সব চাচাত মামাত ভাইবোনরা মিলে দাদাকে ধরলাম। "দাদা দাদা, আমাদের আজকে একটা গল্প বলতেই হবে। তুমি না কত গল্প জানো?"
আমাদের দাদা, বয়সের ভারে শরীরটা সামান্য কুজো হয়ে গেছে। তবে এখনও ডাকসাইটে বুড়ো। দাদা তো পানি খেয়ে এক চিমটি হাসলেন। তারপরে বললেন, তাহলে শোন, আজ তোমাদেরকে আমি একটা খুনের গল্প বলব।
যেই না বলা, অমনি সব্বাই চুপ। গ্রামের দেশে চাঁদনী রাতে, আমরা বারান্দায় বসে, দাদার দিকে উন্মুখ উৎকন্ঠায় তাকিয়ে রই। দাদা, কতদিন হয়ে গেল তুমি আর এমন গল্প বলো না।
শোনরে তোরা, গল্পটা আমার ছেলেবেলার। সবে আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি। গ্রামে তখন আমার খুব নামডাক। তখন জানিস তো, ডিভিশন হয়নি। ভারত-পাকিস্তান সব এক ছিল। বৃটিশ আমলের কথা। আমার ডাক পড়ল এক জমিদারের বাসায়। তার কাছে ইংরেজ সাহেবদের কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছে। আমার যেতে হবে। তা ঠিক করলাম একাই যাবো। কিন্তু একা কি আর যাওয়া যায়? তোদের বড় আব্বা, মানে আমার বাবা তো রাজিই হয় না। আমাকে যেতে হবে আসামে।
দাদা তার কমল বুড়ো হাতটা তুলে ঐদূরে আসামের খাসিয়া পাহাড় দেখাইলেন। সে রাতে পাহাড়ের গায়ে আলোঝলমল করে জ্বলছে। আমরা জিজ্ঞেস করি, দাদা? ঐ যে আসাম, তা কি এখান থেকে এত্তদূর?
দাদা বললেন, কি যে বলিস তোরা? সেখানে যেতে তখন চার চারটে দিন লাগত। আর হেটে যাওয়া ছাড়া কোন পথই নেই। আমরা তখন সেইসব দিনরাত্রির কথা ভেবে কল্পণায় ডুবে যাই। দাদা বলেন, আমার রওনা করার কথা ঠিক হলো রবিবার। আহ! বেশ মনে আছে রে...সেদিন রবিবার ছিল। আমার সাথে চলল, এই গ্রামেরই এক বড় ভাই। নাম তার হরিপদ কর্মকার। সে লোকটা কি যে পান খেতো দাদু, ওর মুখের পানের গন্ধে আমি পান খাওয়া শিখেছিলাম।
রবিবার সক্কালে রওনা হলাম আমরা। কখনও হেটে হেটে, কখনও নৌকায় সুনামগঞ্জের হাওড়-বাওড় পারি দিয়ে আমরা যে কোন দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলাম কিছুই জানি না। জায়গার নাম মিরের চর। এখান থেকে কয়েকশ ক্রোশ দূরে। সে সকালে আমরা হেটে রওনা হলাম। গন্তব্য জমিদার বাড়ি। সে জমিদারের নাম সিরাজুল ইসলাম খান বাহাদুর।
যখন রাত নামলো, আমরা হেটে হেটে ক্লান্ত। চারিপাশে ত্রি সীমানায় কোন দোকানপাট, শহর, বন্দর কিচ্ছু নাই। কেবল ধূ ধূ মাট। আর ঐসব মাঠে ধানের চাষও হয় না। ধান কে লাগাবে গো দাদু? তখন এত লোক কি ছিল?
সন্ধার সময় এক গ্রামে, আমরা এক বাড়িতে টোকা দিলাম। সে বাড়িটা ছিল অদ্ভূত রকমের সুন্দর। বাড়িতে থাকত এক বুড়ো লোক। তার নাম ছিল রহমান। আমরা রহমান সাহেবকে আমাদের এই দীর্ঘ পরিভ্রমণের কথা বলতে, তিনি কিছুই বললেন না। গম্ভীর হয়ে থাকলেন। উনি মানুষটাই গম্ভীর ছিল। জানো তো, চুপচাপ, অনেক কথা বলার পরে বলেন হু। ব্যাস আর কোন কথা নাই।
তিনি বললেন, কাল সকালে তোমরা আবার রওনা হইয়ো। আজ এক্কান থাইক্কা যাও। আমরাও মনে মনে তাই চাচ্ছিলাম। আমাদেরকে তিনি একটা ঘর দিলেন। মাদূর দিলেন। শীতকাল ছিল বলে দুইটা চাদরও দিলেন। বালিশ ছিল না। বালিশ ছাড়াই আমরা নাক ডেকে ডেকে ঘুমাতাম।
রাত তখন কত গভীর হবে? জানার কোন উপায় নাই ঘড়িই তো ছিল আমাদের কারও কাছে। তবে তখন গভীর রাত। বাইরে কুয়াশার মেঘ। সাথে ঝলমলে চাঁদের আলো। এমনি সময় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমার পাশে হরিপদ দাদা খড় খড় করে নাক ডাকছে। আমি উঠলাম, উঠে বসে, কি সম্মোহনে বাড়িটার ঠিক বাইরে এসে দাড়ালাম। গ্রামের মানুষজন সবাই সন্ধ্যার সময় ঘুমিয়ে পড়ে। চারিদিকে থম থমে নীরবতা।
কিন্তু, এত নীরবতার মধ্যেও আমি একটা শব্দ পেলাম। কেমন যেন ঝাক ঝাক ঝোক ঝোক শব্দ। বাড়িটার পেছনে ডালিম গাছটা ছিল। তার থেকে কয়েক পা দূরে একটা জঙ্গল। শব্দটা ঐ জঙ্গল থেকে আসছে। আমি সে পথে পা বাড়ালাম। সেসময় তো, চোর ডাকাতের ভয় এই এলাকায় ছিল না। তবে ভূতের ভয় প্রায়ই মানুষ পেত। আমিও সত্যি বলি, আমিও পেলাম। তবুও কৌতূহলটা যে দমাতে পারিনা।
জঙ্গলের ভেতরে সন্তর্পণে প্রবেশ করলাম। করতেই রহমান সাহেবকে ধবধবে চাঁদের আলোয় দেখলাম। তিনি কি যেন করছেন। আমি শব্দ করে বললাম, রহমান সাহেব গো। কিতা কর বা?
এই কথা শুনে রহমান লোকটা, আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তার সারা গায়ে ঘাম। আমি এই রাতেও যেন তার জ্বলজলে লাল চোখটা দেখতে পেলাম। ভয়ে আমার হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেল। রহমান এর গায়ে রক্ত চোখে পড়ল।
হিমশীতল চাহনী আমাকে অসার করে দিল। তারপরে তার গলার স্বরেই নীরবতা ভাঙ্গলো। তিনি বললেন এই দিকে আহো, কিতা করি দেইখ্যা যেও।
আমি ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাড়ালাম। ওমা, দুই দুইটি লোকের ক্ষত বিক্ষত লাশ। একজনেরটা একটু একটু নড়ছে। এত রক্ত, এই রাতে জঙ্গলের চাঁদের আলোতেও আমি যে স্পষ্ট দেখছি। রহমান বলল, এরা হইল, আমার বন্ধু। নিজাম-উদ্দীন, শরীফ-উদ্দীন। এই দুইটারে আইজ ফেলাইলাম। কেন ফেলাইলাম জানতে চাওনি?
আমি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললাম না। তখন রহমান সাহেবের হাতে ফসল কাটার রাম দাও দেখে আমি আরও আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। বললাম, আমি যাই রহমান সাহেব। আমার খুব ভয় করছে।
-ভয় পাও কেনো? ভয়ের কিচ্ছু নাই। এদের তো মরার কথাই ছিল। এরা হইল, আমার সব থেকে বড় বন্ধু। বন্ধু ভাইব্যা হেগোরে দুইটা কথা কইয়া ফেলছিলাম। হেরা আমার জীবনটারে বিষায় তুলছিল। দে শালার খতম কইরা। কি কইছিলাম হুন্তায় নি?
আমি বললাম, না থাক। আমি যাই।
রহমান চীৎকার দিয়ে বলতে লাগল, বলছিলাম আমি মানুষখেকো। আমি মানুষের মাংস খাই। এখন বুঝলায়নি। আমি হেগোর মাংস খাবো। বলে সে কি অট্টহাসি।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম না। দৌড় দিয়ে ঘরে এসে দরজা আটলাম। তখন হরিপদ কর্মকার তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল। বলল, কি হইছে রে?
বললাম, কিছু না দাদা, ঘুমাও তো। ঘুম কি আর হয়? সারারাত জেগে জেগে দরজার দিকে খেয়াল রাখছি। রহমান যদি আমাদেরকেও মেরে খায়?
ভোরে যখন সূর্য উকি দেয় দেয় করতেছিল। তখন আমি হরিপদকে উঠিয়ে বললাম, চলো রওনা হই। হরিপদও আমার তাড়াহুড়ো দেখে বলল, কেনরে ভাই? এত তাড়াহুড়ো কিসের।
আমি বললাম, কারণ আছে। আগে বাইরে চলো। ঘর থেকে বাইর হতে দেখি, রহমান সাহেব আমাদের দিকে স্থির দৃষ্টিমেলে তাকিয়ে আছে। আমি তো কেপে উঠলাম ভয়ে। তিনি বললেন,
রুটি করছি, মাংস চুলায়, নাস্তা খেয়ে রওনা হও। হরিপদ হিন্দু। মাংস খায় না। আর আমার ভয়, এটা কিসের মাংস? রাতে যা দেখলাম? সেটার?
হরিপদ বলল, আমি মাংস খাই না।
-তোমার জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে। ধেড়শ ভাজি করতেছি। বাগানের ধেড়শ।
এ কথা শুনে হরিপদ আর যেতে চায় না।
আমার সামনে দেওয়া হলো রুটি মাংস, ওর সামনে রুটি ধেড়শ ভাজি। রহমান সাহেব হাসে...আমি ভাবি, এ মাংস কিসের মাংস...
এই বলে দাদু, চুপ করে গেলেন। আর তো দাদুকে গল্পটা পুরোটা বলাতে পারলাম না। দাদুকে যতই বলি, দাদু বলেন আরেকদিন। সে গল্প আর যে শোনা হলো না। না রইল দাদু, না রইলাম আমরা কেউ। শহরের জঞ্জালে দাদুর সেই অচিন গাঁয়ে, অচিন বাড়ির পেছনে অচিন অন্ধকারে অচিনপুরের খুনদুটো, কেবল রহস্যই রয়ে গেল...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



