একবার চাকরীর সাক্ষাতকার দিতে গেলাম একটা চাইনিজ মালিকানার গণমাধ্যমে। মানে তাদের কার্যক্রম বাংলাদেশে। জীবন বৃত্তান্ত (সিভি) দেয়ার পর থেকেই একটু ভয়ে ছিলাম, চাইনিজ ভাষা জানতে হবে নাতো? ভেতরে ঢুকে তো পুরোপুরি ভড়কে গেলাম। চাইনিজ এক সুদর্শনা দাঁড়িয়ে। আমি তো এবার পুরোটাই শেষ। কিন্তু অবাক করে দিয়ে সেই নারী আমায় বললেন- পাশের কক্ষে গিয়ে বসো (সবাইকেই তুমি সম্বোধন করেছিলেন)। সময় হলে পরীক্ষার জন্য ডাক দেয়া হবে। আমি যেন প্রাণ ফিরে ফেলাম। পুরো পরীক্ষা বাংলায় হলো। সাক্ষাতের জন্য ডাক দেয়া হলো ভেতরে। চাইনিজ সেই মহিলা পুরো সময়টা আমার সাথে বাংলায় কথা বললেন। আমি একবার প্রশ্ন না বুঝতে পেরে 'সরি' বলায় তিনি ইতস্ততবোধ করলেন। পাশে বসা আরেকজনকে বলেই ফেললেন- আমার বাংলা কী বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? আমার বাংলা কী এতটা অস্পষ্ট? বিশ্বাস করেন আমি লজ্জা পেলাম ভীষণ। আমি দুঃখিত বলে আবার প্রশ্ন করতে বললাম। চাকরীটা আমার হয়নি। তবে শিক্ষা হয়েছে বেশ। পুরোটা সময়জুড়ে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তার বাংলা শুনছিলাম। যতটা গর্ব হয়েছে আমার ভাষা নিয়ে, ততটাই লজ্জাবোধ নিয়ে ফিরে এসেছি সেদিন।
আরেকটা গল্প। বাংলাদেশেরই একটা সনামধন্য সংস্থায় গেলাম সাক্ষাতকারে। কাজ প্রবন্ধ লেখা। অবশ্যই ইংরেজিতে নয়। জামার সাথে শোভাবর্ধক গলাবন্ধনী (টাই), সাথে ব্রিটিশদের কালো জুতো। বাবারে বাবা, আপাতদৃষ্টিতে নিজেকে দেখেই মনে হচ্ছিলো হ্যাঁ সত্যিই দেশটা এককালে বৃটিশরা শাষন করে গিয়েছে। যাইহোক, ভেতরে ঢুকে সালাম দিলাম। উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। বললেন -সিট ডাউন, গিভ মি ইউর সিভি। আমি আমার বৃত্তান্ত এগিয়ে দিলাম। তারপরে যা যা হয় তা আপনাদের বোঝার বাকি নেই। বকনা বাছুরের মত কিছুক্ষণ ইংরেজি আওড়ালাম। যদিও আমার ইংরেজী অতটাও খারাপ না। তারপরেও কেন জানি মনে হচ্ছিলো বলছি ঠিকই, কিন্তু গলার মাঝে ভাবটা আটকে আছে। আচ্ছা, কেন তারা ইংরেজিতে সাক্ষাতকার নেবেন আমার? কী প্রয়োজন এখানে ইংরেজির? আমি নিশ্চই ইংল্যান্ডের দূতাবাসে চাকরী নেয়ার জন্য যাইনি। তাহলে কেন? আমি প্রশ্ন করতে পারিনি।
ভালো একটা চাকরী চাই তো ইংরেজি শেখা বাধ্যতামূলক। দেশের যে কোন 'প্রাইভেট' থেকে শুরু করে 'পাবলিক' বিভাগেও ইংরেজি চাই ই চাই। মানে বাংলাটা তোমার হোক আর না হোক, ইংরেজিটাই অবশ্যই চাই বাপু। জার্মানি যেতে চাও, জার্মান ভাষা শেখো। স্পেনে যেতে চাও, তো স্প্যানিশ শেখো। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অস্ট্রেলিয়া যেতে চাও তাহলে ইংরেজি শেখো। বাংলাদেশে যেতে চাও, কিচ্ছু শেখার দরকার নেই তোমার। ওরাই তোমার জন্য তোমার ভাষাটা শিখে নেবে। এর পেছনে কারণ জিজ্ঞেস করলে হড়হড় করে শিক্ষিতরা বলে দেন- তোমরা পিছিয়ে আছো তাই তোমাদের অন্য ভাষা শিখতে হয়। তোমরা শিখতে বাধ্য। কথা মিথ্যে না হলেও আমার গাত্রদাহ রয়েই যায়। বাংলাটা কী এতই নিচু কোন ভাষা যেটার মূল্য ওদের কাছে কানাকড়িও নেই?
এরকম আরও শত অভিজ্ঞতা আছে আমার। প্রিয় বাংলাকে আমি ফেসবুক কিংবা ব্লগে নয়, মন থেকে ভালোবাসি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই বায়ান্নকে। ভাষা এবং মা দিবসটা আমি বছরের ৩৬৫ দিনেই করে নিয়েছি। এটা উদযাপন করতে আমার আলাদা কোন দিবস লাগে না। আমার পৃথিবীটা আমার নিয়মেই চলুক।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৯:২৬