somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপরিণীতা

০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভার্সিটি লাইফের প্রথম দিকেই পুস্পা আর মুহিতের পরিচয়। পরিচয়টা অন্যান্য সবার মত খুবই সাদা-মাটা। ওদের সম্পর্কও অন্যান্য বন্ধুর চেয়ে ভিন্ন ছিলো না। ক্লাস, আড্ডা, গান, ক্যাফে সব মিলিয়ে ভালই যাচ্ছিলো ওদের সময়। মাঝে মাঝে বেশ রাত করে ঘরে ফেরায় মা’র কাছ থেকে কম কথা শুনতে হয় নি পুস্পার, তারপরও মুহিতের সঙ্গ পুস্পার সব সময়ের মত ভাল লাগতো।

দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পায় পুস্পা। মুহিত হয়তো চলে এসেছে। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয় তাকে। মুহিত সারাদিন পর বাসায় ফেরে। হাত মুখ ধোয়, ওকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। তারপর ওকে আবার শুইয়ে দিয়ে বাসার কিছু কাজ করে পুস্পার হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

মুহিতের কাছে ঘরের লকারের চাবি রয়েছে। ও কেন দরজায় টোকা দিবে? পুস্পার মনে কিছুটা আতংকের ছায়া কিছু সময়ের জন্য ঠায় পেলো। কে আসলো এই অবেলায়? স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটা পুস্পার মনের ভেতরটাকেও কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে করে তুলছে এই কয়েকদিনেই। মুহিত পাশের বাসায় কাজের মহিলাটিকে ঘরটা মুছে দিতে বেশ কয়েকবার বলার পরও মহিলা আসে নি। মুহিত ঠিক করেছে আজ সে নিজেই এর ব্যাবস্থা করবে।
বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারছে না সে। ভেতর থেকেই আতংকের স্বরে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলো-
“কে?”
ওপাশ হতে বেশ জোড়াল কন্ঠ শোনা গেলো-
“ভাড়ার জন্য এসেছি, মালিক পাঠিয়েছে।”
কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল পুস্পা। আজ যে মাসের দশ তারিখ হয়ে গিয়েছে খেয়ালও নেই ওর। মুহিত আসলে ওকে ভাড়ার কথা বলতে হবে।
“আপনি যান, আমি ভাড়া পাঠিয়ে দিবো আজ-কালকের মধ্যেই।”

পুস্পা আবার শুয়ে পড়লো বিছনায়, খুব বেশি অসহ্য লাগছে এই দুনিয়া-দারী। দেয়ালের উপর সৃষ্টি হওয়া প্রতিকৃতি গুলো আনমনে দেখতে লাগলো। মাত্র তিনদিন আগেও নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে সে ঘরের সব কাজ করতো। কিন্তু এখন সে অসহায়ের মত বিছানায় পড়ে আছে। মুহিতের কড়া নির্দেশ কোন মতেই বিছানা ছেড়ে উঠা যাবে না।

সবে মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছিল ওরা। পুস্পার বাসা থেকে পুস্পার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। খুব শীঘ্রই অ্যামেরিকায় সিটিজেন এক ভাল পাত্রও পেয়ে যায়। পাত্রের নাম অভিমান্য চক্রবর্তী। পুস্পারাও চক্রবর্তী বংশের। পুস্পার পুরো নাম হচ্ছে সুরভী রাণী পুস্পা চক্রবর্তী। আর মুহিতের পুরো, মোঃ জুনাইয়েদ হোসেন মুহিত।

বিয়ে ঠিক হবার দুদিন পর মুহিতের সাথে পুস্পার দেখা হয়।
“কিরে পুস্পা, এই দুই দিন কই ছিলি?”
“তেমন কিছু নারে, একটু অসুস্থ ছিলাম।”
“সুপ্তা বলল, তোর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে রে। তা পাত্র কি করে রে? শুনলাম অ্যামেরিকায় নাকি সিটিজেন? বিয়ের পর দেশেই থাকবি? নাকি চলে যাবি বাইরে?”
“বাদ দে রে এসব কথা। ভাল্লাগতেছে না। আচ্ছা, মুহিত তুই কি একটা গান শুনেছিস?”
“কি গান দোস্ত?”
“Somebody wants you
Somebody needs you
Somebody dreams about you every single night
Somebody can't breath without you, it's lonely
Somebody hopes someday you will see
That Somebody's Me.”
“হ্যাঁ তো দোস্ত শুনছি, এনরিকের গান, কেন রে?”
“নাহ, এমনি। আচ্ছা শোন কেউ যদি তোকে এই গানটা শুনায়ে প্রপোজ করে, তুই কি রাজী হবি?”
“আরে গাঁধি, দেশে কি ছেলের আকাল পরেছে যে, মেয়েরা আমার মত গাধাটাকে এই গান শুনিয়ে প্রপোজ করবে?”
“যদি আমি করি?”
মুহিত চুপ-চাপ দাড়িয়ে রয়েছে। দূর থেকে পুস্পার চলে যাওয়া দেখতেই যেন বিষণ্ণতা এসে দমিয়ে দিয়ে গেলো ওকে।

নাহ এভাবে আর কত দিন! বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে কোমরও ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। খুব কষ্ট হয় পুস্পার। বুকের ভেতরটা মাঝে মাঝে হাহাকার করে উঠে। একটা মানুষকে আর কত চাপ দিবে সে! সারা দিন বাইরে বাইরে থাকে। দিন শেষে বাসায় এলেও যদি একটু শান্তি না পায়, তাহলে কতটা কষ্ট লাগতে পারে? ভাবতেই কষ্টের পরিমানটা বেড়ে যায় পুস্পার।

দীপশিখা যেথা জ্বলে
সেথা নয় মোর বাস,
যেথা পাখি রয়
মেঘের গর্জন
বৃষ্টির বসবাস
সুদূর সবুজ ঘাস-
সেথা নয় মোর বাস।।

আঁধার কালো কুটীর যেথা
দীপশিখার প্রদীপ বৃথা,
বদ্ধ কারাগার
স্যাঁতস্যাঁতে বাতাস
শুধুই দীর্ঘশ্বাস-
সেথা মোর বাস।।
দুঃখের নির্বাস।

নিজের লেখা কবিতাটি আউড়াতে আউড়াতে বিছানা ছেড়ে উঠে পুস্পা। ঘরের অবস্থা তিন দিনেই বেহাল। ঘরের গৃহিণী যদি কাজ না করে ঘরের, সেটাকে কি আর ঘর বলা যায়? মুহিতের কড়া নির্দেশ অমান্য করে বিছানা ছেড়ে উঠলো পুস্পা। দুই দিন হলো ঘরের বাতিটাও ফিউজ হয়ে গিয়েছে, আপাতত ডিম লাইট দিয়েই যাবতীয় কাজ চালাতে হয়। মুহিতকে বলে একটা লাইটেরও ব্যাবস্থা করতে হবে। অন্ধকার ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে। এখনো হাতে অনেক কাজ বাকী, পুরো ঘরটা পরিষ্কার করতে হবে। মুহিতকে রাতের খাবার কিনে আনতে মানা করে দিতে হবে। আজ নিজের হাতে রান্না করবে পুস্পা। ঘরের মেঝে পরিষ্কার করতে হবে। আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে পুস্পা। সে কাজের মাঝে রয়েছে তৃপ্তির ছোঁয়া।

পুস্পা বেশ কিছু দিন ভার্সিটিতে আসে নি। আর অন্যদিকে অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝেই মুহিত দিনগুলো পাড় করলো। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব পেছনে ফেলে পুস্পার বাসায় এসে হাজির মুহিত। পুস্পার রুমে পৌঁছাতে তেমন কোন বেগ পেতে হয় নি ওর, কারন প্রায় নিয়মিতই পুস্পার বাসায় আসা হয় ওর।
“পুস্পা!”
“আরে মুহিত, তুই!”
“হুম”
“হঠাৎ করে কেন আসলি? জানালিও না?”
“নাহ এমনি রে। আচ্ছা তোর বিয়ের তারিখ কবে?”
“কেন?”
“নাহ এমনি, বল কবে?”
“আগামী মাসের ২ তারিখ।”
“আজ তো ১৮ তারিখ, আর মাত্র ১৪ দিন বাকী। আমাকে ছাড়া সুখে থাকবি?”
“জানি নাহ।”
“বল, থাকবি?”
“নাহ” অনেকটা মলিন স্বরে পুস্পার মুখ থেকে কথাগুলো বের হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, পুস্পা কাঁদছে। কিন্তু উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকায়, দেখতে পায় নি মুহিত। মুহিতের ভেতর কেমন ব্যাথা অনুভূত হলো। এত কাছ থেকে কখনো পুস্পাকে কাঁদতে দেখেনি ও।

ঘরের কাজ প্রায় শেষ। এখন শুধু রান্নাটা বাকী। মুহিতের আসার সময় হয়ে এসেছে। আজও হয়তো তিনটে টিউশনি করিয়ে ফিরবে। বেচারাকে এখন অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়। পুস্পা কিছুদিন আগেও মুহিতকে সাহায্য করতে পারতো। যেখানে মুহিত দুই থেকে তিনটে টিউশনি করিয়ে যা পেতো, তাঁর সাথে পুস্পার একটি টিউশনির টাকা যোগ হতো। বেশ ভাল ভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিন।

ওদের পড়ালেখা শেষ আজ প্রায় ছয়-সাত মাস। মুহিত বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউও দিয়েছে। এখনো তেমন কোন ফলাফল আসে নি। মুহিতের জন্য বড্ড বেশি কষ্ট হয় পুস্পার। সে যদি পারতো তাহলে সত্যি অনেক কিছু করতো মুহিতকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু শরীরের এই অবস্থার কারনেই পারছে না। ইদানীং নিজের উপর খুব বিরক্ত লাগে ওর।

হ্যাঁ, যেমনটা হবার কথা ছিলো, তেমনটাই ঘটেছে। পুস্পা কিংবা মুহিত, কারো বাসা থেকেই তাদের বিয়ে মেনে নেয় নি। এক বন্ধুর সাহায্যে শহরের শেষ প্রান্তে জরাজীর্ণ একটি বাড়িতে উঠে তারা। পড়ালেখার পরিসমাপ্তিও বেশ ভাল ভাবেই সম্পন্ন করে তারা। আজ ওদের বিয়ের প্রায় চার বছর। কে বলে ভালবাসার মানুষটিকে বিয়ে করলে সুখী হওয়া যায় না?! বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে ভাবে পুস্পা।

হঠাৎ ঘরের দরজার লকার খোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মুহিত চলে এসেছে, হাতে কতগুলো ব্যাগ। বিস্ময়ের চোখে পুস্পা ব্যাগগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিত একটা ব্যাগ পুস্পার দিকে বারিয়ে দেয়। পুস্পা ব্যাগের ভেতর একটি লাল শাড়ি দেখতে পায়। মুহিত বলে উঠে-
“শুভ বিবাহবার্ষিকী ম্যাডাম। কখনো তোমাকে একটি শাড়িও কিনে দিতে পারি নি বলে আমি সত্যিই খুব লজ্জিত বউ। তোমার স্বামীর এই অপরাগতাটুকু ক্ষমা করে দিয়ো।”
পুস্পার চোখ ছলছল করছে। ও কিছু বলে উঠার আগেই, মুহিত উঠে দাঁড়ালো, আরেকটি ব্যাগ থেকে একটি বাল্ব বের করে লাগাতে লাগাতে বলল-
“একটা চাকরি কনফার্ম হয়েছে আজ। আর টিউশনির কিছু টাকাও পেলাম। বাড়ি ভাড়াটাও নিয়ে এসেছি। আজ দিয়ে আসবো। আচ্ছা বউ তুমি, আসার পর থেকে একটা কথাও কেন বললা না? শাড়ি পছন্দ হয় নি তোমার?
পুস্পা মুহিতকে ইশারায় বিছানার পাশে এসে বসতে বলল। তাঁর চোখের নিচটা এখন অশ্রুসিক্ত। মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে হাজারো কথা বলার ছিল, বলতে গিয়েই আটকে যাচ্ছে। মুহিত পুস্পার হাতটি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। পুস্পার মনে হয় এই মানুষটির মত ভাল মানুষ হয়তো আর একটিও নেই। তাঁর গর্ভে এই মানুষটির সন্তান ধারণ করাটাও যেন তাঁর কাছে স্বর্গীয় কিছু। গল্পটি ভালো লাগলো তাই শেয়ার করলাম।
৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×