পাকিস্তানের ১৯৫ জন পলাতক যুদ্ধাপরাধীর বিচারে ‘জনতার আদালত’ শুরু
সুরেশ কুমার দাশ
মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী, গণহত্যাকারি ১৯৫ জন পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ‘জনতার আদালত’ এর কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছ। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন এই আদালত গঠনের জন্য প্রথম প্রস্তুতি সভা আজ বিকালে(১৪ জানুয়ারি, ২০১৬) চট্টগ্রামের থিয়েটার ইন্সটিটিউট অব চিটাগং-এ আয়োজন করা হয়।
মূলত ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিলে দিল্লি চুক্তি নামে অভিহিত ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল সেই চুক্তির ১২ নং ও ১৪ নং অনুচ্ছেদ পাকিস্তান কর্তৃক সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হওয়ায় অন্য পক্ষগুলো এই চুক্তি মানতে বাধ্য নয়। অর্থাৎ যারা জনতার আদালত গঠন করতে যাচ্ছেন তারা বলছেন- বর্তমান বাস্তবতায় ওই দলিল আর কোনো কার্যকরি দলিল নয়। তাই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী আইনে শিগগিরই পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সৈন্যের বিচার কাজ শুরু করার জন্য তারা জোর দাবি জানাচ্ছে।
মূলত সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে পাকিস্তানের অতিরিক্ত মাথা ব্যথার বিষয়টি সকলেই লক্ষ্য করেছে। এছাড়া
‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি হওয়ায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কাজী এম খলিলুল্লাহ এক বিবৃতিতে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ- নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে সাকা-মুজাহিদের দুর্ভাগ্যজনক ফাঁসির রায় কার্যকরের ঘটনা লক্ষ্য করেছি। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে অসন্তুষ্ট। আমরা এর আগেও দেখেছি, বাংলাদেশে ১৯৭১-এর ঘটনাবলি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এ বিষয়েও আগের মতো আবারো গুরুত্ব দিচ্ছি। পাকিস্তানের মুখপাত্র বলেন, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মূলনীতি অনুসারে বাংলাদেশে আপস-রফা হওয়া উচিত। ওই চুক্তিতে ১৯৭১ প্রশ্নে ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছে, যা সদিচ্ছা ও সংহতি জোরদার করবে।’
‘যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- কার্যকরের পরও উদ্বেগ জানিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করায় কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে দাবি করে সে সময় দেশটির পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়।’
মূলত পাকিস্তানের এসব ঘন ঘটার মধ্যেও বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। খালেদা জিয়ার এই ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে মূলত পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার কোন পার্থক্য দেখছেন না মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।
এরমধ্যে বিএনপির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন,‘একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, চিকিৎসক, শিল্পী ও সাংবাদিকরা ‘নির্বোধের’ মতো মারা যান’। ‘তারা নির্বোধের মতো মারা গেল, আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়।
‘উনারা যদি এতো বুদ্ধিমান হন, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত তারা নিজের ঘরে থাকে কী করে, একটু বলেন তো।’
তিনি আরও বলেছেন,‘যুদ্ধাপরাধীর বিচারটা করছেন ভালো। এরা (বুদ্ধিজীবী) যে শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের বেতন-ভাতা খাইছে নির্বোধের মতো।’
গয়েশ্বর বলেন, ‘হ্যাঁ, নেতৃত্বের অজ্ঞতার কারণে ২৫ মার্চ যারা মারা গেছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন, তারা না জানার কারণে। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর যারা মারা গেছেন, তারা অজ্ঞতার কারণে মারা যাননি। তারা জ্ঞাতসারে বাড়িতে ছিলেন। তারা প্রতিদিন তো যে যেখানে কর্মস্থল ছিল, সেখানে কর্মস্থলে যাইতেন।’
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, ‘যারা পাকিস্তানের চাকুরি করলেন, বেতন-ভাতা খাইলেন, তারা হয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা, আর যারা পালায়ে পালায়ে না খেয়ে বেড়ালো তারা হয়ে গেলেন রাজাকার। তা-ই না? এ বিষয়গুলো আমাদের আজ পরিষ্কার করা দরকার।’
এর আগে সাকা চৌধুরীর বিচারের শেষ দিকে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মিয়া সুমরো, পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিপরিষদমন্ত্রী ইসহাক খান খাকওয়ানি, ফিজিতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওসমান সিদ্দিক সহ পাকিস্তানের দু’জন ব্যবসায়ীও তার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে পাকিস্তান দূতাবাসের পর দুই কর্মকর্তার জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়টিও সকলের জানা বিষয়।
ঠিক এসব ঘটনাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ভাবতে বাধ্য করছে পাকিস্তান বাংলাদেশে আরও বড় কোন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা বিএনপিকে ব্যবহার করছে। যেখানে বিএনপির সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাদের নির্দেশে কাজ করছে। মূলত তাদের কথাবার্তা মানুষের মধ্যে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের গভীর আভাস লক্ষ্য করা হচ্ছে।
যে কারণে জনতার আদালত গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এবং এই আদালতের মাধ্যমে পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সৈন্য সহ ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী পাক বাহিনীর প্রতীকী বিচার সম্পন্ন করা হবে।
মূলত এখানেই দিল্লি চুক্তির কথাটা ফিরে ফিরে আসছে। কি ছিল দিল্লি চুক্তিতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ থেকে বলছে -পাকিস্তান বাংলাদেশকে দিল্লি চুক্তিতে বলেছিল - তাদের কৃতকর্মের জন্য তারা বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু সেই ক্ষমা তারা চায়নি। বরং তাদের ঔদ্ধত্য দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে তারা কথা বলছে। দিল্লি চুক্তি অনুয়ায়ী পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়া ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সৈন্যের বিচার তাদের করার কথা ছিল। পাকিস্তান তো তা করেনি বরং বাংলাদেশের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচারের ব্যাপারে তারা হস্তক্ষেপ করছে।
পাকিস্তানও সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির রায়ের পর বলেছিল সেই দিল্লি চুক্তির কথা।
‘আমরা এর আগেও দেখেছি, বাংলাদেশে ১৯৭১-এর ঘটনাবলি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এ বিষয়েও আগের মতো আবারো গুরুত্ব দিচ্ছি। পাকিস্তানের মুখপাত্র আরও বলেন, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মূলনীতি অনুসারে বাংলাদেশে আপস-রফা হওয়া উচিত। ওই চুক্তিতে ১৯৭১ প্রশ্নে ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছে, যা সদিচ্ছা ও সংহতি জোরদার করবে।’
কিন্তু জনতার আদালত বলছেন - এটা পাকিস্তানের মিথ্যাচার। তারা
জনতার আদালতের যা চায় :
পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ সৈন্যের বিচারের জন্য জনমত গঠন করা, পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা।
নারী নির্যাতন সহ সকল ক্ষয় ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দাবি। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সকল অর্থ সম্পদের হিস্যা দাবি।
পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত হামিদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ।
বাংলাদেশের ৭১ এর গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি।
বাংলাদেশে আটকে পড়া অবাঙালিদের পাকিস্তানে ফেরত নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা।
পাকিস্তান দূতাবাসে যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনে শাস্তির দাবি।
পাকিস্তানের সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করা এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা।
পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান।
যারা এখানে পাকিস্তানের পক্ষ নিচ্ছে তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ব্যবস্থা করা।
১৯৭১ পরবর্তি সময়ে যারা এখানে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অপরাধ সংগঠিত করেছে তাদের জন্য বিশেষ আদালত গঠন করে বিচারের দাবি জানানো।
জামাত-শিবিরের যে সব অপরাধী নেতা এবং যুদ্ধাপরাধী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে তাদের অপসারণ।
বিচার সম্পন্ন হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত ইসলামি সহ সকল সংগঠন নিষিদ্ধ করা।
জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা ও তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
এলাকায় এলাকায় জঙ্গীবাদবিরোধী নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা এবং চিহ্নিতদের আইনের হাতে সোপর্দ করা।
৭২ সালে চিহ্নিত ১১ হাজার দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী ও সম্পত্তি জবর দখলকারীদের প্রতিরোধ ও তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া।
জঙ্গীবাদী সংগঠন সহ সকল সাম্প্রদায়িক শক্তিকে অর্থ যোগানদাতাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রবাসী বাঙালিদের উজ্জীবিত করা।
বাংলাদেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকারকারী ও ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইন পাশ করা।
চট্টগ্রামে আয়োজিত জনতার আদালতের প্রথম সভায় নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বরেণ্য সাংবাদিক আবেদ খান, এম এ লতিফ এমপি, শিরিন আখতার এমপি, রোকসানা ইয়াসমিন এমপি, রোকেয়া প্রাচী, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান ইসমত কাদির গামা সহ বিভিন্ন পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ‘জনতার আদালত’ গঠনের প্রস্তুতি সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। কর্মসূচীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একাধিক পেশাজীবী সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
মার্চের মধ্যেই বিচারের রায় ঘোষণার লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগে মুক্তিযোদ্ধা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়, ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের লালদীঘিতে সমাবেশ, ১৭ জানুয়ারি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তাারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে সভায় জানানো হয়।
সংগঠনটির আহ্বায়ক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। চট্টগ্রামে এটির আহ্বায়কের জন্য আ জ ম নাছির উদ্দিনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
তারা সভায় বলেছেন- আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার হিসাবে চট্টগ্রাম থেকে এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরপর বিভাগীয় পর্যায়ে তারা সভা সমাবেশ করবে।