একটা সময় ছিলো যখন বছরের তিনটি দিনের জন্য ভীষন অপেক্ষা। গ্রামে ফকিরবাড়ির মেলা। আব্বার কাছে সারাদিন ঘ্যন ঘ্যন করতাম মেলায় নিয়ে যাবার জন্য। প্রথম দুইদিনে না পারলেও শেষের দিন আব্বাকে আর বলা লাগতো না। ঠিকই শেষের দিন বিকেলে আব্বা এসে বলতেন চল মেলায় যাই। কত যে খুশি লাগতো তখন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। আব্বার হাত ধরে মেলায় যেতাম। কিছু কিনতে চাইলে আব্বা কোনটাই না করতেন না। অনেকক্ষন ঘোরাঘুরির পরে আব্বা বলতেন এবার চল কিছু খাই। মিষ্টির দোকানে ঢুকে জিলাপি আর পেটের ভেতরে বিচিওয়ালা মিষ্টি বাদ যেতোনা কোন বার-ই। আসার পথে দুই বাপ বেটার দুইহাত ভর্তি থাকতো মেলার খেলনা দিয়ে। মাঘের শীত যেন আমায় গায়ে না লাগে তাই আব্বা আমার জ্যকেটের ওপর দিয়ে নিজের চাদর পেচিয়ে দিতেন। সাঙ্গ হতো মেলা দেখার পালা।
যখন আরেকটু বড় হলাম।
বন্ধুদের সাথে বিকেল বেলায় মেলায় টুকটাক আনাগোনা। আবার সন্ধার আগেই বাড়িতে পড়ার টেবিলে আমি। মা ঠিকই জানতেন কিন্তু আব্বা টের পেতেন না। তখন আব্বাকে জোর করে বলতেও পারিনা মেলায় যাবার কথা। কারন তখন আমি ততটা ছোট নেই। আমার ছোটবোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়তো, না আমিতো এখন বড়ভাই। বায়না ধরলে ও ধরবে। আমি কেন? তারপরেও বাচ্চামি স্বভাব কি আর যায়? প্রথম দিন অনেক কষ্টে পার করলেও দ্বিতীয় দিন ঠিকই আব্বার কাছে মেলায় যাবার আবদার করে বসতাম। গম্ভীর দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে হ্য, না, কোনটাই বলতেন না। কিন্তু ওই যে শেষের দিন তো রয়েছেই। আমার ভুল হলেও আব্বার ভুল হতোনা। ঠিকই নিয়ে যেতেন। কিন্তু এবার একটু রাত করেই ফেরা হতো বাসায়। কারন আমি কিছুটা বড় হয়েছি তখন।
আরেকটা সময়ে,
আমি একাই মেলায় যাই। রাত করে মেলা থেকে ফিরি। আব্বার কাছ থেকে মেলায় যাবার জন্য টাকা চাইলে না করেন না। পাছে আমি আব্বাকে বলতেও পারিনা যে আব্বা মেলায় চলো। এদিকে বন্ধুরা কি মনে করে! কিন্তু ঠিকই একদিন বাবা রাতে এসে বলতেন, শোভন মেলায় যাবি? এক লাফ মেরে উঠে দাড়াতাম। গভীর রাতে মেলায় আর ঘোরা হতোনা। হতোনা দুইহাত ভর্তি খেলনা কেনাও। গানের আসরে বসে পড়তাম আব্বার সাথে। বাদাম চিবোতে চিবোতে কখন যে অনেক রাত হয়ে যেত টের পেতাম না। অামার চোখের কোনায় লাল দাগে ঘুমের আবেশের ঘনঘটা দেখে আব্বার আর বুঝতে বাকি রইতোনা যে এখন বাড়ি যাওয়া দরকার।
মেলা থেমে রয়নি। এখনো মেলা হয়। কিন্তু আব্বার হাত ধরে তো দুরে থাক, গত চার বছর সেই প্রানের মেলা দেখার সৌভাগ্য আর হয়ে ওঠেনি। পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকায়, প্রানের মেলা বসে সেই জোকা গ্রামটায়। আব্বার হাত ধরে বিলের মাঝ দিয়ে আর হেটে যাওয়া ও হয়নি মেলায়। প্রবল ইচ্ছেটা বড় হওয়ার বাসনায় মাটি চাপা দিয়ে দেই। একটা মুখের দিকে তাকিয়ে।
বাবা,
সত্যিই তোমায় ভালোবাসি। বিশ্বাস করো আমার বিন্দুমাত্র ভালো কাজের বিনিময়ে যদি বিধাতা আমায় আরেকবার সেই ছোট্টটি করে দিতেন, আমি যদি তোমার হাত ধরে আবার মেলায় যেতে পারতাম! জানো বাবা? লিখতে গিয়ে চোখের পানি পড়ছে খুব। কেন জানিনা। আমিতো ভালো আছি অনেক। তবে চোখের কোনে পানি কেন? জানি তোমার কাছে এই লেখা পৌছাবে না কখনোও। কিন্তু একটা কথা মানি। তোমার এ ভালোবাসা কখনোও মলিন হবেনা, হবেনা তোমার প্রতিটা ভালোবাসার অবমুল্যয়ন।।।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ২:১৬