শ্রীমঙ্গলের চা বাগান। চারিধারে আর কিচ্ছু নেই শুধু চা গাছের পর চা গাছের সারি। কোথাও কেউ নেই, নিঝুম পল্লী। একেই বলে মাইলের পর মাইল চা বাগান। এর যেন শুরুও নেই শেষও নেই।
রফিক আর আযাদ, দুই বন্ধু, বৈশাখের শুরুতে চা বাগানের এক বাংলোতে থাকতে এসেছে। রফিকের আপন মামা এই চা বাগানের ডাক্তার। তিনি চা বাগানের শ্রমিকদের চীকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। রাতে যখন রফিক আর আযাদকে বহনকারী গাড়ি মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে এই বাংলোতে এসেছিলো, তারা কিছুই দেখেনি। সকাল বেলা উঠে, মামা স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবার সময় বলে গেলেন, চা বাগানের ভেতরে যেওনা, সাপ খোপের ভয়, তার উপর সব থেকে বড় ভয় হলো হারিয়ে যাবার। এখানে হারালে আর খুজে পাবে না কিচ্ছু।
রফিক বাংলোর বারান্দায় বসে সকালের চা খাচ্ছিলো আর বিস্মিত চোখে চা বাগানের বিশালতা দেখছিল। গোসল সেড়ে আযাদ যখন এলো, তখন রফিকের মামা ইদ্রিস আলী উঠে দাড়ালেন। ইয়ং ম্যান, তুমি শহর থেকে এসেছো, এই নীরবতা এনজয় কর। আমি ৫টার মধ্যে চলে আসব।
ইদ্রিস আলী প্রস্থান করার পরই আযাদ রফিককে বলল, কোন দিকটায় যাওয়া যায়? রফিকের বিস্ময় তখনও কাটেনি। এই বাংলাদেশে এমন সুনশান জায়গা আছে এ যেন তার কল্পণার অতীত। সে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বলল, কোন দিকে যাবে মানে? সব দিক তো এক!
আযাদের চোখ জ্বল জ্বল করছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। সে বারান্দার কিনারায় এসে একটা খুটি ধরে বলল, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...চল আজ হারিয়ে যাই।
রফিক স্বভাবে ভীতু টাইপের। আযাদ ঠিক তার উল্টো। সে যেন কিছুকেই ভয় পায় না। রফিক বলল, এখন বৈশাখ মাস, সবে মাত্র সাপেরা বের হয়েছে...কথাটা বলতেই রফিকের চোখ আটকে গেল একটা লোকের দিকে। সে বারান্দার পশ্চিম কিনারায় দাঁড়িয়ে ঠায় ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আযাদ লোকটিকে খেয়াল করেনি। সে বলল, এই সবুজে সাপের কামড় খেয়ে মরলেও তো শান্তি। চল উঠ! আর দেড়ি নয়। রফিক বলল, দেখতো, এই লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
লোকটা এ কথা শুনেই দেয়ালের আড়ালে চলে গেল। আর এই জন্যেই হয়ত আযাদ লোকটিকে আর দেখল না। তার চোখে তখন নেশা, আরে সব কথা পড়ে হবে, আগে চল।
চা বাগানের ভেতর দিয়ে দূরের পথে রওনা হলো দুই বন্ধু রফিক আর আযাদ। তাদের কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। তারা চলছে যেন অজানার সন্ধানে। রফিকের ভয়টা যেন একটু দূর হয়েছে, হয়ত প্রকৃতির কাছে এসে আর ওসব কিছু মনেও হচ্ছে না। তবে রফিক বুদ্ধি করে প্রত্যেকটা গাছ দেখে রাখছিল। বাড়ি ফেরার পথ যেন ফিরে পেতে পারে।
প্রায় তিন-চার ক্রোশ দূরে যখন তারা চলে এলো, তখন নিজেদেরকে মাইলকে মাইল চা বাগানের ভেতর আবিষ্কার করল। এ চা বাগানের কোন সীমা পরিসীমা নেই যেন। আযাদ একটা ছোট্ট টিলার উপরে বসল। রফিক তার পাশে বসে হাপাতে হাপাতে বলল, চল এবার ফেরার পালা। আযাদ বলল, ঐ দেখ!
রফিক আযাদের আঙ্গুলি নির্দেশিত স্থানে তাকাতে দেখল, একটা বিশালাকার বটগাছ। তার পাশেই একটা মঠের ঠিক ২০ গজ দূরে একটা খোলা জায়গা।
-এটা কি মন্দির?
-নাহ! এটা মন্দির না, এটা শ্মশান।
-কেমনে বুঝলি?
আযাদ উঠে দাঁড়াল, চল তুই দেখলেই বুঝবি।
এমন সময় ঘটলো প্রথম বিপত্তি। প্রচন্ড শব্দে আকাশ আর্তনাদ করে উঠলো। চারিদিকের গাছপালা মুহুর্তেই যেন নড়ে উঠল শব্দে, এ শব্দ যেন আন্দোলিত হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে! আযাদ এগিয়ে যাচ্ছে মঠের পাশের খোলা স্থানটার দিকে। রফিক আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না আযাদ, আকাশের অবস্থা ভালো না, আর এটা বৈশাখী ঝড়ের সময়।
আযাদ বলল, আরে রাখ তোর ঝড়, কাল বাদ পরশু শহরে চলে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি আয়, এসব জায়গার কথা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসেই পড়ছিস। কোনদিন চোখে দেখছিস?
রফিক যেন কৌতুহলি হয়ে উঠলো। মঠ থেকে ২০ গজ দূরে খোলা জায়গাতে যেতেই তারা দেখল, আসেপাশে ভেজা পুরানো কাঠের কয়লা। আযাদ সেখান থেকে একটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখলো। পকেটে ভরলো, দেখ শহরে নিয়ে দেখানো যাবে বন্ধুদের।
এইবার আকাশের মাতম বেড়ে গেল। গাছপালা বাতাসের তোড়ে উড়ে যেতে চাইল, বাতাসের ঝাপটায় রফিকের সত্যি গা ছম ছম করে উঠলো। রফিক বলল, প্লিজ দোস্ত, অনেকটা পথ যেতে হবে, ঝড় আসছে, বাংলোতে যেতে পারব না ঝড়ের আগে।
আরে রাখ তোর ঝড়। দেখ না পৃথিবী কেমন আয়োজন করেছে। কি বীভৎস হচ্ছে প্রকৃতি! কি আশ্চর্য ভয়ের কি আছে রে?
রফিক বলল, তুই না যাবি, আমার যেতে হবে। আমি একাই রওনা দিব।
আযাদের বিরক্তি লাগল। সে বলল, আরে ঝড় আসবে না! এমন সময় প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল। রফিক বলল, আমি গেলাম। আযাদ বলল, একটু দাড়া জাস্ট দুই মিনিট। কিন্তু প্রকৃতির দুই মিনিট সময় নেই। প্রকৃতি তার সমস্ত আয়োজন করেছে, এবার উথাল-পাথাল হবার পালা। ঝড়ের প্রথমটায় রফিক আর আযাদকে যেন উড়িয়ে নিতে চাইলো। তারা বট গাছের নিচে আশ্রয় নিল।
তবে দ্বিতীয় বিপত্তি শুরু হয়ে গেছে। প্রচন্ড শব্দে গাছপালা নড়ছে। ঝড়ের প্রথম ধাপ এটি। রফিক চীৎকার করে বলল, আমাদেরকে রওনা হতে হবে। এর মধ্যেই। কোন উপায় নাই। আযাদ উত্তর করল না। সে ঘড়ির দিকে তাকাল! বলল, রফিক তোর ঘড়িতে ক'টা বাজে দেখত?
-আরে! ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে!
-আযাদ হাসল, আমারটাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা মহাকালে হারিয়ে গেলাম মনে হয়!
-তুই এসব বলিস না, এখনই বৃষ্টি নামবে, তাড়াতাড়ি রওনা হই।
রওনা তারা হলো, যে পথে এসেছিল হিসেব মত সে পথে হাটা শুরু। তবে বাতাসের তোরে আর হাটতে পারছে না। আযাদ বলল, একই সাথে দুইটা ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেল কেন?
রফিক চিল্লায় উত্তর দিলো, ওসব নিয়ে ভাবার এখন সময় না। তাড়াতাড়ি হাটো।
বৃষ্টি শুরু হতেই এই গহীন চা বাগানে এক অলীক শব্দ শুরু হলো। দূরে কোথাও তক্ষক ডেকে উঠল। কুকুরের ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। আসেপাশেই কোন লোকালয় আছে। বৃষ্টি থামার নাম নেই, তবে বিপত্তি আরেকবার প্রতিভাত হলো। আযাদ আর রফিক, ভুল পথে চলে এসেছে। তাদের সামনে মাইলকে মাইল চা বাগান, রফিক চীৎকার করে বলল, আমি পথে ভুল করছি, ঐ বাক টা থেকে ডাইনে যেতে হবে, আসার সময় বায়ে এসেছিলাম। চল ফিরে যাই।
আযাদের দৃষ্টি স্থির হয়ে কিছু একটা পরখ করছে। দূরে একটা টিলার মত উচু জায়গা। সেখান থেকে দশ বার জন লোক নামছে, তাদের মধ্যে চারজনের কাঁধে খাটিয়া। রফিক এতক্ষণে খেয়াল করল! আযাদ? ওরা কারা?
আযাদ বলল, শ্মশানে যাচ্ছে লাশ নিয়ে!
-এই বৃষ্টি ঝড়ের মধ্যে?
-হুম।
-তুই দাঁড়ায় থাকবি?
-হুম!
-কি বলতেছিস?
আযাদ স্থির, বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে, রফিক, তুই বাড়ি যা, আমি এখন আসব না।
-এসব যাতা বলিস না, আমি একা যাবো কেমনে?
-তুই যেতে পারবি না রফিক, আমাদের দুইজনের ঘড়িই একই সাথে বন্ধ হয়ে গেছে, পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখ, বন্ধ, আমরা সম্ভতত সময়ের মধ্যে নেই!
কথাগুলো রফিকের হাস্যকর লাগল। ইতোমধ্যে টিলা থেকে লাশ নিয়ে আসা লোকগুলো তাদের ৩০ গজের মধ্যে চলে এসেছে। আযাদ তখনও স্থির দৃষ্টি মেলে আছে।
ঝড়ের তীব্র বেগে সব উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে যেন। বৃষ্টির কোন থামাথামি নেই। রফিক আযাদকে ধাক্কা দিয়ে বলল, দোস্ত, কি হলো?
-চুপ! দাড়া, দেখ, লোকগুলোর গায়ে একবিন্দু বাতাস লাগছে না। একবিন্দু ভিজে নাই তারা।
রফিক যেন চমকে গেল। আরে, এতো ছবির মত। দৃশ্যপট। চোখের সামনে ছবি চলছে যেন। স্ক্রীনের উপর। লোকগুলো বলছে "হরে রাম, হরে হরে, হরে রাম হরে হরে"।
আযাদ রফিককে বলল, আমি গেলাম। রফিক বলল, কই যাবি তুই?
-আমি এই মিছিলে যোগ দিচ্ছি।
তৃতীয় বিপত্তির শুরু, আযাদ চোখের পলকে দলটাতে মিশে গেল। রফিক ঝড়ের বেগে নিজেকে সামলাতে পারছে না। সে চীৎকার করে আযাদকে ডাকছে। আযাদ শুনছে না।
একটু পর, শ্মশান যেদিকটায় ফেলে এসেছিল, রফিক দেখলো সেদিকটায় প্রচন্ড রকম ধোয়া দেখা দিচ্ছে। লোকগুলো কি পৌছে গেল? এই বৃষ্টির মধ্যে আগুন জ্বালালো কি দিয়ে? এবার, প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ যেন রফিকের পায়ের সামনেই পতিত হলো। রফিক কানে কিছু শুনতে পাচ্ছে না।
রফিক বৃষ্টি ঝড়ের মধ্যেই দৌড় দিলো। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্যের মত সে দৌড়াচ্ছে। হাপাচ্ছে। আর মনে মনে সূরা ইখলাস পড়ছে। তার জ্ঞান আছে, আযাদ কোথাও হারিয়ে গেছে, তাকে এখন বাসায় ফিরে মামাকে খবর দিতেই হবে। আযাদকে খুজে বের করতে হবে। আচমকা মাথায় যেন অনেক কাজের ভার ভেঙ্গে পড়ল রফিকের।
বাসায় ফেরার রাস্তায় সে দৌড়াচ্ছে। আগুনের কুন্ডলি পেছনে ফেলে। কিন্তু একি, সামনে আবার সেই শ্মশান! কিন্তু তাতে আগুন নেই। কেউই নেই। শুধু বটগাছ আর মঠ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
রফিকের মনে হলো সে পথ ভুল করেছে। এবার সে উত্তর দিকে দৌড় দিল। বৃষ্টি এখনো থামেনি। ঝড়ের বেগ কম। বাড়ি পৌছতে পারবে কি?
উত্তর দিকে অনেকটা পথ গিয়েও কোন কূল পেল না রফিক। সাগরের যেমন কোন কিনারা নেই, এই জঙ্গলের যেন কোন কিনারা নেই। ক'টা বাজে সে জানে না, ঘড়ি বন্ধ, মোবাইল বের করে দেখল, সেটাও বন্ধ! তারমানে আযাদের কথা ঠিক ছিল!
রফিক এবার ঝিমিয়ে পড়ল। তার চলার গতি হলো মন্থর। সে আসেপাশে তাকিয়ে যেন কোন কিছুই খুজে পাচ্ছে না। আকাশ গম্ভীর। সময়টা মেঘের কারণে বুঝা গেল না।
রফিক আবার সেই শ্মশানে এসে পৌছালো। এবার সে হাপিয়ে উঠেছে। সে গহীন জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। যেন এক লুপের মধ্যে আটকে আছে। সব দিক থেকে গন্তব্য একই!
রফিক চিৎকার করে ডাকল আযাদ, আযাদ...কোথায়?
আযাদের কোন খবর পাওয়া গেল না। রফিক বটগাছটার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে! জীবনের সব সময় যেন তার সামনে প্রতিভাত হচ্ছে। তার মায়ের কথা মনে পড়ছে, তার বাবা কথা মনে পড়ছে! তার ছোট দুই ভাই...তার প্রেমিকা সারা। সারা হয়ত ইতোমধ্যে অনেকবার ফোন করে বন্ধ পেয়ে অভিমান করে আছে। মা বাবা মনে হয় চিন্তায় চিন্তায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।
বটগাছের নিচে বৃষ্টিভেজা মাটিতে বসে রফিক সব ভাবছিল। তখনও রাত নামে নাই, অন্ধকার হয় নাই। আজব হলেও সত্য, রফিকের কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
কখন যে সে ঘুমিয়ে গেল তা টের পেল না। ঘুম থেকে উঠে দেখল সে বাংলো বাড়িটা। তার মামা তার পাশে। রফিক ধরফর করে উঠে বসল। মামাকে জিজ্ঞেস করল, মামা? আমার কি হইছিল?
-তা আমি কেমনে বলব? তোমারে ক'জন শ্রমিক মিলে বট গাছের তলা থেকে উদ্ধার করল।
-আযাদ কই?
-কোন আযাদ?
-কোন আযাদ? আমার বন্ধু যে আমার সাথে এসেছিল?
-হা হা হা...তুই তো ভালো মজা করিস! তুই একা এসেছিস। তোর সাথে তো কেউ আসেনি।
-কি বলছো মামা, কালই তো আমরা দুইজন মিলে তোমার সাথে রাতের খাবার খেলাম।
-নে তো, ওষুধটা খেয়ে নেয়। তোর রেস্ট দরকার। তোর বাবা মা কে আমি কিচ্ছু জানাই নাই। বলছি তুই আমার সাথে...
-মামা...আযাদ কোথায়?
রফিকের মামা এ কথার কোন উত্তর করে না। ঘরের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাবার সময় বলে, চা বাগানে একা বেড়াতে নেই রে ভাগ্না!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



