somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যাপিত জীবন -০২

১০ ই মে, ২০২২ সকাল ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নওগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি হলাম। বিশাল এক স্কুল ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্ট। ময়মনসিংহ এর খুপরি মতো স্কুল থেকে এসে বিশাল সমুদ্রের মতো এক স্কুলে ভর্তি হয়ে পাংগাশ মাছের মতো খাবি খেতে লাগলাম। সারাক্ষণ চিল্লাচিল্লি লেগেই আছে কখনো শিক্ষক চিল্লান কখনো ছাত্রছাত্রী চিল্লায়। প্রথম যেদিন স্কুলে গেলাম ভেবেছিলাম প্রথম বেঞ্চে বসবো কিন্তু প্রথম বেঞ্চ আগেই দখল হয়ে আছে গুনে গুনে পঁচিশ টা বেঞ্চ পার হয়ে এক কোনায় বসার সুজুগ পেলাম। সহপাঠীদের আমার একদম পছন্দ না আমি নিশ্চিত সবগুলা আমার থেকে বড়। আমার পাশের জন তার ভাংগা দাত দেখিয়ে বললো আমার সাথে লাগতে আসিস না দাত ভেংগে দেব। আমি নিজেকে যতটা পারি ছোট করে ফেললাম। স্কুল ছুটির ঘন্টা পরতেই যেন পায়ে পাখনা গজালো। উড়ে বাড়ি চলে এলাম এবং ঠিক করলাম আমি আর পড়াশুনা করবো না।

বড়দা হাই স্কুলে ভর্তি হলো। তার মন একদম ভালো না। শিউলি আপার জন্য খালি কেমন কেমন করে।চিঠির পর চিঠি লিখে যাচ্ছে কোন জবাব পাচ্ছে না। আমাকে বললো সে নাকি একাই ময়মনসিংহ যাবে। আমি ভয়ে চোখ বড় করে বললাম দাদা এই ভুল করিস না বাবা পিঠের ছাল তুলে নেবে। ছোহ আমি কি তোর বাপরে ডরাই নাকি, মাথায় একটা রুমালের মত কি একটা বেধে রাখে সারাক্ষন।ওটা নাকি শিউলি আপা দিয়েছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে ভাবছি রাতে বড়দা ঘুমালে চুপিচুপি গিয়ে ওটা চুরি করতে হবে। দুই তিন বার একশানে নেমেও সুবিধা করতে পারি নাই। বড়দা যে ওটা কোথায় লুকিয়ে রাখে কে জানে।

বাবা নওগাঁ এসে বিশাল একটা কাজ করে ফেলেছে। তিনি দুইতালা একটা মাটির বাড়ি ভাড়া করে ফেলেছে। বাড়িটা শহর থেকে বেশ দূরে। হাটা পথে মাইল দুই হবে। প্রতদিন আমাদের দুই মেইল হেটে স্কুলে যেতে হবে ভেবে এখনি আমার পা ব্যাথা করছে । বড়দা আফসোস করতে লাগলো ময়মনসিংহ থেকে হেড লাইটের বাঁকি পার্ট গুলে আনতে পারলে একটা মটর সাইকেল বানিয়ে ফেলতে পারতো তাহলে দুই ভাই মিলে মটর সাইকেলে স্কুলে যেতে পারতাম। আম্মা খুব খুশি। তিনি উঠে পরে লেগেছেন বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে। বড়দার মুখ দেখে বুঝতে পারছি তার বাড়ি পছন্দ হয় নাই। আমার অবশ্য এমন কিছুই মনে হয় নাই তবে অঞ্জু খুব খুশি সে মোটামুটি পুর বাড়ি জুড়ে চার হাত পায়ে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর যা পাচ্ছে তাই মুখে দিয়ে জিভ আর ঠোঁট দিয়ে ফুরুত ফুরুত করে অদ্ভুত শব্দ করছে। এটাই মনে হয় ওর আনন্দ প্রকাশের ভংগী। বাবা খুব গাম্ভীর্যের সাথে আমাকে আর বড়দা কে বুঝালেন মাটির বাড়িতে থাকার নানান বৈজ্ঞানিক উপকারিতা। মন আর দেহ শান্ত থাকে। আয়ু বাড়ে ইত্যাদি। বড়দা ফিসফিস করে বললো অন্যকারো আয়ু বাড়ুক আর না বাড়ুক অঞ্জুর বাড়বে ও যেভাবে পোকামাকড় খাচ্ছে কয়দিন পরে ও চীনে চলে যাবে আর চীন দেশের সবার আয়ু ১০০ বছর। আমি অবশ্য বড়দার কথা বিশ্বাস করি নাই। সবকিছুতে বাড়িয়ে বলা ওর স্বভাব।

দুইবেলা করে আম্মা মাটির বাড়ির উঠান ঝার পোছ করতে লাগলেন। উপর নিচ মিলিয়ে মোট ছয়টা রুম বাড়িটার। বড়দা গম্ভির ভাবে বললো সে উপর তলায় থাকবে। আমারো ইচ্ছা হচ্ছিলো কিন্তু বাবার কড়া আদেশ নিচে একজন থাকা চাই অগ্যত আমার আর কি করা। বাড়ির চারিদিকে বড় বাগান। বাগান আমার একদম পছন্দ না, সারাক্ষণ কেমন নিরব নিরব একটা ভাব আর ঝিঝি পোকার ডাকাডাকি। এলাকার অনেকেই বলে আমাদের বাড়িটা নাকি ভুতের বাড়ি এই জন্যই সস্তায় আমরা বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেছি। আম্মা শুনে একটু গাইগুই করেছিলেন বাবার ধমকে আম্মা একদম চুপ। আমার ভুতে ভিষন ভয়। রাতে ঘুমানোর আগে দুনিয়ার সব জানা না জানা সুরা দোয়া পরে ঘুমাতে যেতাম।

মাটির বাড়িতে থাকলে আয়ু বাড়ে কিন্তু বাবার আয়ু কয়দিন পরে একদম থেমে গেলো। হঠাৎ করে বাবা কাউকে কিছু না বলে মারা গেলো।বাড়ির পেছনে লতা পাতা সাফ করে ওখানেই আব্বা কে কবর দেয়া হলো। সবাই বলাবলি করছে আমরা এতিম হয়ে গেছি। আমি বড়দা কে জিজ্ঞাসা করলাম দাদা আমরা কি এতিম খানায় থাকবো এখন থেকে। বড়দা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো না আমরা একসাথে এই বাড়িতে থাকবো। আম্মা একদম চুপ হয়ে গেলো। অঞ্জু সারাদিন কান্নাকাটি করলেও ফিরে তাকায় না। আমি অঞ্জু কে নিয়ে বনে বাদারে ঘুড়ে বেড়াই। অঞ্জু এখন কথা বলতে পারে। আমাকে ভাভা ডাকে আর বড়দা কে খালি দা ডাকে। তিনদিন ধরে আমাদের বাসায় কোন রান্না নাই। খুধায় পেট কেমন জানি করে। চোখ বন্ধ করলেই ভাতের থালার ছবি দেখি। পানি খেয়ে খেয়ে দিন পার করছি। আম্মা বিছানা নিলেন। বড়দা কিছু একটা করার চেস্টা করছে, প্রতিদিন বলে যাচ্ছে আজ দেখবি বিল্টু দানে দানে ছক্কা মেরে আসবো কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় ক্লান্ত দাদা ফিরে আসে। আমি জানি দাদা কিছুই করতে পারবে না তারপরও আমি অপেক্ষায় থাকি দাদার।

আম্মা মনে হয় মরে যাচ্ছে। ঘর থেকে একদম বেরুচ্ছে না। না খেয়ে থাকতে থাকতে শুকিয়ে গেছে। একবার দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখেছিলাম সাদা একটা কিছু বিছানায় পরে আছে মনে হলো। আজকলা আঞ্জু আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। আম্মার কোলে যেতে চায় না। আমি বনের ভেতর কিছু ফল খুজে পেয়েছি খুব খুধা পেলে লুকিয়ে গিয়ে খাই। আঞ্জু আমার পেছন পেছন যায়। ওর খুধা পেলে মুখের ভেতর আংগুল দিয়ে চুষতে থাকে। আম্মা যে ঘরে থাকে তার দরজার কছে আমি বসে আঞ্জুর সাথে খেলছিলাম। হঠাত আম্মার গলা শুনতে পেলাম আম্মা ফিসফিস করে আমাকে ডাকছে। আমি ভাবলাম আম্মা মারা যাচ্ছে। আম্মা আমাকে একটা কাগিজ দিয়ে বললেন এখানে নানার ঠিকানা আছে সেই ঠিকানায় একটা চিঠি লিখতে। আমি কখনো চিঠি লিখি নাই। কি করে লেখে জানি না। তারপরেও লিখলাম প্রীয় নানাজান, উনি আমার প্রীয় কি না জানি না। খালি নানাজান লিখলেও হতো অথবা খালি নানা। আব্বার মৃত্যুর সংবাদ আর আমরা না খেয়ে আছি জানিয়ে চিঠি লেখা হলো। কিন্তু পোস্ট করবো কোথায় জানা নাই। আম্মা বড়দার কথা বললেন সামসু এসে পোস্ট করে দেবে। শির্ন কাপা পায়ে আম্মা উঠে দাড়ালো। আঞ্জুকে কোলে নিয়ে ঘরের এক কোনা থেকে চাল এনে চুলায় বসিয়ে দিলেন। গরম ভাতের গন্ধে মন ভরে গেছে। আজ অনেক দিন পরে ভাত খাবো। বড়দা সন্ধ্যায় হাতে করে একটা বড় রাজহাস নিয়ে এলো। বললো এটা আজ জবাই করে ভুনা করা হবে। রাতে পুলিশ এসে বড়দা কে ধরে নিয়ে গেলো। বড়দা নাকি কোন বাড়িতে চুরি করে হাস ধরে বাজারে বেচে দিয়েছে।

দুই বছর তিন মাস পর নানা এলো। ততদিনে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। বড়দা পার্মানেন্ট ভাবে চোরের দলে নাম লিখিয়ে ফেলেছে। বছরের দুই তিনবার জেলে যাচ্ছে আবার হাসিমুখে বেরও হচ্ছে। আমাকে প্রায় বলে কি করলি রে বিল্টু আমাদের দলে নাম লেখা একটা অপারেশন করে আসি চল। আমি হাসি দিয়ে এড়িয়ে যেতাম। নানা বাড়ির উঠানে পা দিয়ে কেঁদে দিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ খুব কাদলেন। কিন্তু আমি অনেক খুশি আমাদের অভাবের সময় শেষ তাই। নানা হাত ভর্তি করে বাজার করলেন, চালা ডাল সব কিনলেন। বড়দা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে নানা কে দেখে জিজ্ঞাসা করলো ওই ওল্ডফেলো কখন আসলো। বড়দা আজকাল কথায় কথায় ইংরেজি বলে। আমাকে সেদিন ইয়াং ম্যান বললো। আম্মা বড়দার কোন কিছুই ছুয়ে দেখে না। বড়দা কিছু আনলে খান না। বড়দা হাসি দিয়ে বলে ওল্ড উইম্যান গুড ফর নাথিং কি এখনো এংরী। আমি আর আঞ্জু বড়দার আনা সব খাবার খাই। আঞ্জু আজকাল খুব চকলেট খেতে চায় , বড়দা পকেট ভর্তি করে চকলেট আনে কেবল যে কয়দিন জেলে থাকে তখন অঞ্জু আমার সাথে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। আনজু আজকাল কটকট করে কথা বলে। আম্মার কাছে তেমন একটা যায় না ।

নানা আবার আসবেন বলে চলে গেলো সাথে করে আমাকে নিতে চাইলো কিন্তু আম্মা রাজি হলো না আমি কিন্তু রাজি ছিলাম আমার খুধা একদম সহ্য হয় না আম্মা আমার হাত শক্ত করে ধরে বসে রইল। আম্মা জানালার পাশে বসে থাকে নানার অপেক্ষায় আমার কেনো জানি মনে হলো নানা আর আসবে না।

আগের পার্ট

যাপিত জীবন-০১
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২২ সকাল ১১:৫৯
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×