সুরেশ কুমার দাশ
লেখার কোনো ইচ্ছা নেই। তবু লেখার দরকার মনে করছি- কারণ আমার কী করা উচিৎ- এ সময়ে, সেটা আমি জানি না। আমি বুঝে উঠতে পারছি না। দেশের যে কারো যৌক্তিক আন্দোলন- অবরোধকে সমর্থন করি। কিন্তু এ অবরোধ আন্দোলনের নামে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হওয়া মানুষের আহাজারি, তাদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করি। এটা একান্ত অমানুষ হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কারো পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তাই হয়ে উঠেছি। এ কারণে আমার কিছু করার নেই। প্রতিবাদের ভাষা নেই। লেখাও কোনো যৌক্তিক কাজ নয়। কারণ লিখতে বসলেই মনে হয় - কেন লিখবো? কোনো পক্ষ নিচ্ছি কিনা। নিতে হচ্ছে কিনা। পক্ষ নিলে কেন নিবো। যদি আমি টকশো ওয়ালাদের মত শ্যাম আর কূল দুটোই রাখার চেষ্টা করি- তাহলে বাস্তবে আমি এসব নিরপরাধ মানুষ হত্যার পক্ষে কথা বলতে পারি না। যদি মানুষ হত্যার পক্ষ নিই তাহলে অবরোধ-হরতালের পক্ষ নিতে হচ্ছে- এটাই চলছে।
সত্যি গা শিউরে উঠে। যখন এদেশের অবাধ গণতন্ত্রের কারণে বহু টেলিভিশন চ্যানেল হওয়ার কারণে - কেমন বাড় বেড়েছে -টকশো ওয়ালাদের। কারণ তারা জানে এদেশে বাঁচলে- বাঁচতে হবে- বিএনপি-জামায়াত জোট ও আওয়ামী লীগের মধ্যেই। তাই কথা বলার সময় অর্ধেক এ দলের পক্ষে বাকি অর্ধেক ওই দলের পক্ষে কথা বলতে হবে। না হলে পরবর্তিতে সুযোগের মওকা মারা যাবে না। টকশো ওয়ালারা তাই সেভাবেই কথা বলছে। মানুষ মরুক। যারাই মরুক। এই আন্দোলনের জন্য তাদের জীবনটা যজ্ঞে বলিদানের মত। তাদের মরতেই হবে। মানতের দান। মানতের দান না দিলে পাপ হয়। এ পণ রক্ষা করতেই হয়। ওদের জীবন দিতেই হবে। যা সুবিধাবাদি টকশো ওয়ালাদের এক ধরনের আনন্দ দিচ্ছে। আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের সফলতার জন্য কিংবা তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতার দোহাই দিয়ে- অন্তত ইনিয়ে বিনিয়ে হলেও টকশো ওয়ালাকে সমর্থন করতে হচ্ছে। দেশটা এক ভয়ঙ্কর বন্য পরিবেশ হয়ে গেছে। মানুষ মারা হচ্ছে- রাস্তায় যারা অন্নের সংস্থান করতে আসছে তাদের। আর আমরা রাতে টিভি টকশোতে হেসে হেসে- বগল বাজিয়ে টক শো চালিয়ে যাচ্ছি। এবং এরা কখনও কখনও হত্যার পক্ষ নিচ্ছে। এমন বন্যতা কল্পনাও করতে পারি না। শিশু হত্যা করা হচ্ছে, নারী হত্যা করা হচ্ছে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তো মরছেই। আর আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের দিব্যি দিন চলে যাচ্ছে। এই যে পেট্রোল বোমা আমার উপর, আপনার উপর পড়বে না, আপনার -আমার শিশুকে, আপনজনদের হত্যা করবে না -তার গ্যারান্টি কি আছে? যদি এদেশে শিক্ষিত সমাজ- তারা মনে করে - তাদের উপর বোমা এসে পড়বে না -তার গ্যারান্টি আছে- তাহলে আন্দোলন সফল করার জন্য ওইসব মানুষদেরই মারতে হবে। আপনি- আমি নই- টার্গেট তারাই- যারাই প্রতিদিন পেট্রোল বোমার আগুনে জীবন দিচ্ছে।
তারা যদি এতই হত্যার বিপক্ষে হন- তাহলে এমন আরাম চেয়ারে, আলোক ঝলমলে পরিবেশে বসে কথা বলতে আসে কেমনে। কোন বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ কি ওই হত্যার পক্ষে নেয়া একজন মানুষের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হতে পারে। যে টকশো ওয়ালা মনে করে আমি যদি হত্যার বিপক্ষকারীকে কোনভাবে ম্যানেজ করতে পারি তাহলে হত্যার বিরুদ্ধকারী ওই মানুষটিরও মৌন সমর্থন আদায় করতে পারব। এটা আদায় করতে পারলে বা তার সান্নিধ্য পেলে কাল সকালে আরও দু চারজন মানুষ হত্যার জন্য অনেকটা অনুমোদন পাব। কারণ একজন টকশো ওয়ালা জ্ঞানী-সুশীলবাবু যদি একটা রয়ে সয়ে বলেন- তাহলে অনেকটাই হত্যার সমর্থন আদায় হয়। এটা পরের দিন আন্দোলনকারী দলের জন্যও লাভ। রাতে গিয়ে যখন একটু টিভির খবর দেখার চেষ্টা করি -বেশিরভাগ কথা শুনেই গা শিউরে উঠে। ঘৃণায় শরীর ঘিন ঘিন করে। নিজেকে অবুঝ মনে করে অনেক সময় তাদেরই যৌক্তিক মনে করি। আসলে এমন মানুষগুলো কি যৌক্তিক। যারা হত্যার পক্ষে এসে সরাসরি কথা বলার সুযোগ লুফে নেয়। নিরপরাধ মানুষ হত্যার পক্ষে বলার অবাধ স্বাধীনতা পায়। এমন সুযোগ পৃথিবীতে কোথায় আছে।
এই এমন এক মওকা- বিএনপি জামায়াত জোটের সঙ্গে নির্বাচনি ফয়সালা। ফয়সালা একান্তই তাদের ব্যাপার। জনগণের কোন ইস্যু নয়। আন্দোলন যদি জনগণ প্রয়োজন মনে করত তাহলে যারা মরার - তারা আন্দোলনে সামিল হয়েই মরত। কোনো হিসাবের দরকার নেই। যারা ভোট ভোট বলে এবং গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে আন্দোলনের পক্ষ নিচ্ছে তারা কি দেখছেন না আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত কিনা। জনগণের জন্য যে গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র যদি ওই টকশো ওয়ালারা জনগণের চেয়ে বেশি বোঝে- উস্কানি দেয় -তাহলে তারা গণতন্ত্র জনগণের জন্য চায় নাকি নিজেদের জন্য চায়।
সম্প্রতি রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘মানব সমাজ’ বইটি পড়ছি। সেই কথিত সভ্যতাটা শুরু হয়েছিল - সুবিধাবাদীদের সুবিধা আদায়ের আইন কানুন ও তন্ত্র মন্ত্র দিয়ে। শুধু রাহুল সাংকৃত্যায়ন নন অন্য অনেকের বইয়ে এ কথাটা ঘুরে ফিরে এসেছে। বাস্তবতা হচ্ছে এ সুবিধাবাদীদের যুক্তি কিংবা বুলেট-বোমার আঘাতেই মৃত্যু হচ্ছে সাধারণের। হত্যাকারি ও তাদের উস্কানিদাতাদের এসবের হিসাব কখনও কোথাও দিতে হয় না। তারা অবলীলায় পার পেয়ে যায়। যে কারণে ওদের এক পক্ষ পেট্রোল বোমা হতে মানুষ মারছে। আর এক পক্ষ টেলিভিশন টকশো থেকে সমর্থন আদায় করছে। এটা একটা চমৎকার খেলা।
কিন্তু এই বন্য একটা অবস্থা কতদিন চলতে পারে। আমাদের কি করার আছে? আমরা যখন অন্যের নীতি-নৈতিকতা, দায়িত্ব-কর্তব্য ও করণীয় নিয়ে সমালোচনা করি তাহলে নিজের এবং নিজেদের করণীয়টাও ভেবে দেখা উচিৎ।