somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেহুলা (১)

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



( প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানো :

মাথার উপরে আকাশ, আর পায়ের তলায় সমুদ্র। এই নিয়ে বেহুলার এই পথ চলা। কিন্তু এই পথ চলা আজ থেকে নয়। মধ্যযুগের সূচনা পর্ব থেকেই আমরা এই কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত। যদিও লিখিত নিদর্শন এই পর্বেই মেলে তবে অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয় আরো অনেক আগে থেকেই মৌখিক ভাবে এই কাহিনী প্রচলিত ছিল। মনসামঙ্গলের প্রখ্যাত কবি বিজয়গুপ্তের কাছ থেকে আমার জানতে পারি কানা হরিদত্ত প্রথম মনসামঙ্গলের গীত রচনা করেন । তারপর কত প্রখ্যাত-অখ্যাত কবি সেই ধারাভাষ্য বহন করেছেন। আর আবেগপ্রবণ বাঙালি চোখের জলে ভেসেছে যতটা না মনসার ভয়ে তার চেয়ে বেশি বিবাহবাসরে সদ্য বিধবা ভাগ্য লাঞ্ছিতা বেহুলার জন্যে। যার জীবনটাই স্বপ্ন দেখার সূচনা হবার পূর্বেই স্বপ্ন ভঙ্গের। সীতার নাম রাখলে নাকি সে চিরদুঃখী হয় বলে শুনেছি। তবু ‘সীতা’ নাম আমার চোখে পড়েছে। আমার পরিচিত জগতে আমি ‘চাঁদ’ নাম দেখেছি, এমনকি মনসার নামেও নাম থাকতে দেখেছি , কিন্তু কাউকে বেহুলার নামে নাম রাখতে আজ পর্যন্ত দেখি নি। অথচ সেই অতি সাধারণ মেয়েটিই আমাদের মনের অন্তঃকোণে সগর্বে জায়গা করে নিয়েছে। এক হিসাবে সাবিত্রি সঙ্গে বেহুলার তুলনা চলে। দুজনেই স্বামীর জীবন ফিরিয়ে এনেছে। তবু যেন সাবিত্রির সঙ্গে বেহুলার তুলনা চলে না। সাবিত্রির দিকে চাইলে আমি স্বামী গরবে গরবিণী এক উজ্জ্বল মুখ দেখতে পাই। কিন্তু বেহুলার দিকে চাইলে যে মেয়েটির মুখ আমার চোখে পড়ে সেই মেয়েটির চোখ জলে ঝাঁপসা হয়ে গেছে। তবে কি এই মেয়েটি কোনো একটা দিকে জীবনে স্বামীর থেকেও একলা হয়ে গেছে ? কেন মাত্র একদিনের বিবাহিত জীবনের ভার এতদিন তাকে বহন করতে হল ? সেটা কি শুধু সে সতী সাধ্যি সেটা প্রমাণ করার জন্যেই ? নাকি তার নারীত্বের অপমানের অবসানের জন্যে। একজন নারীর কাছে স্বামীকে হারিয়ে ফেলা কিম্বা স্বামীর অধিকার হারিয়ে ফেলা- দুটোই নারীত্বের চরম অবমাননাকর। মনের মধ্যে জেগে ওঠা এই প্রশ্নের জায়গা থেকে বেহুলাকে বুঝতে চেয়েছি, খুঁজতে চেয়েছি।

আরো একটা বিষয় মনের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে। চাঁদ সদাগর একজন বণিক অর্থাৎ ব্যবসায়ী। ঐ অঞ্চলের তিনি অলিখিত প্রচণ্ড ক্ষমতার অধীশ্বর। ব্যবসায়িক বুদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক বুদ্ধিরও অধিকারী। তিনি কী করে একা একটি অবলা মেয়েকে বিপদের মুখে ভাসিয়ে দেবেন। না কি পুরো পথটাতেই তার অদৃশ্য চোখ পুত্রবধূ বেহুলাকে পাহারা দিয়েছে। রাজনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে মনসাকে আপাতভাবে জিতিয়ে দিয়ে চরম বিজয়টা চাঁদেরই হয়েছে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজতে চেষ্টা করেছি এই লেখায়। আমার এই দেখার চোখ সবার পছন্দ নাই হতে পারে তবু আমি নিরুপায়।)





নৌকার মাঝিরা বেশ উদগ্রীব হয়ে উঠল। লক্ষণ ভালো নয়। ঝড় হয়তো বেশ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই বিশাল দরিয়ায় এই ছোট্ট নৌকার বুকে। মাঝিরা জানে পুবে মেঘ হলে সেটা ততটা ভয়ের নয়। সেটা আরো পুবেই চলে যাবে। কিন্তু পশ্চিমের মেঘ সরে আসে পুবের দিকে। পশ্চিমের মেঘ সরতে সরতে এগিয়েও আসছিল তাদের দিকে। মাঝিরা এমন বিপদের মাঝে আজ প্রথম পড়েছে এমন নয়। তারা এর সঙ্গে অভ্যস্ত। কিন্তু মৃত্যু ভয় কার নেই!


নৌকাতে সব মিলিয়ে সাতজন মানুষ। একজন নারী, বাকিরা পুরুষ। এই নৌকার দায়িত্ব গগনের উপরে। সে মধ্য বয়স্ক। মাথার দু একটা চুলে পাক ধরেছে বটে কিন্তু শরীর তার বয়সের কথা বলে না। কালো পেটানো শরীর। যখন সে দুই হাতে নৌকার দাঁড় ধরে শরীরের পেশিগুলো এমন ভাবে খেলা করে তার শরীরে যেন গাঙে বান এসেছে। মেয়েরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার শরীরের দিকে। মনমরা হয়ে যায়। হয়তো এই পুরুষের কথা ভেবে। হয়তো তার পুরুষের জায়গায় এই মানুষটিকে বসায়। রাতের অসমাপ্ত রতির আনন্দ খোঁজে মনে মনে। আর পুরুষরা তাকে দেখে ঈর্ষাণ্বিত হয়। ভগবান তাদেরকে কেন এই শরীর দিলেন না। যাকে দিলেন তারতো এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। হয়তো সে কারণেই সাধু তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। ছেলের বৌকে রক্ষার জন্যে।

গগনের মন শিশুর মতন। শিশু যেমন শরীরের কিছু অঙ্গ সম্পর্কে অসচেতন, গগনও তাই। সে যে একজন পুরুষ মানুষ নৌকার অন্য মাঝিরা সেটা বুঝতেই পারে না। কিন্তু কাজের বেলায় তার মতো কঠোর আর কেউ নয়। অকথ্য গালিগালাজ যেমন সে দিতে পারে তেমন প্রয়োজনে মাথায় হাত বুলিয়ে কাজ করিয়ে নিতেও তার জুড়ি নেই। তার মধ্যে যেন দ্বিতীয় সাধুকে দেখতে পায় নৌকার মাঝিরা। এ নিয়ে একটু কানাঘুষোও আছে। যদিও মুখে বলার সাহস নেই কারও।

বেশির ভাগ সময়েই গগন নৌকার দাঁড় ধরে না। প্রয়োজন হলে সে দাঁড় টানা কেন নৌকার যাবতীয় কাজই করতে পারে। তবে আজ আকাশের হাল খুব সুবিধার নয় বুঝতে পেরে সে হাল ধ’রে মাঝিদের নির্দেশ দিচ্ছিল- এই নারানোর পো, উপরে উঠে পালটা খুলে দে।

নারানের পো মুহূর্তে মাস্তুল বেয়ে উঠে পালের রশি খুলতে লেগে গেল। দায় যত না গগনের, তারও দায় কম কিছু না। ঝড় এলে নৌকা পালটি খাবার বড় কারণ এই পাল। ঘরেতো তার পরিবার রয়েছে। অনেক দিন বাঁচার স্বপ্ন দেখে সে। এতো তাড়াতাড়ি মরার সাধও তার নেই। এছাড়া গগনের হুকুম তামিল করতে অভ্যস্ত তারা। গগনের মুখ ও শরীররের সঙ্গে পেরে ওঠার সামর্থ্য এদের কারোর নেই। কঠোর এই মানুষটার ভিতরে একটা শিশু সুলভ প্রগাঢ় ভালোবাসা এদের সবাইকে কী ভাবে রক্ষা করে সমস্ত বিপদের হাত থেকে তা এরা সবাই জানে। তাই হাজার গালাগাল খেলেও এরা প্রত্যেকেই ভীষণ অনুগত। সেই কারণেই বেছে বেছে সাধু এদেরকে এই নৌকায় পঠিয়েছেন।

গগন উঁচু গলায় চিৎকার করে- খবরদার । তোদের কাউকে আমি যেন আমার পাশে দেখতে না পাই। একটু আবডাল নিয়ে প্রত্যেকে বসে থাক। ঝড় যেন তোদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে না পারে। নৌকা আমি দেখছি। আমি যতক্ষণ আছি নৌকা আমি ডুবতে কিছুতেই দেব না।

গবা এগিয়ে গেল গগনের দিকে।বলে-আমি তোমার সাথে থাকি। তেমন হলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব।

ভগবানের পুত এসছেন আমাকে সাহায্য করতে। বগবান গোবিন্দ। যা যা আমার কাজে ব্যাগড়া দিতে আসিস না- চিৎকার করে ওঠে গগন।

গবা ব্যাজার মুখে অন্য মাঝিদের কাছে ফিরে যায়। গগন আকশের কালো মেঘগুলোকে যেন মাপতে থাকে। কাঁধে তার গুরু দায়িত্ব। নৌকা কিছুতেই ডুবতে দেওয়া যাবে না। চ্যাঙমুড়ি কানি হাজার ষড়যন্ত্র করলেও নয়।


গগন দা।

মুহূর্তে অন্যমনা গগন বাস্তবে ফিরে আসে। পাশে তাকাতেই তার মনে হয় আকাশের কালো মেঘ সরে গিয়ে সূর্যদেব উঁকি দিয়েছেন আকাশে।নৌকা ভরে গিয়েছে আলোয়।বেহুলার উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের উজ্জ্বল উপস্থিতি যেন সেটা সম্ভব করছে। গগনের চোখে জল চিকচিক করে ওঠে। ভগবান কেন এই ছোট্ট মেয়ে টাকে এত কষ্ট দিলেন।

গগন উত্তর দেয় -বলো বুনডি।

আমরা তোমার পাশে থাকি। মনে হয় খুব একটা ঝড় আসছে- ঠাণ্ডা গলায় কথা বলে বেহুলা। কোনোরকম উত্তেজনা, ভয় তার ভিতরে ছাপ ফেলতে পারেনি। বেহুলার বুকের কষ্টটা গগনর বুকে মোচড় মেরে ওঠে।
অন্য সকলের সাথে অমার্জিত কথা বললেও বেহুলার সাথে সবসময় খুবই মার্জিত কথা বলে গগন -বুনডি, তুমি এই বজরার ভিতরে যাও। তুমি কিচ্ছুটি চিন্তা কোরো না। আমি যখন এই হাল হাতে নিয়েছি বজরা ডুবতে আমি দেব না।

অজান্তেই কোন এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যায় বেহুলার ভেতর থেকে। গগনের দৃষ্টি এড়ায় না সেই দীর্ঘশ্বাস। বেহুলা ফিরে যায় বজরার ভিতরে।

গগনের মনে হয় যেন সেই দীর্ঘশ্বাস নৌকা থেকে পাক খেয়ে আকাশে উঠে আবার ফিরে আসে এই দরিয়ার বুকে ছোট্ট এই নৌকাতে। আকাশ থেকে কালো মেঘের সাথে প্রচণ্ড দমকা হাওয়া আছড়ে পড়ে দরিয়ায়। প্রচণ্ড এক যন্ত্রনায় মুচড়ে উঠে কাত হয়ে যায় নৌকা।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:৫৩
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×