১৬ নভেম্বর, ঘটনাস্থল বিএনপির ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর গুলশানের বাসভবন। নৈশভোজের আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের কয়েক নেতা ছাড়াও উপস্থিত আছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা ও ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ড্যানিলোভিচ। উপস্থিত কূটনীতিক ও রাজনীতিকরা ঘুরে ঘুরে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। এরই মধ্যে একটি টেবিলে বসে ছিলেন বিএনপির কয়েক নেতা। একপর্যায়ে সেখানে এসে হাজির হন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। কথায় কথায় তিনি জানান, বিএনপির কয়েক নেতার সাম্প্রতিক মন্তব্যে জামায়াতের মাঠপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বক্তব্যে অনেকে কষ্ট পেয়েছে বলে জানান তিনি। এরপর এ নিয়ে খানিকক্ষণ তর্কবিতর্ক চলে। আর বিতর্কের সূত্র ধরেই বিএনপির এক নেতা জানতে চান; জামায়াতের ঈমানের ঠিক আছে কিনা। তারা শেষ পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে থাকবেন কিনা।
সূত্রমতে, বিএনপি নেতার এ ধরনের প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তিনি পাল্টা জানতে চান এমন প্রশ্ন কেন? জবাবে উপস্থিত বিএনপির এক নেতা বলেন, সরকার তো জামায়াতকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের করে নিতে চায়; এজন্য নানা কৌশল করছে। নানা ধরনের চাপের পাশাপাশি একটি প্রস্তাবও পাঠিয়েছে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে। জবাবে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। এ ধরনের কোন প্রস্তাব জামায়াতকে সরকার পাঠায়নি।
এ পরিস্থিতিতে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই একটু দূরে আরেক টেবিলে বসা মার্কিন ডেপুটি চিফ জনকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেন বিএনপির ওই নেতা। বলেন, ওই যে জন বসা আছেন। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এই প্রস্তাব দিয়েছেন। সত্যি কিনা তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। এরপর সত্যিই ব্যারিস্টার রাজ্জাক ছুটে যান মার্কিন কূটনীতিক জনের কাছে। একটু পরে ফিরে এসে বিএনপি নেতাকে বলেন, ঘটনা সত্যি। আমি জানতাম না। সূত্র জানায়, এভাবেই ফাঁস হয়ে যায় দূর থেকে শুরু করা সরকারের তৎপরতা।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গে শুক্রবার যুগান্তর প্রতিনিধির এক ঘণ্টারও বেশি বেশকিছু বিষয়ে আলাপ হয়। তবে প্রস্তাবনার ওই বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। বিএনপি নেতাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. ওসমান ফারুকসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। ড. মঈন খানও এ বিষয়ে জানতে চাইলে এড়িয়ে যান। তবে নৈশভোজে উপস্থিত অপর এক নেতা পুরো ঘটনা যুগান্তরের কাছে খুলে বলেন। ওই নেতা আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সরকারের প্রভাবশালী ওই উপদেষ্টার মাধ্যমে সরকারের প্রস্তাবনার কথা জানতে পেরেই খালেদা জিয়া ১০ নভেম্বর রামুর এক সভায় অভিযোগ করেন, সরকার তলে তলে জামায়াতকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। যদিও সরকারি দলের নেতারা একে বিভ্রান্তি ও হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন।
গত দু’বছর জামায়াতকে প্রকাশ্য কোন সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া হলেও সম্প্র্রতি প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। আগামীকাল দলটি বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশ ডেকেছে; আর এজন্য অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে দলটি চিঠিও পাঠিয়েছে। তবে সরকার অনুমতি দেয় কিনা তা এখন দেখার বিষয়ে। অনুমতি দেয়া হলে তা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে হবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে।
প্রকাশ্য রাজনীতির এই ঘটনা সরকারের সঙ্গে যে কোন ধরনের সমঝোতার অংশ কিনা জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, সমঝোতার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল হিসেবে সভা-সমাবেশ করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে দাবি করেন। আশা করি তার কাছ থেকে সে ধরনের আচরণ পাব। পুলিশ অনুমতি দেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন জামায়াত নেতা।
সরকারের প্রভাবশালী ওই উপদেষ্টার সঙ্গে গত দু’দিন ধরে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমার কাছে কোন তথ্য নেই। তবে নিজেদের স্বার্থে আওয়ামী লীগ অনেককিছুই করতে পারে। অতীতেও তার প্রমাণ আছে। একসঙ্গে আওয়ামী লীগকে নিয়ে তারা আন্দোলন করেছে। গোলাম আযমকে কদমবুসি পর্যন্ত তারা করেছে।
সূত্র জানায়, সরকারের এ ধরনের প্রাথমিক একটি উদ্যোগের কথা বিএনপির নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেই জানেন। বিশেষ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে বিএনপিকে একঘরে করার কৌশল হিসেবে সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। এজন্য বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণেও রাখছেন। তবে সংশয় সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। কারণ কৌশলগত কারণেই জামায়াতের পক্ষে বিএনপি জোট ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হবে না বলে তারা মনে করেন। তাদের মতে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হলেও এবার বিএনপিকে ছেড়ে যাওয়া জামায়াতের জন্য কঠিন হবে। কারণ তাহলে আর বাংলাদেশের রাজনীতিকে জামায়াতের বিশ্বাসযোগ্যতা বলতে কিছু থাকবে না। ভবিষ্যতে বিএনপি দূরের কথা; কোন রাজনৈতিক দল আর জামায়াতকে বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সরকার যে অবস্থানে চলে গেছে তাতে রাজনৈতিক সুবিধা যাই হোক; আওয়ামী লীগের পক্ষে জামায়াতের সঙ্গে ‘ডিল’ করাও কঠিন কাজ। চৌদ্দ দলের শরিকসহ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম তথা দেশের সুশীল সমাজকে বোঝানো অত্যন্ত কঠিন হবে বলেও মনে করে বিএনপি। তাদের মতে, কোন ‘ডিলে’র কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিংবা শাস্তি প্রক্রিয়া ঝুলে গেলে জনগণকে বোঝানো আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হবে না। যদিও বিএনপির বড় একটি অংশ জামায়াতকে তাদের জন্য এখন ‘বোঝা’ বলেই মনে করে। ফলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত বিএনপিকে ছেড়ে সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলবে এটাও অধিকাংশ বিএনপি নেতাকর্মী বিশ্বাস করেন না। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বড় অংশও এটা কঠিন কাজ বলে মনে করছে। তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংশয় দূর করার নানামুখী পথ খুঁজছে সরকার। কোন রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এটা নিশ্চিত। আর ওই অবস্থায় বহির্বিশ্বে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের করে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে সরকারের জন্য কিছুটা সুুবিধা হয়। বলা যায়, বিএনপি ছাড়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। ফলে জামায়াতকে ‘ছাড়’ দিয়ে ১৮ দলীয় জোট থেকে ছাড়াতে চায় সরকার।
সৌজন্যে এনাম আবেদীন- যুগান্তর

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



