১৯৯৯ সালে বিখ্যাত নোয়াখালীর বিখ্যাত "আমির কম্পিউটার কমপ্লেক্স" এ ইনস্টাকটর জুয়েল ভাইয়ের হাত ধরে আমার কম্পিউটারের হাতেখড়ি। যদিও উইন্ডোজ ৯৭ এবং মাইক্রোসফট অফিস শেখার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম; তবে উইন্ডোজ এর পর মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এ এসে থেমে গিয়েছিলাম।
থেমে গিয়েছিলাম বলতে... জনাব মোস্তাফা জাব্বার তখন "আনন্দ মাল্টিমিডিয়া" এর শাখা নোয়াখালীতে চালুর উদ্দেশ্যে ডানিডা মিলনায়তনে একটি সেমিনার করেন। এবং সেখানে তিনি ২ডি এনিমেশ্যান কিভাবে হয় তার একটি ডেমো প্রেজেন্টেশান দিলেন।
আমার মাথায় তখন ওয়ার্ড এ্যাক্সেল ছেড়ে এনিমেশ্যান এর ভুত চাপলো।
২০০০ সালে ঢাকা রওয়ানা হলাম। তার আগে মাসখানেক প্রথম আলো থেকে বিভিন্ন ডিজাইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা জোগাড় করলাম।
প্রথমে গেলাম জনাব মোস্তাফা জাব্বারের সেগুন বাগিচার আনন্দ কম্পিউটার্স এ। ওখানে ক্লাস রুম আমার পছন্দ হলোনা। লম্বা একটা ক্লাস রুমের দুই পাশে দেয়ালের দিকে মুখ করা টেবিলে লাইনে কিছু কম্পিউটার লাগানো।
গেলাম সুবাস্তু নজর ভ্যালির ৭ম তলায় একটি প্রতিষ্ঠানে। তাদের অফিস খুব পরিফাটি। কিন্তু শুধুমাত্র উইন্ডোজ অপারেটিং শিখাতে তাদের ফি ৩২ হাজার টাকা! এরিনা, এনআইআইটি তে গেলাম। ওদের ও শুধু শো-অফ। কোর্স ফি অনেক অনেক বেশি।
শেষে ধানমন্ডি ৮/এ তে ভিকারুননেসার পাশের বিল্ডিং এ "হাইটেক প্রফেশন্যালস্" এ গেলাম। রিসিপশনে বসতেন "জেসমিন" নামের মোটাসোটা হাস্যজ্জল একজন মহিলা।
তাদের প্রতিষ্ঠান এবং কোর্স ফি সহ সবকিছু আমার পছন্দ হলো।
বাড়ী ফিরে এসে কিছুদিন পর আমার ছোট কাকাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে স্থায়ী হবার চিন্তায় রওয়ানা হলাম। আমাদের এলাকার ২ জন বড়ভাই তখন এরিনা মাল্টিমিডিয়াতে ই-কমার্স নিয়ে পড়ছেন। কাকা প্রথমে যাত্রাবাড়ী তাদের মেসে গিয়ে উঠলেন খোঁজ খবর নিতে - আমি যে কোর্স করতে চাচ্ছি তার ভবিষ্যৎ কি? তারা অবশ্য কাকাকে বারবার মানা করছিলেন গ্রাফিক্স তথা মাল্টিমিডিয়ার চেয়ে ই-কমার্স এর ফিউচার ব্রাইট। কিন্তু আমার মাথায়তো এনিমেশ্যানের ভূত!
পরে হাইটেকে ভর্তি হলাম "ডিপ্লমা ইন মাল্টিমিডিয়া"। আমার কাছে শুরু থেকেই অসাধারন ভালো লাগা শুরু হলো। ক্লাসে কিছু মেট-দের কথা মনে পড়ে। এর মধ্যে সবছে বেশি এখনো হাসি আসে যে ছেলেটির কথা মনে পড়লে সে আসতো শনির আখড়া থেকে। প্রথম দিন থেকেই তার মাথায় কিচ্ছু ডুকেনা। শুধু প্রশ্ন করে। শেষমেষ ছেলেটি ১০ দিনের মাথায় রণে ভঙ্গ দিলো।
দুইজন মানুষ আমার লাইফ বদলে দিলেন। তারমধ্যে প্রধান @মামুন ভাই। আমি যতদিন বঁেচে থাকবো মামুন ভাই, ভাবি এবং উনার ফ্যামিলির জন্য রুহ থেকে দোয়া আসবে। আমি এখন পর্যন্ত আমার সকল পরিচিত জনদের কাছে উনাদের বদান্যতার কথা গর্বভরে প্রকাশ করি। মামুন ভাই না থাকলে হয়তো আমি আজ ডিজাইনার না হয়ে অন্য কোন ছোটখাটো চাকুরী করে কোন রকম জীবনযাপন করতাম।
মামুন ভাই এর সাথে পরিচয় এবং উনার সহযোগীতার কিছু নমুনা।
আমার বাসা শ্যামলী। ক্লাস শেষে কলাবাগান পর্যন্ত হেটে এসে বাসে করে শ্যমলী হলের সামনে নামতাম। ২/৪ দিন ক্লাস করার পর একদিন আমি বাসের ভিতর পাইপ ধরে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছি। ট্রাফিক জ্যামে আমার বাসের পাশে পাশে যাচ্ছিলেন মামুন ভাই এর গাড়ী। আমি যথাসম্ভব মুখ লুকানোর চেষ্টা করলাম - তিনি আমাকে তবুও দেখে ফেললেন। পরদিন ক্লাসে আসার পর মামুন ভাই আমার সাথে পরিচিত হলেন।
জিজ্ঞেস করলেন "তুমি কি মিরপুর এর দিকে থাকো?"
আমি জবাব দিলাম না শ্যামলী।
আমিওতো শ্যামলী থাকি - পিসি কালচার হাউজিং। আজকে ক্লাস শেষে তুমি আমার সাথে যেতে পারো।
ক্লাস শেষে উনি যখন নিচে গেলেন তখন আমি উপরে বসে রইলাম। খেয়াল হলো উনাদের গাড়ী অনেক দুরে যাবার পর আমি গিয়ে বাসে উঠবো তখন আর উনি আমাকে রাস্তায় দেখবেন না।
তারপরদিন ক্লাসে এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন "কাল আমরা তোমার জন্য নিচে অপেক্ষা করছিলাম; তুমি আসলে না যে?"
এরপর থেকে উনার সাথে উনার গাড়ীতে বাসায় যেতাম।
৩/৪ মাস ক্লাস শেষ। আমার ঘরে কম্পিউটার নেই। আমি হাইটেকের ল্যাবে প্রজেক্ট করে আসি আর পরদিন দেখি কেউ আমার প্রজেক্ট ডিলিট করে দিয়েছে। মাথায় হাত! মামুন ভাই এ সময় আবারো আমার জন্য অকুল সাগরে কান্ডারী হলেন। তিনি বললেন তুমি আমার ঘরে এসে প্রাকটিস করতে পারো।
আমি উনাদের বাসায় যাব - বাসায় উনার দুই ছেলে মেয়ে উৎসবের আমেজ তৈরি করেছিলো যেন! তখন অজয় দেবগন আর কাজল অভিনিত হিন্দি ছবি "রাজু চাচা" এর প্রমো টিভিতে আসছিলো। একটা গান ছিলো "রাজু চাচা, রাজু চাচা, কাম, কাম, কাম..." ছোট্র মৌমিতা-রাফিদ ধরে নিয়েছিলো আমিই টিভির সেই রাজু চাচা - তাদের ঘরে মেহমান হয়ে যাচ্ছি!
এভাবে ২/৩ বছর উনার ঘরে আসা-যাওয়া কিভাবে যে মামুন ভাইয়ের ঘরের সদস্য এর মত ছিলাম টেরই পাইনি। ভাবীর হাতের বানানো "বসনিয়ান রুটি" আমি আজ পর্যন্ত আর কোথাও দেখিনি - খেতে পারিনি.. স্যরি ভাবী; আমি আপনাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তবে আপনাদের ঘরের প্রত্যেকটি দিন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি।
মামুন ভাই আমাকে এতটাই আপন ভাবতেন - উনার বোনের ছেলের বিয়েতে আমাকে গাজীপুর বিরি'তে নিতে ভুলেন নি।
অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ - মামুন ভাই।
২য় যে পরিবারটি আমার জীবন ধন্য করেছেন তিনি ছিলেন "রক্তিম বড়ুয়া"। ঢাকায় সপ্তাহের প্রায় ৩ দিন মামুন ভাইর বাসায় এবং ২ দিন রক্তিম ভাইর বাসায় কাটতো। রক্তিম দা থাকতেন মিরপুর ১ এ। প্রায়শঃ শুক্রবারে যাওয়া হতো উনাদের বাসায়। উদ্দেশ্য রক্তিম দা এর সাথে ক্লাসের টাস্কগুলো শেষ করা। মজার বিষয় ছিলো আমি যেদিন-ই যেতাম ভাবি শুটকির একটা তরকারী রাখতেন। আমি তত আগ্রহ দেখাতাম না - উনারা চট্রগ্রামের মানুষ। ভাবী কার কাছ থেকে শুনেছেন "নোয়াখালীর মানুষ শুটকি পছন্দ করে"। সেজন্য স্পেশ্যালী আমার জন্য শুটকি তরকারী রান্না হতো। কিন্তু যখন শুনলেন আমি শুটকি তেমন পছন্দ করিনা - উনি হাসতে হাসতে শেষ! বললেন "তোমার জন্য এতদিন শুটকি রান্নাকরি - তুমিযে পছন্দ করনা তা আগে বলনি কেনো?"
অংকিতা প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিলো উনাদের পরিবারের উৎসবের আমেজ এখনো আমার মনে পড়ে।
মামুন ভাই আর রক্তিম দা এর সাথে স্মরনীয় দিনগুলোর মাঝে একটা বিষয় এখনো আমার মনে পড়ে এবং খুব হাসি।
আমরা তিন জন মিলে ম্যাক্রোমিডিয়া ডিরেক্টর দিয়ে একটা ২ডি মুভি বানালাম। একটা কুকুর ডান থেকে দৌড়া দৌড়ি করবে... সব ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড ইফেক্ট জোগাড় হলো; কিন্তু কুকুরের গেউ গেউ শব্দ কোথাও পাইনা। রক্তিম দা তখন বললেন আমার শব্দ রেকর্ড করো। পরে উনি ঘেউ ঘেউ সাউন্ড দিলেন। রেকর্ড শেষে মুভিতে যখন লাগিয়েছি তখন আমরা নিজেরাই বুঝতে পারছিলাম না এটা রক্তিম দা'র করা ফেইক সাউন্ড!
রাফিদ মাশাআল্লাহ খুব ছোট বেলায় অনেক বুদ্ধিমান ছিলো। মামুন ভাই তাকে কোলে নিয়ে কম্পিউটারে কিছু করতে হাত দিয়ে তার চোখ ঢেকে রাখতো, আর রাফিদ শুধু উনার হাত সরাতে চাইতো - কারন সে যা যা দেখতো আইকন খুজে খুজে সেটা করে ফেলতো। মামুন ভাই এর ভয় ছিলো ও উইন্ডোজ এর কোন ফাইল ডিলিট করে ফেলে কিনা ভুলে...
ডিপ্লোমা শেষে কিছুদিন দেশে চাকুরী করলাম আমার এক চাচার প্রাইভেট ফার্মে। পরবর্তীতে বাবার রেফারেন্সে সৌদি আরব এসে পৌঁছালাম। কয়েক মাস এদিক সেদিক অড জব শেষে চাকুরী মিললো "গ্লোবাল এ্যাডভারটাইজিং এজেন্সি নামের এক বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। চাকুরীতে জয়েন করতে গিয়ে আমার জীবনের ভয়ংকর ভয়গুলোর একটা এখানে সংঘটিত হলো। বাংলাদেশে পড়াশুনার সময় #ম্যাক কম্পিউটারের চেহারাও দেখানো হয়নি আমাদের। আমি একবার পাটুয়াটুলী ক্যাসেট কিনতে গিয়ে এক দোকানের কাচের জানালা দিয়ে ম্যাক কম্পিউটার দেখে ভিতরে ঢুকে একনজর দেখেছিলাম - ব্যাস ম্যাকের সাথে আমার পরিচয় এতটুকু। আরেকটা ছিলো - দেশে আমাদেরকে পড়ানো হয়েছিলো "কোরাল ড্র" আর সৌদি আরবে এডবি ইলাষ্ট্রেটর ছাড়া অন্য কিছু (ব্যানার প্রিন্ট কোম্পানীগুলো ছাড়া) চলেনা :/
যাই হোক আমি চালাকি করে এমন একটা ভান করলাম যেন আমার জন্য এটা কোন সমস্যাই না!
তো আমার ডেস্কের পাশেই ছিলো ফিলিপিনো নাগরিক ব্রায়ান এর ডেস্ক। সে এতটাই পাক্কা ডিজাইনার ছিলো যে ফটোশপে করা ৩ডি যেন ৩ডি ম্যাক্সকে ফেল মারতো। আমি তার কাছ থেকে দেখে দেখে ইলাষ্ট্রেটর এবং ম্যাক কম্পিউটার ব্যাবহার শিখলাম (এডবি ফটোশপ জানতাম - তাই ইলাষ্ট্রেটর কঠিন মনে হয়নি)। ব্যাস্ এভাবেই আমি হয়ে গেলাম একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে (:ডি) কাজ করা ডিগাইনার!!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:১৯