ওথেল সিনড্রম কী?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার অকারন সন্দেহই “ওথেল সিনড্রম” নামে পরিচিত। এই মানসিক সমস্যায় আক্রন্ত ব্যাক্তি ভ্রান্ত ধারনার বর্শর্বতী হয়ে সন্দেহ করে যে তার জীবনসঙ্গীর অন্য নারী বা পুরুষের সাথে শারিরিক সম্পর্ক রয়েছে।কিন্তু, এই ধারনার পক্ষে তাদের কাছে কোন যুক্তি বা প্রমাণ থাকে না।অনেকে এটাকে মতিভ্রম বলেও মনে করেন। কিংহ্যাম এবং গরডনের মতে, দাম্পত্যের বিশ্বাসভঙ্গজনিত সন্দেহের চূডান্ত রুপই হলো ওথেলো সিনড্রম। এই সমস্যায় রোগীর অজ্ঞাতেই তার মানসিক পরিবর্তন হতে থাকে এবং সে তার স্বামী/স্ত্রীর আচরনকে ভুল ভাবে ব্যাখা করতে শুরু করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সে স্বামী/স্ত্রীর দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে বলে মনে করে।
ওথেলো সিনড্রমঃ সত্যি ঘটনা ১
পাঠকদের বলছি, ওথেল সিনড্রম কোন ভ্রান্ত ধারনা নয়, এটি আমাদের জীবনে বিদ্যমান। আমার জীবনসঙ্গী প্রায় পনের বছর ধরে এই সমস্যায় আক্রন্ত এবং এটা ক্রমশই আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।সত্যিকার অর্থে, আমি সম্প্রতি সমস্যাটা বুঝতে পেরেছি। আমি এই কুৎসিত সন্দেহর সাথে বসবাস করে চলেছি কারন আমি জানতাম না কার কাছে সাহায্য চাইব। আমার কিঞ্ছত বিশ্বাস ছিল যে, এটা হয়ত আপনা আপনিই ভাল হয়ে যাবে। সত্যি বলতে, লোকলজ্জার ভয়ে আমি এই জঘন্য পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। এই সিনড্রম বা রোগে আক্রন্তদের ধারনা তাদের চিন্তা ভাবনায় কোনও অস্বাভাবিকতা নেই।জীবনের এতগুল বছর নষ্ট করার পরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই রোগ সম্পর্কে ভাল ভাবে জানার, আমার জীবনসঙ্গীকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার। যদিও কোন পরির্বতনের আশা করতে পারছি না। তাই পাঠকদেরকে আমার পরামর্শ আমার মত সময় নষ্ট না করে এখনি কিছু করুন।
এই অকারন সন্দেহ স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্যদের জীবনে প্রচুর সমস্যার সৃষ্টি করে। আক্রান্ত ব্যাক্তি ধীরে ধীরে আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠে। তাই রোগ সনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
ওথেলো সিনড্রমঃ সত্যি ঘটনা ২
সম্প্রতি আমি আমার প্রায় দশ মাসের প্রেমের সম্পর্কের ইতি টেনেছি। যখন তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, মনে হয়াছিল সে আমার স্বপ্নের পুরুষ। দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। সে আমার থেকে ৮ বছেরের বড়। কিন্তু আমার জন্য ঠিকই ছিল কারন আমি এই রকম পুরুষদেরই পছন্দ করি। সে সময় আমার বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছিল। আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে নিজের বাসায় ওঠার আগ পর্যন্ত সে খুব স্বাভাবিকই ছিল।
কিন্থু তারপর থেকে সে সন্দেহ করতে শুরু করল যে আমার পরিচিত সব পুরুষের সাথেই আমার সম্পর্ক আছে। আস্তে আস্তে তার সন্দেহ আরো অস্বাভাবিক হতে শুরু করল। তার মনে হতে লাগল যে আমি আমার চাচাত ভাই এর সাথে শারিরিক সম্পর্কে লিপ্ত!
কিন্তু যখনি তার মনে হত যে এগুল তার ভ্রন্ত ধারনা তখনি সে ক্ষমা চাইত। বলতে গেলে অনেকটা পাগলের মত। এটা প্রায় নিয়মিতিই চলতে লাগল এবং ক্লান্তিকর হয়ে দাড়াল। আগে সে কোকেনে আসক্ত ছিল এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতে এডিরল নিত। আমার মনে হয় এটাই তার সমস্যার মূল কারন। এটা আমার জন্য খুবই কষ্টের কারন আমি তাকে প্রচন্ড ভালবাসি। আমি স্বপ্নেও তাকে প্রতারনা করার কথা ভাবতে পারি না। সত্যি বলতে, এখন পর্যন্ত তার জন্যই আমি সত্যিকারের ভালবাসা অনুভব করেছি। আমিই তার জন্য সবই করতে পারি যদি সে আমাকে বিশ্বাস করে।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের পরিবারের অন্য সদস্যদের সাহায্য অত্যন্ত প্রয়োজন। পরিবারের অন্য সদস্যদের উচিত তাদের ভ্রান্ত ধারনাকে দূর করার চেষ্টা করা এবং চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করা। এই ধরনের রোগীদেরকে তাদের জীবনসঙ্গীর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কিছু বলা উচিত নয়। এই ধরনের পদক্ষেপ স্বামী-স্ত্রীকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়, এমনকি তাদের বৈবাহিক জীবনে ভাঙণ সৃষ্টি করে। বিষয়টা একটি সময় ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াতে পারে।
ওথেলো সিনড্রমঃ সত্যি ঘটনা ৩
আমার বাবা প্রায় ৮ বছরের ও বেশী সময় ধরে ওথেল সিনড্রম বা ভ্রন্ত সন্দেহ রোগে আক্রান্ত। প্রথম প্রথম আমরা বুঝতেই পারিনি যে কী হচ্ছে। এটা ছিল অনেকটা সিনেমার মত। তিনি আমার মাকে সন্দেহ করতে শুরু করলেন, টাকা-পয়সা নষ্ট করতে লাগলেন, বাথটাব, বিছানার চাদর, ঘরের দেয়ালে বীর্য দেখতে লাগলেন এবং ক্যালেন্ডারে দিনগুল দাগ দিয়ে রাখতে লাগলেন।
বিভিন্ন জনকে টাকা দিতে লাগলেন আমার মায়ের সাথে বিভিন্ন পুরুষের, বিশেষ করে বাবা যাদেরকে সন্দেহ করতেন, ছবি সংগ্রহের জন্য। তিনি তার ভ্রন্ত ধারনাকে সত্য প্রমানের জন্য সাধ্যমত সবই করলেন। বাগানে পায়ের চিহ্ন, ভাঙা ঘাস ইত্যাদি দেখে তার মনে হত মায়ের প্রেমিক প্রবররা মায়ের সাথে প্রেম করতে এসেছিল। ভয়ংকর এবং বিভৎস।
তাকে জোর করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়াছিল এবং সেখেনে তাকে সাপ্তাহে একটা করে ইনজেকশন দেওয়া হল। কিন্তু ঔষধটি তাকে অনেকটা যান্ত্রিক করে ফেলল। আমনকি তিনি তার স্বভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন। এটা খুবই হতাশার এবং কষ্টের ছিল। এই সমস্যায় আক্রন্ত ব্যাক্তি নিজের ভ্রান্তিকে বুঝতে পারেনা ফলে এর থেকে বেরিয়ে আসার ও চেষ্টা করে না। এর কোনও যৌক্তিকতা আছে কিনা তা ও ভেবে দেখেনা। এই সমস্যা নিই তাদের সাথে আলোচনা করাও বৃথা।
এটা শুধুই তাদের ভ্রন্ত ধরনাকেই বাড়তে সাহায্য করে এবং তারা ধীরে ধীরে বৃত্তবন্দী হয়ে পড়ে। আমার অভিজ্ঞতায় মনে হয় এটা অনেকটা অর্টিজম বা ডেমেনশিয়ার মত যা তাকে মানসিক রগী করে তোলে। হিংসা মানুষের স্বভাবিক ধর্ম যা তাকে তার নিজের অধিকার রক্ষায় উৎসাহী করে। কিন্তু এই ধর্মকে সে যখন অতি মাত্রায় চর্চা করতে শুরু করে, সে অন্যের সামাজিক অধিকার হরন করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সন্দেহ প্রবন হয়ে ওঠে।
বৃত্তে বন্দী থেকে থেকে তারা তাদেরকে আরও মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তোলে। রোগের লক্ষণগুলোকে লুকাতে গিয়ে তারা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এমন পরিস্থির সৃষ্টি করতে চায় যা দিয়ে নিজেকে সত্য বলে প্রমান করতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তকে এমন কোথাও নিয়ে যাওয়া দরকার যেখানে সে পরিপূর্ন বিশ্রাম নিতে পারবে, আনন্দে সময় কাটাতে পারবে, বই পড়তে পারবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল তাকে তার বৃত্তে থেকে বের করার চেষ্টা না করা।
ডাক্তার বা ঔষধের চেয়ে পরিবারের সাহায্য তার সবচেয়ে বেশী দরকার। তার মানে এই নয় যে ঔষধের প্রয়োজণীয়তা নেই। শুরুতে আমার বাবা কে ও ঔষধ দেওয়া হয়েছিল যেগুলো পরে দুই বার পরিবরর্তন করা হয়। তিনি তার প্রত্যহিক খাবার পরিবরর্তনের পাশাপাশি ক্রিলের তেল ও ভিটামিন বি১২ খেয়েছিলেন। মদ ও ভাজা পোড়া খাবার না খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা অত্যাত্ন জরুরী। দুশ্চিন্তা সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। আমার বাবা খুবই সৌভাগ্যবান যে তিনি সর্বোচ্চ পারিবারিক সমর্থন পেয়েছেন, আমার মা খুবই শক্ত মহিলা এবং তিনি ভাল করেই জানেন কি ঘটতে চলেছে। যে সমস্ত মহিলারা এই ধরনের ভয়ংকর এবং বিভৎস পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য রইল আমার হৃদেয়র সমস্ত ভালবাসা।
আরও বেশ কিছু লেখা আসছে ওথেল সিনড্রম নিয়ে। যেমন রোগের কারনসমূহ, রোগের বিভিন্ন পর্যায়, রোগের ক্ষতিকর প্রভাব ইত্যাদি। বন্ধুরা আশা করবো সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখাটি শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দিবেন এই রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে। ধন্যবাদ।
আরও কিছু রিসোর্স এড করলাম, দেখুন
Click This Link
Click This Link
Click This Link
লেখার মূল সোর্স এখানে
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৪ রাত ১১:৫৭