বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। নামটি দিয়েছে পাকিস্তান। ঘূর্ণিঝড়ের নাম করণের পদ্ধতির ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে ঘূর্ণিঝড়ের নাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। গত কয়েকশো বছর ধরে আটলান্টিক মহাসাগর এলাকায় উৎপন্ন হওয়া ঝড়গুলোর নাম দেওয়া হচ্ছে। শুরুতে নিজেদের অঞ্চলের ঝড়গুলোকে বিভিন্ন নামে ডাকত ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের মানুষেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বদলায়নি। তবে ১৯৪৫ সাল থেকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে শুরু হয় সাইক্লোন-টাইফুন ও হারিকেন তথা ঝড়ের আনুষ্ঠানিক নামকরণ।

সাইক্লোন-টাইফুন ও হারিকেন কী?
সাইক্লোন, টাইফুন, হারিকেন-শুনতে তিনটি পৃথক ঝড়ের নাম মনে হলেও আসলে এগুলো অঞ্চলভেদে ঘূর্ণিঝড়েই ভিন্ন ভিন্ন নাম। সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড়কে সাইক্লোন বা ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বলা হয়। সাইক্লোন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ কাইক্লোস থেকে, যার অর্থ বৃত্ত বা চাকা।
ভারত মহাসাগরে উৎপন্ন ঝড়গুলোকে সাইক্লোন বলা হয়। আটলান্টিক মহাসাগর এলাকা তথা যুক্তরাষ্ট্রের আশেপাশে ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ যখন ঘন্টায় ৭৪ মাইল এর বেশি হয়, তখন জনগণকে এর ভয়াবহতা বুঝাতে হারিকেন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মায়াদেবতা হুরাকান- যাকে বলা হত ঝড়ের দেবতা, তার নাম থেকেই হারিকেন শব্দটি এসেছে। তেমনিভাবে, প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা তথা চীন, জাপানের আশেপাশে হারিকেন- এর পরিবর্তে টাইফুন শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
নামকরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব ও ঐকমত্য
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়াবিদরা গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিতে শুরু করেন মেয়েদের নামে। এ নিয়ে নারীবাদীদের তুমুল সমালোচনা শুরু হলে পরে আবহাওয়াবিদরা বর্ণমালার ক্রমিক অনুযায়ী ঝড়ের নাম দেওয়া শুরু করেন। ১৯ শতকের শেষের দিকে দক্ষিণ গোলার্ধের আবহাওয়াবিদরা পুরুষের নাম দেয়া শুরু করে।
২০০০ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সভায় আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের সাইক্লোনের নামকরণ নিয়ে একটি ঐকমত্য হয়। সদস্য দেশগুলোর দাবির মুখে ২০০৪ সাল থেকে আমাদের এ অঞ্চলে ঝড়ের নাম দেওয়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত একটি নামের তালিকা থেকে একেকটি ঝড়ের নাম দেওয়া হয়। কোনও ঝড়ের গতিবেগ যদি ঘণ্টায় ৩৯ মাইল হয়, তাহলে তাকে একটি নাম দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া অফিসগুলো এই নামকরণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়ার কারণও বেশ সহজ। এগুলোর এমন নাম দেয়া হয় যেন বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষ সহজে মনে রাখতে পারে।

নামকরণ করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার অধীনে বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটি। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডড়ৎষফ গবঃবড়ৎড়ষড়মরপধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ) এই আঞ্চলিক কমিটি তৈরি করে সমুদ্রের ওপর ভিত্তি করে। যেমন, উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সব ঝড়ের নামকরণ করবে ডগঙ-এর ৮টি সদস্য রাষ্ট্র: বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড এবং ওমান। এদের একত্রে ‘স্কেপে’ বলা হয়। আঞ্চলিক এই আটটি দেশ একেকবারে আটটি করে ঝড়ের নাম প্রস্তাব করে। প্রথম দফায় মোট ৬৪টি নাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেমন কিছুদিন আগের ঘূর্নিঝড় ‘ফনি’ নামটি বাংলাদেশের দেয়া।এরপরের ঝড়ের নাম করণ করে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘ভায়ু’। আর এখন চলছে পাকিস্তানের দেয়া নাম, বুলবুল। বুলবুলের পর আসছে পাউয়ান বা পবন এবং আম্ফান।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার বৈঠকে বাংলাদেশের এক বা একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অংশ নিয়ে থাকেন। আগে থেকে তারা আলোচনা করে নেন যে, কী নাম হবে।’
তিনি আরো বলেন, বলেন, ঝড়ের নাম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়, যাতে সেটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা সামাজিকভাবে কোনোরকম বিতর্ক বা ক্ষোভ তৈরি না করে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে একটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয়েছিল ‘মহাসেন’। নামটি প্রস্তাব করেছিল শ্রীলঙ্কাই। কিন্তু সেখানকার সাবেক একজন রাজার নাম ছিল ‘মহাসেন’, যিনি ওই দ্বীপে সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিলেন। ফলে এ নিয়ে ক্ষব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এমনকি শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যমে সেটিকে ‘নামহীন ঝড়’ বলে বর্ণনা করা হয়। পরবর্তীতে রেকর্ডপত্রে ঝড়টির নতুন নাম নির্ধারণ করা হয় ‘ভিয়ারু’।
ঝড়ের নামের তালিকা
প্রথম আঘাত হানা মহাসেনের পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলোর জন্য নির্বাচিত নামগুলো হলো ফাইলিন, হেলেন, লহর, মাদী, নানাউক, হুদহুদ, নিলুফার, প্রিয়া, কোমেন, চপলা, মেঘ, ভালি, কায়নতদ, নাদা, ভরদাহ, সামা, মোরা, অক্ষি, সাগর, বাজু, দায়ে, লুবান, তিতলি, দাস, ফেথাই, ফণী, বায়ু, হিকা, কায়ের, মহা, বুলবুল, পাবয়ান বা পবন ও আমপান প্রভৃতি। এর মধ্যে পবন নামটি দেয়া শ্রীলংকার এবং আম্পান নামটি থাইল্যান্ডের দেয়া।
লেখক: সাংবাদিক ও সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




