাদের ‘ফাঁদে ফেলেছে’। প্রথম ভাগে ছিল সংস্কার প্রস্তাব, দ্বিতীয় ভাগে বাস্তবায়নের সুপারিশ। বিএনপি ভেবেছিল, দ্বিতীয় অংশে ভিন্নমতের বিষয়গুলো প্রতিফলিত হবে। কিন্তু সরকার ও কমিশন তাদের সেই প্রত্যাশা ভেঙে দিয়েছে। ফলাফল—বিএনপি এখন এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে যেদিকেই যায়, রাজনৈতিক ক্ষতি অনিবার্য।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী যেমন বলেছেন, “বিএনপি সিদ্ধান্তটা না দেখেই সাইন করেছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বুঝে নেওয়াই উচিত ছিল।” এই মন্তব্য বিএনপির ভুল কৌশলকেই সামনে আনে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি এখন মূলত সময়ক্ষেপণ ও অবস্থান সামঞ্জস্যের পথে হাঁটছে। দলটি চায়, ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক—যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। এই চাওয়াটাই এখন সরকারের কাছে বিএনপির ‘দুর্বলতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, “বিএনপি এখন এমন এক অবস্থায় যেখানে তারা না পারছে গিলতে, না পাচ্ছে উগরাতে। সংস্কার নিয়ে পোলারাইজেশনে তারা অনেকটা একা হয়ে গেছে।”
সব মিলিয়ে, বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ—দুটোই কণ্টকাকীর্ণ। সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বাড়বে; আবার সম্পূর্ণ গ্রহণ করলে নেতৃত্বের ভেতরেই বিরোধ দেখা দেবে। তাই আপাতত দলটি ‘সময়ের অপেক্ষা’ করছে—দেখছে সরকার কীভাবে এগোয়, এরপর কৌশল বদলাবে।
রাজনীতিতে কখনো কখনো সংযমই বড় প্রতিক্রিয়া। বিএনপির বর্তমান অবস্থানও হয়তো তাই—একটা নিয়ন্ত্রিত নীরবতা, যার ভেতরেই লুকিয়ে আছে পরবর্তী ঝড়ের প্রস্তুতি।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ২:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




