দিপুকে হত্যার দায় রাষ্ট্রের—আইনগতভাবেও। সমাজেরও।
দিপুকে হত্যা করা হয়েছে—এটা মতামত নয়, এটি একটি আইনগত সত্য। প্রশ্ন হলো, এই হত্যার দায় কার? শুধু যারা হাত চালিয়েছে তাদের? নাকি যারা থামায়নি, হস্তান্তর করেছে, নীরব থেকেছে—তাদেরও?
১. এটি সরাসরি হত্যা—আইন কী বলে
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ৩০২ অনুযায়ী, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যু ঘটায়, সে হত্যার অপরাধে দোষী।” দিপুর ক্ষেত্রে শুধু মৃত্যু নয়—নৃশংসতা, পূর্বপ্রস্তুতি ও জনসমক্ষে প্রদর্শন যুক্ত হয়েছে। এতে ধারা ৩৪ (সাধারণ অভিপ্রায়) ও ধারা ১৪৯ (অবৈধ সমাবেশে সংঘটিত অপরাধ) প্রযোজ্য।
অর্থাৎ, যারা মারধর করেছে, যারা আগুন দিয়েছে, এমনকি যারা সমবেত হয়ে “পরিস্থিতি তৈরি” করেছে—সবার ওপরই সমান দায় বর্তায়।
২. ধর্ম অবমাননার অভিযোগ—আইনে প্রমাণ ছাড়া শাস্তি নেই
বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননা বিষয়ে প্রচলিত অভিযোগগুলো প্রায়শই দণ্ডবিধির ২৯৫ ও ২৯৫(ক) ধারা উদ্ধৃত করে উত্থাপন করা হয়। কিন্তু এই ধারাগুলোতেও স্পষ্টভাবে বলা আছে—
ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষমূলক উদ্দেশ্য প্রমাণ করতে হবে।
এখানে:
** কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য নেই
** কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্ট নেই
** কোনো লিখিত বা মৌখিক প্রমাণ নেই
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন নিজেই বলেছে—কিছু পাওয়া যায়নি।
অতএব, আইনগতভাবে এখানে কোনো অপরাধই প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবু শাস্তি কার্যকর হয়েছে—তা-ও মৃত্যুদণ্ড।
এটি আইনের শাসনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
৩. লিঞ্চিং—বাংলাদেশের আইনে সরাসরি নিষিদ্ধ
“মব জাস্টিস” বা গণপিটুনি বাংলাদেশের আইনে কোনোভাবেই বৈধ নয়। এটি একসঙ্গে কয়েকটি অপরাধ:
** অবৈধ সমাবেশ (দণ্ডবিধি ১৪১)
** দাঙ্গা (১৪৬)
** হত্যা (৩০২)
** মৃতদেহ অবমাননা (২৯৭)
** অগ্নিসংযোগ (৪৩৫)
এবং ভিডিও ধারণ করে যারা দাঁড়িয়ে থেকেছে—তারা ধারা ১০৭/১০৯ অনুযায়ী প্ররোচনার দায় এড়াতে পারে না।
৪. কারখানার ভূমিকা—অপরাধমূলক অবহেলা
যদি অভিযোগ অনুযায়ী ফ্লোর ম্যানেজার দিপুকে জনতার হাতে তুলে দিয়ে থাকে, তাহলে তা:
** অপরাধে সহায়তা (abetment) — দণ্ডবিধি ১০৭
** অবৈধ আটক ও হস্তান্তর
** শ্রমিকের নিরাপত্তা লঙ্ঘন
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী নিয়োগকর্তার দায়িত্ব—
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এখানে প্রতিষ্ঠান শুধু ব্যর্থ নয়—আইন ভেঙেছে।
৫. রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ব্যর্থতা
বাংলাদেশের সংবিধান:
** অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান
** অনুচ্ছেদ ৩১: জীবনের নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে
** অনুচ্ছেদ ৩২: জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার
দিপুর ক্ষেত্রে এই তিনটি অনুচ্ছেদই লঙ্ঘিত হয়েছে।
আরও গুরুতর বিষয়—ঘটনার পর রাষ্ট্রের নীরবতা। দিপুর পরিবারকে অবহিত না করা, নিরাপত্তা না দেওয়া, ক্ষতিপূরণ বা স্বীকৃতি না দেওয়া—এসবই রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রমাণ।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে Universal Declaration of Human Rights ও International Covenant on Civil and Political Rights-এর অংশীজন। সেখানে জীবন রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই ন্যস্ত।
৬. বিচার শুধু অপরাধীর নয়—ব্যবস্থারও
রাষ্ট্র বলছে, “দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে।” প্রশ্ন হলো—
** কত দ্রুত?
** কতজন?
** শুধু সরাসরি হত্যাকারী, নাকি উসকানিদাতা, হস্তান্তরকারী, নীরব দর্শকরাও?
কারণ বিচার যদি শুধু ঘটনার পরে আসে, আর প্রতিরোধ না হয়, তাহলে সেটি বিচার নয়—একটি প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
৭. আইনি সিদ্ধান্ত স্পষ্ট
আইনের ভাষায় এই ঘটনা:
** হত্যা
** গণহত্যার উপাদানযুক্ত লিঞ্চিং
** ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন
** রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়—এটি একটি সিস্টেমিক ক্রাইম।
উপসংহার
দিপুর পরিবার শুধু বিচার চায় না। তারা চায় রাষ্ট্র স্বীকার করুক—
দিপু নাগরিক ছিল। তার জীবন মূল্যবান ছিল।
আইনের চোখে দিপু অপরাধী নয়।
আইনের কাঠগড়ায় আজ দাঁড়ানোর কথা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



