প্রিয় বন্ধু, আপনারা নিশ্চয়ই লৰ্য করে থাকবেন যে, আমি 47-এর 'আমরা' আর একাত্তরের 'আমাদের' শব্দের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়েছি। এর কারণ হচ্ছে এই দুই 'আমরা'য় ব্যাপক পার্থক্য, আর এই পার্থক্যটুকু যদি কেউ ধরতে পারেন তাহলে তার বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কেন আমরা একাত্তরে আবার নতুন করে স্বাধীন হলাম (আমি যদিও মনে করি না যে সাতচলিস্নশে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম, তবু বক্তার বক্তব্যকে ধরে নিয়ে তর্কে খাতিরে) এবং সেটা বোঝা গেলে বক্তা তার এই প্রশ্নেরও উত্তর পেয়ে যাবেন যে, একাত্তরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন আবার কেউ স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন না।
এখানে বড় কোনও নিবন্ধ উপস্থিত করার অবকাশ নেই, আমার ধারণা কেউ সেটা পুরোপুরি পড়বেনও না, বরং এমন সব উদ্ভট মনত্দব্য করতে শুরম্ন করবেন তাতে লেখকের ধৈর্যচু্যতি ঘটার সম্ভাবনাই প্রকট হয়ে ওঠে।
তাহলে প্রথম প্রশ্ন হলো, 47-এ স্বাধীনতা পেয়েছিল কারা? প্রাথমিক উত্তর ভারতবাসী, কিন্তু সেই ভারতবাসীর মধ্যে দু'টি ভাগ হয়েছিল, ফলে দু'টি ভ্থখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল মাত্র, যদিও এই ভ্থখণ্ডকে রাঙানো হয়েছিল দু'টি ধর্মের রঙ-এ; হিন্দু এবং মুসলমান। ধর্মভিত্তিতে গঠিত কোনও দেশই অতীতে টেকেনি জিন্নাহ্ নিজের এই বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও (48-এই তিনি এই বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন এবং ৰোভ করে বলেছিলেন, এই পোকায় কাটা পাকিসত্দান তো আমি চাইনি। তিনি যে শুধু দুই অংশের মধ্যে দূরত্বের কারণেই একথা বলেছিলেন তা নয়, বরং দুই অংশের মধ্যে ধর্ম, ধর্মের প্রায়োগিক দিক এবং সংস্কৃতিগত আসমানসম ফারাক সম্পর্কে সম্মোক উপলব্ধি করেছিলেন বলেই এই ৰোভ করেছিলেন। যে ৰোভের কারণে পাকিসত্দানী জাতির (?) জনক জিন্নাহকে মরম্নভ্থমিতে একা একা মরতে হয়েছিল, তার সাহায্যার্থে তার দেশজ ভাইয়েরা কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকি জিন্নাহ্ পরবতর্ী গণতান্ত্রিক শাসক লিয়াকত আলী খানকেও প্রাণ দিতে হয়েছে গুলিতে, তুলনায় ভারতের অবস্থাটা তো ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই, কারণ ৰমতা গ্রহণের পরেই ভারতের সংবিধান রচনা হয়েছিল যার মূলভিত্তি হচ্ছে ধর্মনিরপেৰতা ও গণতন্ত্র, কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে পাকিসত্দান স্বাধীনতার হাফ সেঞ্চুরি পরেও একটি কার্যকর সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেনি, এই ব্যর্থতা কী জন্য জানেন, কারণ পাকিসত্দানী জাতি বলতে আদৌ কিছু নেই, পাকিসত্দান একটি কনসেপ্ট মাত্র যা কখনও কার্যকর হয়নি, ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা ৰীণ, বরং দিন দিন সেটা আরও ভাঙার পথে, ইতোমধ্যেই বেলুচিসত্দান কার্যত পাকিসত্দানের কেন্দ্র থেকে আলাদা, সেখানে মোশাররফের শাসন নয়, নিজস্ব শরীয়া শাসন বলবত _ দুঃখিত মূল আলোচনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার জন্য) চাপিয়ে দেওয়া স্বাধীনতায় (দেশভাগই সত্যিকারের টার্ম, একে স্বাধীনতা কিন্তু কেউ বলে না, বলে দেশভাগের সময়, খেয়াল করে দেখবেন) অনেকেই খুশী হয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী দেশের উন্নয়নে ঝাঁপিয়েও পড়তে চেয়েছিল বাঙালি।
কিন্তু দেখা গেলো কি যারা লাড়কে লেঙ্গে পাকিসত্দান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলো, যারা 46-এর ভয়াবহ দাঙ্গা ঘটিয়ে ব্রিটিশের চোখে প্রমাণ তুলে দিলো যে হিন্দু আর মুসলমান একসঙ্গে বসবাস করতে পারবে না, নতুন পাকিসত্দানে তারাই মানে সেই সোহ্রাওয়ার্দি বা ফজলুল হক দু'জনেই অপাংতেয়ই শুধু নয়, ভারতের দালাল, ট্রেটর এবং তাদেরকে ঢাকায় পা রাখলে পাগলা কুকুরের মতো গুলি করে হত্যা করা হবে বলে ঘোষণা দিলো পাকিসত্দানের উত্তর ভারতীয় হিজরতকারীরা। একটা বিষয় স্পষ্ট হলো, ৰমতার দ্বন্দ্বে উত্তর ভারতীয়রা কিন্তু মূল পাকিসত্দানের কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেনি, ভেবেছে বাঙালিকে, ফলে কেন্দ্র থেকে বাঙালি-দমনের যে নঙ্াটি দেশভাগের পর পরই পাকিসত্দানী শাসকগোষ্ঠী গ্রহণ করেছিল তার চূড়ানত্দ রূপায়ন হয়েছে আইয়ুব শাহী থেকে ইয়াহিয়ার মতো সামরিক জানত্দাদের হাতে। আর তাইতো পূর্ব পাকিসত্দানে যখন গাওয়া হচ্ছে হাফিজ জলান্ধরীর "পাক সার সাদ জমিন সাদবাদ" তখন পশ্চিমে স্কুলের পাঠ্য বইতে বাঙালি সম্পর্কে বলা হচ্ছে, "বংগালি বাবু, বংগালী যাদু ও ভ্থখা বংগালী _ আমাদের ছেলেবেলায় এই তিনটি বিশেষ কথাই আমরা বাংলা সম্পর্কে শুনেছি" _ (রাও ফরমান আলী, হাউ পাকিসত্দান গট ডিভাইডেড)। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পাকিসত্দান শব্দটি, যা ইকবালের চেতনা-সনত্দান (ব্রেইনচাইল্ড) তাতে বাংলার কোনও স্থানই নেই। পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিসত্দান-আফগানিসত্দানই সেখানে মূল, তাহলে 47-এ যে পাকিসত্দান সৃষ্টি হলো সেখানে বাংলা কোথায়, আর বাংলাই যদি না থাকে তাহলে বাঙালি স্বাধীন হলো কী করে? তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, 47-এ বাঙালি স্বাধীন হয়নি, বরং এক কলোনিয়াল শাসকের হাত থেকে আরেক কলোনিয়াল শাসকের হাতে পড়েছে মাত্র। আর আমাদের ভুললে চলবে না যে, ভারত উপমহাদেশ ইংরেজ দখল করেছে বাংলা থেকেই এবং সেখানেই প্রথম বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছে, সিরাজুদ্দৌলস্নার কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নেওয়ার পরদিন থেকেই, একই ভাবে 47-এর 14ই আগস্টের পরদিনই বাঙালিই প্রথম সস্নোগান দিয়েছে "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়"।
সেই "ঝুটা আজাদী" নিয়ে বাঙালির মতো একটি সংস্কৃতি-ভিত্তিক জাতি বেশিদিন পাকিসত্দানীদের সঙ্গে একসাথে চলতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। এরপরের কাহিনী তো রাও ফরমান আলীদের মতো উদিধারীদের দ্বারা শোষণ-শাসনের ইতিহাস, কখনও ধর্ম দিয়ে কখনও ডান্ডা দিয়ে। যেদিন রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব পাকিসত্দানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেদিন থেকেই বোঝা গেছে পাকিসত্দানের স্বপ্নের পুলাওতে পঁচন ধরেছে_ বাঙালি পঁচা (পানত্দা) ভাত খেতে পারে কিন্তু পঁচা পুলাও? নৈব নৈব চ।
(দুঃখিত অল্পকথায় এরচেয়ে ভালো করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারা গেলো না। তাছাড়া এজন্য আমার ধারাবাহিক লেখাটিও বন্ধ রাখতে হলো। আশা করি, ধারাবাহিক লেখার সঙ্গে উত্থাপিত তথ্যাদিতে আপনার প্রশ্নের উত্তরও আপনি পাবেন। )
(ব্যবহৃত ছবিতে জিন্নাহ, নেহরম্ন এবং লিয়াকত আলী খান রয়েছেন, কিন্তু একজন বাঙালি নেতা কোথায়? এই অবহেলা বাঙালি মেনে নেওয়ার কোনও কারণ আছে কি? উলেস্নখ্য এটা শেষ বৈঠক 1947-এর 2 জুন)