সাধারণত রিক্সায় উঠি না আমি। এমনিতেই দরকার পরে না তার উপর উঠলে মনে হয় এই বুঝি চাল কুমড়ার মতো গড়িয়ে পড়ব। এটা অবশ্য হয়েছে অনভ্যাস এর কারনে। আরেকটা কারন ও আছে অবশ্য। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ হয়ে যাবে। আজকের বলা ঘটনার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
যাই হোক, যে দিনের কথা হচ্ছে সেদিন না উঠে উপায় ছিল না। বেশ বয়স্ক একজন লোক। এই বয়সে আসলে মানুষ জন কথা বলতে পছন্দ করে কিন্তু বোধকরি শোনার লোক কমে যায়। যদিও এটা আমার ধারণা, ওই বয়সে না পৌছালে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। উনি বোধহয় আজ বলার মুড এ ছিলেন। আমি শুনতে চাই কিনা জিজ্ঞাসা না করেই নিজের মতো গল্প শুরু করে দিলেন। আমি এদিকে গভীর চিন্তায়, কুমড়ো পটাশ না হয়ে গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে। এর মধ্যে আবার রাস্তা কাটা, কে যে কাটছে তাও জানি না। শুধু একদিন দেখি অর্ধেক রাস্তা নাই। নিজের এলাকায় গড়াগড়ি খেলে ইজ্জত এর বারোটা বাজার সমূহ সম্ভাবনা। শক্ত হাতে রিকশার এক সাইড ধরে আমি হু হা করছি আর কিছুটা বিরক্ত ও হচ্ছি।
হঠাৎ কানে এলো বাবা বিয়ে করছেন? আমি উত্তর না দিয়ে বিরক্ত হয়ে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি? উত্তরে যে হাসি শুনলাম তার টোন আমার খুবই পরিচিত। নিজের খুব পছন্দের বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় মানুষ এই হাসিটা দেয়। আমার আগ্রহ বাড়ল। জিজ্ঞাসা করলাম চাচা কি প্রেম করে বিয়ে করেছেন? উত্তরে তিনি রিক্সা একটু স্লো করে আমার দিকে তাকিয়ে আবার ওই হাসি দিলেন, এবার আরো জোরে। " বাবা আমি বিয়ে করসি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে , আপনের চাচীর বাড়িতে আমি কামলা দিতাম। আমি মূর্খ মানুষ আর তারা সেই সময়েই মেয়েদের পড়াশুনা করাইতো। সে তখন ক্লাস ফাইভ এ পড়তো। কিভাবে জানি না আমাকে তার পছন্দ হয়া গেলো। কিন্তু তার বাড়ির লোক তো মানবে না , তাই আমরা পালাইলাম "
আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম , ওই বয়সে? তার উত্তর, " বাবা তখন তো মানুষ অল্প বয়সেই সব করতো, এখনের মতো এতো সময় নিতো না।" তারপর?
"তারপর আর কি , তার দাদা খুব প্রভাবশালী ছিল, টের পায়া পিছনে লোক লাগাইলো। সেই রাত দুপুরে আর্মির একটা জীপ্ যাইতেসিলো। তাগো থামায়া আমগো আমার পরিবারের অসুখ বইলা উইঠা পড়াতে বাইচা গেসি। নাইলে মারা পড়তাম। "
আমার আবার প্রশ্ন , তারপর? " তারপর আর কি? সেই যে ঢাকা আসলাম, আর যাই নাই। আমার তো বাড়ি ছিল ই না, তার টা সেও ভুইলা গেসে। ছেলেরা বড় হয়া ছাইড়া গেসে। এখন আবার আমরা দুইজন। তাই এই বয়সে আবার রিক্সা চালাই। "
খারাপ লাগে না মাঝে মধ্যে আপনাদের, এতো কষ্টের জীবন? এইবার তিনি রিক্সা থামিয়েই দিলেন। আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন, আবার যদি আল্লাহ এই অবস্থায় ফালায় আবার একই কাজ করমু। আমি বললাম কেন? "এই যে রাইতে তার কাসে যামু সারাদিন রিক্সা চালায়া, আমার নিজেরে আবার জুয়ান মনে হইবো। খালি আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া , আমারে যাতে তার পরে নেয়; সেতো আর এইরকম কাজ করতে পারবো না।"
একটু আগেই শ্রেণী বিভেদের কারণে রিক্সাওয়ালার কথায় বিরক্ত হওয়া আমি মুখে নুন পড়া জোকের মতো রিক্সা ধরা হাত কখন ছেড়ে দিয়েছি বলতে পারবো না।
সুখের সংজ্ঞা নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



