somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফাগুনের কবি ফররুখ আহমদ

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানি
ভোমরাটা গায় গান ঘুমভাঙানি
একঝাক পাখি এসে ঐকতানে
গান গায় এক সাথে ভোর বিহানে...

ছোটবেলায় পড়া সেই 'ফাগুনের ছড়ার কবি' ফররুখ আহমদ। ইসলামী রেঁনেসার কবি হিসেবেই তিনি পরিচিত। কখনো তিনি ঝিরিঝিরি মাতাল হাওয়ায় নিশিবকের মত ভেসে বেড়ান প্রকৃতির রূপে ...

গেয়ে ওঠেন-

বিষটি এল কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকল দূরে দেয়া যে,
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটল আবার কেয়া যে।

গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,
বিষটি বাদল দেয় দোলা,
রাখাল ছেলে মেঘ দেখে,
যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা।

মেঘের আঁধার মন টানে,
যায় সে ছুটে কোন খানে,
আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে
আমন ধানের দেশ পানে।

আবার কখনো ডেকে ডেকে যান জাতির ঘুমন্ত কান্ডারীদের..

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে
আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের
তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।

তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

ফররুখ আহমদ সনেটও রচনার করেছেন। তাঁর রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফার্সি শব্দের প্রাচুর্য তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। তিনি সব সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনো নামাজ কাযা করেননি।

কবি ফররুখ আহমদ খুব সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদের মধ্যে ছিল মধ্যে দুটো পায়জামা, দুটো পাঞ্জাবি, একটি গেঞ্জি, একটি শেরওয়ানি, এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল ইত্যাদি।

ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা। তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যা মাসিক সওগাত-এ 'পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য' নিবন্ধে লেখেন :

'গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।'

নিজের অবস্থানে শক্ত থাকা স্পষ্টভাষী ব্যক্তিত্ববান ফররুখকে সহ্য করতে হয়েছে তদানীন্তন সরকারের অত্যাচারের স্টীম রোলার।

সরকারের কোপানলে পড়ে ফররুখের শেষ জীবন কাটে আর্থিক দৈন্যতা ও নানা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। ফররুখের চাকরী কেড়ে নেয়া হয়। বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ফররুখের মেয়ে। এ বিষয়ে আহমদ ছফার একটি হৃদয়স্পর্শী ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করেন। তৎকালীন গণকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এটি।

আহমদ ছফা লিখেছিলেন,

‘ফররুখ আহমদের অনেকগুলো সফল কবিতা রয়েছে। তাঁর কবিতা বাংলার কাব্য-সরস্বতীর কণ্ঠে ইন্দ্রমণির হারের মত দুলবে। কিন্তু আমি মনে করি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এই মৃত্যু।’

আহমদ ছফা আরো লিখেছিলেন,

‘মৃত্যুকে তিনি একেবারে চোখাচোখি দেখেছেন এবং বরণ করেছেন। একটিবারের জন্যও কবির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। একটিবারের জন্যও দীন অক্ষম কাঙ্গালের বেশে কারও দোরে হাত পাতেননি। কাব্যাদর্শ যাই হোক লিখেছেন তো কবিতা।’ (ছফা, ১৯৭৪)

আহমদ ছফার কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ফররুখ আহমদের প্রথম যৌবনের বন্ধু আবু রুশদের স্মৃতিকথায়ও।

রুশদ লিখেছেন,

‘মরবার সময় সে বিনা চিকিৎসায় এবং অর্ধাহারে তাঁর শেষের দিনগুলো কাটিয়েছিল। তাঁর অনেক অনুরাগী তাঁকে সাহায্য করতে চেয়েছিল, সে তা বার বার প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁর আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল খুব উঁচু ধরনের।’ (রুশদ ১৯৯৮)

কাব্যগ্রন্থ
-------------
সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪)
সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২)
নৌফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১)
মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর,১৯৬৩)
ধোলাই কাব্য (জানুয়ারি,১৯৬৩)
হাতেম তায়ী (মে, ১৯৬৬)
নতুন লেখা (১৯৬৯)
কাফেলা (অগাস্ট, ১৯৮০)
হাবিদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১)
সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩)
দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪)

শিশুতোষ গ্রন্থ
---------------------
পাখির বাসা (১৯৬৫)
হরফের ছড়া (১৯৭০)
চাঁদের আসর (১৯৭০)
ছড়ার আসর (১৯৭০)
ফুলের জলসা (ডিসেম্বর, ১৯৮৫)

পুরস্কার
--------------
১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন । কবি ফররুখ আহমদ ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক 'প্রাইড অব পারফরমেন্স' এবং ১৯৬৬ সালে পান 'আদমজী পুরস্কার' ও 'ইউনেস্কো পুরস্কার'। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাঁকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়।

তথ্যসুত্র
-------------

*উইকিপিডিয়া
*প্রিয় ডটকম
*ফররুখ আহমদের কবিতাবলী
*ফররুখ আহমদের জীবনী
*কাজীর বিচার : ফররুখ আহমদের আবেহায়াত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৫০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীবাদ, ইসলাম এবং আইয়ামে জাহেলিয়া: ঐতিহাসিক ও আধুনিক প্রেক্ষাপট

লিখেছেন মি. বিকেল, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৪



আইয়ামে জাহিলিয়াত (আরবি: ‏جَاهِلِيَّة‎) একটি ইসলামিক ধারণা যা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী আরবের যুগকে বোঝায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়কাল ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×