somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাক বাবা-মা’র গল্প - A beautiful story

২০ শে আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়া একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনে পড়ে – “কোন পাখি বাসা বানাতে না পেরে পরের বাসায় ডিম পাড়ে?” উত্তর ছিল কোকিল। কাক খাবার সংগ্রহের পন্থায় প্রতিভাবান এবং প্রচেষ্টায় প্রাণান্তী। হেথা-সেথা থেকে দিনমান যুদ্ধ করে যোগাড় করে আনা খাবার সে পরম মমতায় সদ্য ফোটা ছানাগুলোর লাল লাল মুখে তুলে দিচ্ছে, তিন তলার জানালা দিয়ে এ দৃশ্য বহুবার দেখেছি। হয়তো তার মনে আশা ছিল এই ছানাগুলো বড় হলে উঁচু ইউক্যালিপ্টাস গাছ থেকে নেমে আসা বড় চিলটাকে সে আচ্ছা করে দাবড়ে দিতে পারবে, হয়তো ছিলনা। ছানাগুলো একটু বড় হল – কোকিলের ছানাটাকে কাক আরো বেশি করে আদর করে- দেখতে অন্যগুলোর থেকে ভাল, গলাটাও যেন একটু মিষ্টি শোনায়। আরেকটু বড় হয়ে সেই ছানাটা চলে গেল বসন্তের দেশ খুঁজতে। উড়ে যাওয়ার ধরণ দেখে কাক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো- এটাও কোকিল ছিল!

২.
আমার স্ত্রী গর্ভবতী। দিনের পর দিন বমি আর অসুস্থতা। মুখ কালো করে বিছানায় শুয়ে থাকা – পড়াশোনাটা যে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ওর কষ্ট দেখে অবাক হয়ে ভাবি – সব মা’ই কি এভাবে কষ্ট করে? আমার মা’কে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা আমি পেটে থাকতে কি আপনার এমন কষ্ট হয়েছিল?”
- “তুই পেটে থাকতে তো……”
গলার স্বর চোখের পানিতে স্তিমিত হয়ে আসে।
ননদ-দেবর পরিবেষ্টিত আর্থিক-পারিবারিক টানাপোড়েন আর মানসিক যন্ত্রণার সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়ায় নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাই, ঘর থেকে পালিয়ে বাঁচি।

আসলে সব মা’ই কি তাঁর সন্তানদের এভাবে ধারণ করেননি?

৩.
- “এটা তোর আর এটা তোর”
কলেজের কোন এক অনুষ্ঠানের খেতে দেয়া নাস্তার সিংগারা এখন আমার হাতে আর সন্দেশটা আমার ভাইয়ের। আনন্দে নাচতে নাচতে খাবারটা গলাঃধকরণ করে আমরা নিজ খেলায় মনোনিবেশ করলাম। জমে থাকা কাপড় ধুয়ে গোসল করে বেরিয়ে মা ঢুকে গেলেন রান্নাঘরে। সে নরক থেকে বেরিয়ে আমাদের পিছু নিলেন। আয় পড়তে বস।

আসলে সব মা’ই কি তাঁর সন্তানদের এভাবে লালন করেননি?

৪.
- “কাল থেকে ঘরে দুধ নেই, একটু দুধ এনে দিবি বাবা, এক কাপ চা খাব, মাথাটা খুব ধরেছে।“
- “কিন্তু মা, কাল যে আমার পরীক্ষা।“
- “তাহলে, থাক। ভাল করে পড়।”
দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দে জননীর দীর্ঘশ্বাসটা চাপা পড়ে যায়।

৫.
আমার ছোটবেলার এক বন্ধু ফেসবুকে ওর স্বস্ত্রীক ছবি দিয়েছে। দেখে ভালোই লাগল। বসন্তের দেশে বোধকরি মানুষের চেহারায় আলাদা একটা জেল্লা আসে। সুখে থাকার জেল্লা। পঁচা দেশের মাটি-পানি-বাতাস থেকে মুক্তির জেল্লা। ওর মা’কে আমি চিনতাম। তাঁর মাথার চুল কখনো দেখা যায়নি। তিনি তখন হয়ত ভাবেননি তাঁর ছেলে এমন আধুনিক বউ পাবে। বোধহয় বসন্তের দেশ তাকে হাতছানি দেয়নি।

আমার অনেকগুলো বন্ধু এখন বসন্তের দেশগুলোতে থাকে। তাদের প্রৌঢ় বাবা-মা একাকি থাকেন এই পঁচা দেশে। কিংবা বাড়িতে গেলে বা চলতি পথে দেখা হলে এক অদ্ভুত কাতরতা নিয়ে বলেন – বাবা বাসায় এসো, ও তো নেই, তোমরা আস্‌লে খুব ভালো লাগে। আমি বলি “ওকে দেশে আসতে বলেন না কেন?”
- “না না দরকার নেই, যেমন আছে ভালো আছে, ও ভালো থাকুক।”
মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি লুকান।

হসপিটালের গেটে দাঁড়িয়ে এক বাবা দেখেন ছেঁড়া লুঙ্গি পড়া এক বৃদ্ধ তাঁর ছেলের রিক্সা থেকে নামল, তারপর ছেলের কাঁধে ভর করে ধীর পায়ে হসপিটালের দিকে আগাতে লাগল। উনার গলার কাছে কি যেন দলা পাকায় উঠল – আজ আমাকে হাসপাতালে আনার লোক খুঁজে পেতে আধঘন্টা ফোন করতে হয়েছে, অন্যের ছেলে অফিস ফেলে আমাকে দয়া করে নিয়ে এসেছে। আর আমার ছেলেটা… অভিমান আর সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্খা দ্বন্দ্ব করে গলার দলাটা আরো মোটা করে ফেলে।

৬.
রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সবচেয়ে বড় গুনাহ কি?
তিনি বললেন – “আল্লাহর সাথে শিরক”। তারপর?

- “পিতামাতার অবাধ্য হওয়া”

আল্লাহ নির্দেশ দিলেন তোমার পিতা মাতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হবে তখন তাদের কোন কথা বা কাজে বিরক্ত হলেও “উফ” শব্দটি পর্যন্ত করোনা।

যত বড় বড় পাপ আছে সবগুলোর শাস্তি পরকালে হবে। একটা বড় পাপ আছে যার শাস্তি পরকালে তো হবেই, ইহকালেও হবে – তা হলো বাবা-মার প্রতি অপরাধের শাস্তি। কেউ যদি নিজের বাবা-মা’ কে কষ্ট দেয় তবে আল্লাহ ও তাকে সেই কষ্টের স্বাদ পৃথিবীতে দিয়ে তারপর তুলে নিবেন। এর কোন মাফ নেই, অবধারিতভাবে দিবেন, নিশ্চয়ই দিবেন।

বসন্তের দেশগুলোতে থাকা মানুষগুলো হয়ত ভাবে, আমি আমার বাবা-মা’র আদেশের আওতায় নেই, অবাধ্য হওয়ারও তাই আর প্রশ্ন আসেনা

তথাস্তু কোকিল ছানা, তোমার বিচার আল্লাহ করবেন।

৭.
- এই পোড়ার দেশে থেকে আমি কি করব?
- আমি যা নিয়ে পড়াশোনা করেছি তার কোন প্রয়োগ আমার দেশে নেই।
- আমার দেশে সৎভাবে বেঁচে থাকা যায়না।
- আমার দেশের সরকার নষ্ট, সিস্টেম নষ্ট।
- আমার দেশে হালাল কামাই দিয়ে স্বচ্ছলভাবে বেঁচে থাকা যায়না।
- আমি যেখানে আছি সেখানে ইসলাম পালনের স্বাধীনতা আছে। আমার দেশে নেই।
- দেশে কামলা খাটলে মানুষ কি বলবে, তার চেয়ে এখানেই কামলা খাটি।
- এখানে লাইফটাকে অনেক এনজয় করা যায়, আমার দেশে যায়না।
- কেন আমি তো দেশে টাকা পাঠাই, প্রতিদিন ফোনে কথা বলি।
- যারা দেশে বাবা-মা’র সাথে আছে তাদের চেয়ে আমি ছেলের দায়িত্ব বেশি পালন করি।

এরকম আরো বহু কথা শুনেছি, বহুবার শুনেছি – আমার প্রিয় বন্ধুদের মুখে, বড় ভাইদের মুখে শুনেছি। দুঃখজনক হলেও বেশিভাগ কথাই সত্য। কিন্তু তারপরেও কেন যেন বারবার মনে হয়েছে কথাগুলো নিজেদের প্রবোধ দেয়ার জন্য বলা। অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাড়াবার অনিচ্ছা থেকে বলা। মুসলিম হয়েও এই জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার ছল থেকে বলা।

আমার আল্লাহর রসুলের সেই সাহাবির কথা মনে পড়ে যায় যিনি পুর্ণ থালা খাবার দেখে আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন, “হে আল্লাহ, সব নিয়ামত কি এই পৃথিবীতেই দিয়ে দিবা, আখিরাতে কি তবে আমি নিঃস্ব হব?”

আমার রসুলুল্লাহর (সাঃ) এর কথা মনে পড়ে যায়। যিনি বাদশাহ রসুল হবার প্রস্তাব ঘুরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন আমি নিঃস্ব রসুল হব। একদিন খাব, খেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা করব। অন্যদিন না খেয়ে থাকব, না খেয়ে ধৈর্য ধারণ করব।

আমি বিদেশে থাকবার বিরোধিতা করছিনা, বাবা-মা’কে অবহেলা করবার বিরোধিতা করছি। নিজের সুখকে পিতামাতার সুখের চেয়ে বেশি মূল্য দেবার বিরোধিতা করছি। পৃথিবীর মোহে পরকাল ভুলে থাকবার প্রবণতাকে বিরোধিতা করছি।

আমার একটা সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট নাইবা থাকল। নাইবা থাকল একটা গাড়ি, একটা ৫২’ এলসিডি টিভি। আমার বাবার মনের ভিতরের দু’আটা থাক আমার সাথে। আমার মা’র ভালোবাসাটা থাক। বয়ষ্ক বাবা-মা’ কে পেয়েও যে তাদের সেবা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি নিতে পারলোনা সে হতভাগা। আমি সে হতভাগা হতে চাইনা। আমি ত্রিমাত্রিক থিয়েটারে মুভি দেখলামনা, লেটেস্ট গেম খেললামনা, রুনির গোল দেয়া দেখলামনা – কি আসে যায়? আমি স্কটিশ উপকূল দেখলামনা, ছবির মত শহর ভ্যাঙ্কুভার দেখলামনা, দেখলামনা গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ – কি আসে যায়? আমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেলে এগুলো সবি পাব, বহু গুণে পাব। আমি আমার এই দুনিয়ার বিনিময়ে পরকাল কিনতে চাই। আমি পৃথিবীতে কষ্ট করে থেকে, মুখ বুঁজে বাবা-মা’র সেবা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে চাই। আল্লাহ তোমার দোহাই, বসন্তের দেশের নেশা যেন আমার চোখে না লাগে, আমি যেন কোকিল ছানা না হয়ে যাই। তুমি আমাকে রক্ষা করো, প্লিজ।

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×